২০১৫ সাল তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।  

দোকানের কর্মচারী পারিবারিক কাজে তিনদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় গিয়েছেন তাই নানাভাই বললেন,
" সৈকত তুই কি আমার সাথে দোকানে বসতে পারবি? "
উত্তরে বললাম, জ্বী নানা।
সেদিন কলেজে যাইনি নানাভাইকে সাহায্য করার জন্য। মুদির দোকান। আমার ব্যবসায় কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তা সত্ত্বেও ভরা কৌতূহল ও একপ্রকার আনন্দ নিয়ে সকাল বেলা ৬.৩০ মিনিটের দিকে হবে হয়তো চললাম নানার সাথে বাজারের দিকে।


বেলা একটা পর্যন্ত আমাদের দোকান খোলা থাকে চলতে থাকে বেচাকেনা ; তারপর রওয়ানা দেই বাড়ির পথে। সেদিন দুপুর পর্যন্ত ভালোই বেচাকেনা হয়েছে। মুখে একগাল হাসি নিয়ে আমি ও নানাভাই দুজনেই বাসায় আসি। ঘর্মাক্ত শরীর, ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে ফুটে ওঠেছে। গোসল করে নামাজ পড়ে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিলুম৷ ঐ ঘর ( আমাদের ঘরের সাথেই নানার ঘর)  থেকে নানার কন্ঠস্বর ভেসে আসলো ,
" সৈকত, সৈকত "
আমি ঘর থেকে বললাম, "জ্বী নানা। "
"চল  দোকানে যাই, একটা কাস্টমার ফোন দিছে বিশ লিটার ক্যারাসিন নিবো," নানা বললেন।
আমি পোশাক পরে উঠোনে এসে দাঁড়ালুম। নানার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে, বুঝতে পেরেছি উনি আজ খুশ মেজাজে আছেন। সে যাইহোক, আমিও চললাম নানার সাথে সাথে দোকানের উদ্দেশ্যে। সেদিন বিকেল পর্যন্ত সম্ভত ত্রিশ -চল্লিশ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। তাই নানা আজ খুব খুশি ; আমাকে বললেন,
" যা একলিটার ঠান্ডা ( কোমলপানীয়) লইয়া আয়, আর একটা ঐ যে আছে না কেক, কী জানি নাম?  
আমি বললাম, দিলশাদ কেক?  
উনি সম্মতিসূচক উত্তর দিলেন," হ, মনে হয় ইডাই অইব, তোর যা ভাল্লাগে ইডা ঐ আন্। "
আমি পাশের একটি কনফেকশনারি দোকান থেকে একলিটার কোমলপানীয় ও কেক নিয়ে দোকানে
ফিরে আসি ; আমি ও নানাভাই দুজনে মিলে হালকা খাবার গ্রহণ করি। আছরের আজান ভেসে আসতে লাগলো কানে,  আহা কি মধুর সুর!  সে সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যাই যেন ক্ষণিকের জন্য অজানা সুরের ভুবনে। হঠাৎ কী এক খেয়াল হলো বাড়ি আসার, তাই অমনি কোনো দ্বিধা ছাড়াই নানাকে বললাম,
" নানা তইলে আজকা আমি যাইগা,  বাড়িত একটু কাজ আছে। "
যদিও আমার তেমন বিশেষ কাজ ছিল না।নানাভাই সম্মতি দিলেন।


