মানুষ কাঁদে। মানুষ কাঁদে কেন ? সবাই ত আর কাঁদেনা। তবে অনেকেই কাঁদে। কাঁদার কোনো বয়স নেই,সব বয়সের মানুষ কাঁদে। নারী ,শিশু, পুরুষ ,স্হান-কালের ধার ধারেনা কাঁদতে। মানুষ পাওয়ার আনন্দে কাঁদে,আবার হারানোর বেদনায়ও কাঁদে। তাইতো প্রবাসে আসার সময় মা’কে যেমনি কাঁদতে দেখি প্রবাস থেকে বাড়ি ফিরলে মা’কে তেমনি কাঁদতে দেখি। কাঁদার জন্য একটা অনুভূতিসম্পন্ন  মন থাকা চাই। তবে অনুভূতি সবসময় সমান কাজ করেনা,অনুভূতির ব্যরোমিটার তাপমাত্রার মত উঠা নামা করে।
সেদিন আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদের “যেভাবে বেড়ে উঠি”বই পড়ে আমিও কাঁদলাম। বিশেষ করে তাঁর দাদার সাথে লাঠি খেলার অংশটা পড়তে গিয়েই আমার দু‘চোখ দিয়ে নোনা পানি ঝরিয়ে পড়লো। অথচ এই অংশটা অন্য সময় পড়লে আমি না কেঁদে হয়তো মুখটিপে হাসতাম। দাদা-নাতির লাটিযুদ্ধের রসাত্মক  অংশ কাঁদানোর নয়,হাসার। আমার বিশ্বাস এই অংশটা পড়তে গেলে কবি আল মাহমুদ এইমুহুর্তে হাউমাউ  করে না কাঁদলেও তাঁর দু‘চোখের কোনা ভিজে যাবে,চোখ ঝাপসা হবে,পানি গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে  পড়বে।
সব মানুষেরই বেড়ে উঠার সময়কাল একই ধরনের। তিনি যতই যশ খ্যাতিসম্পন্ন অনেক বড় মানুষ হোন না কেন শৈশবকালটা যেন ঠিক আপনার আমার মত। বাবার হাত ধরে মক্তবে কালমা কুরআন পড়তে যাওয়া, পাঠশালার প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি  হতে যাওয়া, মায়ের আচলে মুখ লোকানো, মায়ের কাছে বর্ণমালা  শেখা , দাদার সাথে দুষ্টুমি খেলা, ঈদে নতুন জামাকাপড় পরে পা ছুয়ে বড়দের সালাম করা-সালামির জন্য অপেক্ষা করা, বাবার হাত ধরিয়া  ঈদগাহে যাওয়া ,অসুখ-বিসুখে বাবা মায়ের চোখের আতংক, এটা খাবনা-ওটা খাবনা বলে মা‘কে জ্বালানো , খালা ফুফুর স্নেহ- আদর, শৈশবের দুরন্তপণা সবকিছুই কবি আল মাহমুদের যেমন, আমারও তেমন, আপনারও। পার্থক্য শুধু  অর্থ আর বিত্তে।
আপনি যে সময় একগ্লাস দুধ পান করে আপনার বাবার হাত ধরে নতুন পায়জামা পান্জাবি পরে মক্তবে গিয়েছেন সেসময় অন্যে হয়তো দুধের  বদলে একগ্লাস পানি পান করে তার বাবার হাত ধরে মক্তবে গিয়েছে। এখানে বাবার হাত ধরিয়া মক্তবে যাওয়ার অনুভূতিটাই হচ্ছে মুখ্য। আপনি যেসময় আপনার মা’য়ের জামদানি শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়েছেন অন্যে হয়তো তার মা‘য়ের মোটা সুতোর ছেড়া কাপড়ের আঁচলে তার মুখ লুকিয়েছে। এখানে মুখ লুকানোর অনুভূতি দুজনেরই সমান । এই কারনে যে কারো জীবনের  স্মৃতিচারণমুলক লেখা বিশেষ করে শৈশবের স্মৃতি পড়তে  ভালো লাগে। কেননা ঐখানে  যেন নিজের শৈশবকে খুঁজে  পাওয়া  যায়।
আল মাহমুদের “যেভাবে বেড়ে  উঠি” জীবনীমুলক বইটা পড়তে  গিয়ে দাদা নাতির লাঠি খেলার পর্বে আমার কান্না এসেছিল এজন্যে। সেই চমৎকার  দিনগুলো যে এখন আর আমাদের নেই, নেই আমাদের দরদবন্দ সেই প্রিয় মানুষগুলো । সেই মানুষগুলোর কথা মনে করেই আমার কান্না এসেছিল। অন্য সময়ে হয়তো আসতোনা। এখন আসার কারণ , আমার অনুভূতির ব্যারোমিটার সর্বোচ্চ  পর্যায়ে। কেননা আমি এইসময়ে আমার সব কাছের মানুষগুলো থেকে অনেক দুরে এবং  একাকী একাকীত্বে। আর মানুষ যখন খুব একা হয়ে পড়ে তখন তার শৈশব, কৈশোর সব স্মৃতিগুলো মানস্পটে উদ্ভাসিত  হতে থাকে। তখন সে স্মৃতির ভেলায় ভাসে, কাঁদে-হাসে।
(লিখেছিলাম ২৮ জানুয়ারী ২০১৫ ইং তারিখে। প্রিয় কবি আল মাহমুদের ৮০তম জন্মদিনে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। )