অলংকার শব্দটি সংস্কৃত ধাতু অলম্ থেকে এসেছে, এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ( অলম-√কৃ+ঘঞ) আভরণ বা ভূষণ৷ একজন রমণীর দেহকে যখন আরো শ্রীবৃদ্ধি ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য যেমন অলংকার এর প্রয়োজন হয় এবং অলংকার দ্বারা সজ্জিত করা একজন রমণীর গোটা দেহ ; তদ্রূপ কবিতার বা সাহিত্যের অঙ্গকেও আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত ও রূপময় করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় কাব্যালংকারের। তবে যে রমণীর অলংকার বিহীনই অসম্ভব সুন্দরের অধিকারিণী তার জন্য অলংকারের প্রয়োজন হয় না কারণ সে এমনিতেই সুন্দর ; কিন্তু যে কবিতায় অলংকার অনুপস্থিত তার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও রস একমাত্র বোদ্ধা পাঠক বা সহৃদয় পাঠকই অনুধাবন করতে পারেন। আমি পরবর্তীতে সহৃদয় পাঠক কে সে সম্পর্কে একসময় বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।


কাব্যালংকারের প্রতিষ্ঠা হলেন আলংকারিক " ভামহ ", তিনিই অলংকার সম্প্রদায়ের নির্মাতা৷ অলংকার সম্পর্কে আলংকারিক ভামহের অভিমত হলো --
রূপকাদিরলঙ্কারস্তথান্যৈর্বহুধোদিতঃ।
ন কান্তমপি নির্ভূষং বিভাতি বনিতাননম।। -১
অর্থাৎ, রমণীর মুখমণ্ডলের রমণীয়তা যেমন অলংকারহীন অবস্থায় রমণীয় বলে মনে হয় না ঠিক তেমনি অলংকারহীন কাব্য ও কাব্য বলে মনে হয় না।


সুতরাং, একজন রমণীর সৌন্দর্যকে আরো ফুটিয়ে তুলতে যেমন গয়না বা অলংকারের বিকল্প নেই তেমনি কবিতার অঙ্গকেও শ্রীবৃদ্ধি করতে কাব্যালংকারের বিকল্প নেই৷ আলংকারিক ভামহ কাব্যালংকারকে ২ ভাগে বিভক্ত করেছেন৷
যথা- শব্দালংকার ২.অর্থালংকার।


কাব্যালংকার সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য নিচে উপস্থাপন করা হলো -
ক. কাব্যশোভাকরান্ ধর্মানলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে।--২
অর্থাৎ, কাব্যের যে সকল ধর্ম তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তাই অলংকার৷
খ. কাব্যম সৌন্দর্যমলংকারাৎ --৩
অর্থাৎ, কাব্যের সৌন্দর্যই হলো অলংকার।
গ.কাব্যম গ্রাহ্যং অলংকারৎ --৪
অর্থাৎ, অলংকারের জন্যই কাব্য গ্রহণীয় হয়ে থাকে।


আলংকারিক আচার্য বামন এই সৌন্দর্যকে ২ ভাবে অবলোকন করেছেন- ১.  স্বাভাবিক সৌন্দর্য- যা কাব্যের গুণ থেকে সৃষ্ট ২. কৃত্রিম সৌন্দর্য- যা কাব্যালংকার থেকে উদ্ভূত৷ প্রথমটি স্থায়ী বা নিত্য আর দ্বিতীয়টি অস্থায়ী বা অনিত্য। ৫
( কাব্যশোভায়াঃ কর্তারো ধর্মাগুণাঃ।।
তদতিশয়হেতবস্তবলঙ্কারাঃ।।" পূর্বে নিত্যা"||)
আলংকারিকবিদগণ কাব্যে দুটি অলংকারের কথা বলেছেন --
ক. শব্দালংকার খ. অর্থালংকার।