বিকেল ৪.২০ মিনিট।
হলুদ আভায় ঢেকেছে যেন ধরণী। সূর্য্যি মামা পশ্চিমে প্রায় হেলে পড়েছে। আমি গায়ে হালকা ধরণের একটি নরম পোশাক পরে চলে গেলাম পুকুর পাড়ে৷ এখানে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কতেক বন্ধুর সাথে রোজ বেশ জমপেশ আড্ডা বসে ; কিন্তু সেদিন কেউই আসেনি। আমি পুকুর পাড়ে দু-তিন মিনিট দাঁড়ানোর পর হঠাৎ দেখতে পেলাম ফর্সা রঙের একটি কিশোরী মেয়ে ও সাথে তার ছোট্ট সেহেলির সাথে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মেয়েটির চোখে চোখ পড়তেই, সে লজ্জায় খুব দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিল সরু রাস্তাটি ধরে ; আর যাওয়ার সময় বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলো। হঠাৎ সে আড়াল হয়ে যায়, মিলিয়ে যায় যেন কোথাও। আমার বন্ধুও চলে আসে। তার নাম তাজুল ইসলাম ; তাকে আমি তাজু বলেই ডাকতাম। তার কাছে মেয়েটি সম্পর্কে বলি  ; কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেদিন মেয়েটির আর দেখা পাইনি তাই তাজুকে দেখাতে পারিনি। বুঝতে পেরেছিলাম আমার বুকের মধ্যে ঢেউ খেলছে ; আমি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। মসজিদের মিনার থেকে দিগ্বিদিক থেকে মুয়াজ্জিনের মধুকন্ঠে মধুর আযানের সুরে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আকাশপ বাতাসে, কানে এসে পৌঁছালো মধুময় আযানের সুর। সূর্য্যি মামা পশ্চিমাকাশে অস্ত গেলো। লাল রঙের পোশাকে সেজেছে যেন পশ্চিম দিগন্ত। একটা সময় আঁধার ঘনিয়ে এলো। বাড়ি ফেরার পালা। চলে এলাম বাসায় ; সেদিন আগের দিনের চেয়ে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিলো বাসায় ফিরতে। বড্ড ভয়ে ছিলুম ; যদি আম্মু বকঝকা করে কিন্তু না!  আমার সে ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেল, আম্মু আমাকে কিছুই বলেনি, এতক্ষণ দেরি হয়েছে কেন তার জন্য কোনো কৈফিয়তও নেয়নি।মেয়েটির কথা বারবার ভাবতে লাগলাম, তার চিন্তায় সেদিন রাতে খুব ভালো ঘুম হয়নি। আমার একটাই প্রশ্ন মেয়েটির দেখা কি আর পাবো? মেয়েটির ডাগর আঁখি, মায়াবী মুখখানি বারবার আমার চোখে ভাসতে লাগলো।আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম আবার যেন মেয়েটির দেখা পাই।


পরদিন ঠিক বিকেল ৪.২০ মিনিটে আমি আবার চলে গেলাম আমাদের একমাত্র আড্ডার জায়গা পুকুর পাড়ে। আল্লাহ বোধহয় সেদিন আমার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন তাই হয়তো তিনি আমার দোয়া কবুল করেছিলেন। হ্যাঁ, আমি সেই মেয়েটির কথাই বলছি ; হঠাৎ সে সম্ভবত খয়েরি রঙের একটি জামা পরে নতুন একজন ছোট্ট সেহেলির সাথে এসেছিল। দুজনে দাঁড়িয়েছিলো সবুজ মাঠে। তখন সরষে ফুল ফুটেছিল। হলুদ শাড়িতে যেন সেজেছে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি। বন্ধু তাজুল ইসলাম ওরফে তাজুও চলে আসলো।আজ মেয়েটি চলে যায় নি। তাজুকে মেয়েটিকে দেখালাম ; এবং বললাম " তুমি কি মেয়েটিকে চিনো?  সে প্রত্যুত্তরে বললো, হুম। আমি বিস্ময় আঁখি তুলে তার দিকে চেয়ে বললাম, সত্যিই চিনো?  সে আবারও বললু, হু।মেয়েটির নাম কী জানো?  আমি জিজ্ঞেস করলাম। তখন তাজু বলল, না!  নামটা ঠিক জানিনা। আমি তাকে বললাম, নামটা জেনে দিতে পারবা?  সে বলবো, অবশ্যই পারব। বাড়ি যাওয়ার সময় তাজুকে আবারও বললাম, আগামীকাল কিন্তু মনে করে মেয়েটির নাম জেনে আসবা।সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি প্রদাণ করে চলে গেলো আমিও চলে আসলাম বাড়িতে।