অনুপ্রাস, উপমা, যমক, শ্লেষ, রূপক হলো অলংকারের বাহন৷
মোদ্দাকথা, কাব্যের সৌন্দর্যবৃদ্ধি, কাব্যের আত্মাকে শোভিত করতেই অলংকারের প্রয়োজন, অলংকারহীন কাব্য সুখপাঠ্য হয় না৷ কাব্যের ভিতরকার রস সহজে অনুমেয় হয় না।
রবীঠাকুর তার " সাহিত্যের ধর্ম " প্রবন্ধে বলেন, " সেই ভাব, সেই ভাবনা, সেই আবির্ভাব যাকে প্রকাশ করতে গেলে অলংকার আপনি আসে, তর্কে যার প্রকাশ নেই, সেই হলো সাহিত্য। অলংকার জিনিসটা চরমের প্রতিরূপ- এই অলংকৃত কাব্যই হচ্ছে রসাত্মক কাব্য৷


সুতরাং, এ থেকে বোঝা যায় কাব্যে অলংকারের গুরুত্ব অপরিসীম। এবার আমি শব্দালংকার ও অর্থালংকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
শব্দালংকার - যে অলংকার ধ্বনির তথা শব্দের সৌন্দর্য  বৃদ্ধি করে এবং বাক্যকে শ্রুতিমধুর করে তুলে তাই শব্দালংকার৷ মনে রাখতে হবে, শব্দালংকার শব্দের পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না ; অর্থাৎ, শব্দের পরিবর্তনে অলংকার থাকে না। শব্দালংকারমূলতঃ ধ্বনির অলংকার। ৬


ধ্বনি কয়েকভাবে হতে পারে যেমন :
১. বর্ণধ্বনি-- অনুপ্রাস ২. পদধ্বনি --যমক ৩. বক্রোক্তি ৪. শ্লেষ ৫. পুনরুক্তবদাভাস ; আর বাক্যধ্বনি - সবযমকে দৃষ্ট হয়ে থাকে৷
অর্থালংকার : যে অলংকার কাব্যের অর্থের ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য আনে এবং কাব্যের অর্থের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তাই অর্থালংকার।


শব্দালংকার ও অর্থালংকারের মধ্যে পার্থক্য হলো - শব্দালংকারের মূখ্য আবেদন শোনার কাছে, আর অর্থালংকারের আবেদন পাঠকের জ্ঞান বা বুদ্ধির কাছে৷বাক্যে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ বোধগম্য না হলে এর অলংকারত্ব ফুটে ওঠেনা; তখন কাব্যের শ্রীহানি ঘটে।


আলংকারিকগণ অর্থালংকারকে ৫ ভাগে বিভক্ত করেছেন--
১. সাদৃশ্যমূলক অলংকার ২. বিরোধমূলক অলংকার ৩. শৃঙ্খলামূলক অলংকার ৪. গূঢ়ার্থমূলক অলংকার ও ৫. ন্যায়মূলক অলংকার।


বি.দ্র: আপাতত আজকে এতটুকু পর্যন্তই আলোচনা করলাম। যদি আমার এ লেখা দ্বারা কেউ সামান্যতমও উপকৃত হয় তাহলে আমার পরিশ্রম ও লেখা সার্থক হবে বলে মনে করব৷ আর যদি কেউ কাব্যের অলংকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার অভিপ্রায় ও কবিতার প্রতি ভাললবাসা থাকে এবং আপনাদের উৎসাহ পেলে ইনশাআল্লাহ কাব্যালংকার, কাব্যরস তথা কাব্যের বাদবাকি উপাদানগুলো নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।


তথ্যসূত্র :
১. ভামহ ; কাব্যালংকার, পৃষ্ঠা - ৭
২. আচার্য দণ্ডী ; কাব্যাদর্শ, পৃষ্ঠা- ৮১
৩ও ৪. আচার্য বামন ; কাব্যালংকার সূত্রবৃত্তি, পৃষ্ঠা -৫ ও
৫. আচার্য বামন ; কাব্যালংকার সূত্রবৃত্তি , পৃষ্ঠা- ৬৮-৭০
৬. প্রফেসর ড.  ধীরেন্দ্রনাথ তরফদার ; প্রাচ্য সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব ও অলংকার শাস্ত্র, পৃষ্ঠা - ৩৬৭  


(আমার এ লেখায় কোনো ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে আপনারা আমায় স্নেহের দৃষ্টিতে দেখবেন ও আমার দ্বারা কৃত ভুলকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)