পরদিন বিকেল  ৪.১০ মিনিট। আবার সেই পুকুর পাড়ে জমায়েত হলাম আমি ও তাজু। " মেয়েটির নাম কি জানতে পারছ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তাজু বলল, হু।
কী?  (কৌতূহল ও একপ্রকার উত্তেজনা কাজ করছে আমার মনে তখন)  
মেয়েটির নাম, স্বপ্না,স্বপ্না দেবনাথ । সে হিন্দু পরিবারের মেয়ে।
তার বাবার নামও আমাকে জানালো বন্ধু তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু। কিন্তু সেদিন দূর্ভাগ্যবশত মেয়েটির( স্বপ্নার) দেখা পাইনি। কিন্তু মনের অজান্তেই তাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তার জাত-ধর্ম আমি দেখিনি ; তাকে আমি ভালোবাসি ব্যস এটুকুই এর বেশি কিছু আমি জানতে চাইনি। ধীরে ধীরে মেয়েটির প্রতি আমি দূর্বল হয়ে পড়ি তার প্রতি আমার প্রেম গভীর থেকে আরো গভীরতর হতে থাকে৷ কিছুদিন পর তার এক সহপাঠী বান্ধবীর মাধ্যমে একটি কবিতা ( চিরকুট) লিখে উপহার দেই। কবিতাটি নিচে দেওয়া হলো।  


                    স্বপ্না


প্রথম যেদিন দেখেছি তোমায় পড়েছি তোমার প্রেমে,
গোধূলি বেলায় মেঠোপথ ধরে চলেছ, বৃষ্টি যখন গেছে থেমে।
       ছোট ছোট গৃহগুলি সখি পশ্চাতে ফেলে;
       পথ ভুলে বুঝি মোর কাছে এলে?
      সন্ধ্যা যে সখি ঘনায়ে এলো সূর্য্যি ডুবি ডুবি,
অস্তপারের ঐ সন্ধ্যাতারায় রাখিনু তসবির তব যত্নে খুবি।


ব্যাকুল হয়ে খুঁজিনু তোমায় পরদিন মোর মানসী প্রিয়া,  
গোপন রাণী হয়ে মোর তুমি রও হৃদয়ে গোপনীয়া।
শ্যামলী মায়ের মেয়ে তুমি ; যেন ইন্দ্রলোকের অপ্সরা,
তোমার রূপেতে রূপসী হলো গো যেন এ বসুন্ধরা।


           ভুলিবনা তোমায় কভু করিনু এই পণ,
    তোমারি মাঝে সখি গো মোর রবে এ জীবন।
    ঘন ঘোর আঁধারে আলো জ্বেলেছ তুমি দ্বীপান্বিতা,
তুমি হও শিরি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু অথবা দুখিনী সীতা।
        তোমাতে আমাতে রচিব ধরায় প্রেমের বৃন্দাবন,
সৃজিব নব রাজলীলা স্রষ্টার এ শ্যামলিমা মায়া- ভুবন।


তোমারি রূপ-দীপ্তে ধরণী দীপ্তিময়,
ওলো স্বপ্না, তোমারি প্রেম-ছোঁওয়ায় হবে জীবন মধুর অতিশয়।
মেঘমালার মতন তোমার ঢেউখেলানো এলোকেশ,
রাঙা বধূঁয়ার বেশে লাগিবে তোমায় অতিবেশ।
রয়েছ গোপন তুমি মোর হিয়ার মাঝার,
কাটিব সন্তরণ তুমি ও আমি প্রেমের পাথার।


            ওগো লক্ষ্মী দেবী,
নামিয়া এলে কোন সে মায়ায় ধূলির পৃথিবী?
কোন সুরে সখি তুমি বাজায়ে যাওগো বীণা?
তোমার সনে হবে গো প্রেম মোর লেনাদেনা
এই ধরণী মাঝার! চিত্তকাড়া তব ডাগর দুটি আঁখি,
বাংলাদেশের তুমি যেন ফের সে "দীওয়ানে হাফিজ" সাকি!  
নূতন সুরে তুমি কবি হাফিজের গজল গাওয়া,
চিত্তহরণ করে মোর তোমার ও- সুকরুণ চাওয়া।
জগতের মাঝে তুমি প্রিয়া নব নূরজাহান,
বসুধা বক্ষে দাও গো সঁপে প্রেম মোরে অয়ি গুলশান।
এ যুগের তুমি যেন দেবী অন্নপূর্ণা,
হেরিয়া তোমার শ্রীমুখখানি মেটাই প্রবল তৃষ্ণা।    


[বি.দ্র: মূল কবিতাটির থেকে সামান্য পরিবর্তন, সংযোজন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। ]
পরিশেষে এতটুকুই বলব, যদি আমার লেখায় কোনো রকমের ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।        


( ছবিটি ব্যক্তির অনুমতিক্রমে আপলোড করেছি)