কাঁধের গামছাটাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঝুড়ি কোদাল বেলচার সাথে
ওদের প্রতিদিন কেটে যায়। ওরা পৃথিবীর শরীরের এক জায়গার মাংস খামচে
অন্য জায়গায় মাংস ভরাট করে। ওরা ট্রাকে মাল বোঝাই করে
ওরা মাল নামায়। ওরা কড়া রোদের চাবুক পিঠে নিয়ে ফসল ফলায়,
ফসল কাটে; ওরা ইমারত গড়ার মশলা জোগান দেয়...
তবুও কাগজের ঠোঙা বন্দি শুকনো মুড়ির মতো জীবন।
ওদের জীবন পঞ্জিতে লেখা হয় প্রতিদিনের রক্ত ঘাম ঝরানোর কর্ম ইতিহাস।
ছেঁড়া চটিতে সেফটিপিন মেরে, ঘামে ভেজা জামাটাতে রিফু করে করে
চলে যায় বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
দুঃখ কষ্টের হিবাচিতে পুড়তে পুড়তে ওদের শরীর যেন
শক্ত কালো লোহায় পরিণত। মনের ভেতর সুখের তরল জমাট বেঁধে
কবেই দুঃখের কঠিন শিলা হয়ে গেছে।
আগুন ঝরা রোদে কাজ করতে করতে ওদের মাথা ঝিমিয়ে আসে
ক্লান্তি অবসাদ ওদের কর্ম ক্ষমতা চুসতে চুসতে যখন বলে 'থামো এবার'।
ওরা পাত্তা দেয় না!
লেহিত কনিকায় শ্বেত কনিকায় ওরা মেশিয়ে দেয় নিকটিনের স্বাদ;
থামলে যে চলে না।
ঘরের লালিত পালিত প্রাণী গুলো
ওদের দিকে সদ্য ডিম ফোটা পাখির ছানার মতো তাকিয়ে।
ওরা যেন উটের মতো পার করে রোজ এক একটা দিনের মরুভূমি।
একটা কাঁচা লঙ্কা আর পাতলা ডাল মাখা হলুদ ভাতেই
ঘুরে যায় ফুরিয়ে যায় জীবনচক্র।
ঘরে ওদের এক বেলা কোন রকম উনুন জ্বলে;
আর এক বেলা সেই উনুনের পাশে বিড়াল ঘুমায় নিশ্চিন্তে।
গাঢ় কালো চিন্তের মেঘ থেকে ওদের মনের মাঠে অস্বস্তির বৃষ্টি নামে
ভাসিয়ে নিয়ে যায় ছেঁড়া কাঁথার শিরা বেয়ে সব স্বপ্ন আশা।
ওরা ওদের প্রাপ্য কর্ম মূল্য পায়না; অর্ধেকটা
সমাজের দালালরা শানানো চোয়ালে কামড়ে ধরে রাখে,
ওরা তাদের সাথে ব্যর্থ লড়াই করে...
গরিবি কিরীট পরিয়ে কপালে কষ্টের তিলক লাগিয়েতে
পিঠের উপর যন্ত্রণার প্রলেপ দিয়ে পোড়া স্বপ্নের ইস্তাহার মেরে, কেউ যেন
ওদের ফেলে দিয়ে গেছে এ জীবনের টিকে থাকার জলন্ত ক্ষেত্র ভূমিতে।
ওদের বউরা লতা পাতা কুড়িয়ে আনে
উনুনের গর্তে অভাবের চিতা জ্বালিয়ে কিছুটা রসদ ফুটাবার জন্য;
তারাও শীত বর্ষায় পুকুর ডোবাতে নেমে পাঁকে হাত ফুঁড়ে ফুঁড়ে
গুগলি তোলে... বেচে বাজারে, কেউ বেতের ঝুড়ি বুনে, কেউ
অন্যের বাড়ির সাফ করে জঞ্জাল।
খসে পড়া বাঁশ পাতার মতো তারাও ঘুরতে ঘুরতে ঝরে পড়ে
যেন ক্লান্ত শরীর নিয়ে দিনের গোধুলিতে ...
ওদের ঘরে ছেলে পিলেরা স্কুলে যায়
ভালো ফল করে ... ওদের হৃদয়ে দু চারটে আনন্দের বুদবুদ ভেসে ওঠে,
কিন্তু সে খুশির থেকে ওদের ছেলে পিলেরা যখন
খাল ডোবা মেরে শোল ল্যাঠা কই শিঙি মাছ ধরে আনে সে খুশি অনেক বেশী।
এক্সরে করা রিপোট এর মতো ওদের পাঁজড়ের হাড় সহজেই গোনা যায়,
তাদের দুটি ধুলো মাখা শুষ্ক গালের উপর দুটি নোনা জলের নদী
দূর থেকেও স্পষ্ট। গ্রীষ্মে ঝিমিয়ে পড়া গাছের পাতার মতো
ওরা স্বস্তির জল খোঁজে , পর্যাপ্ত আহার খোঁজে সতেজ হয়ে উঠবার তরে।
এই তো জীবন!
এই তো ওদের টিকে থাকা লড়াই;
এই তো ওদের ক্ষুদার্থ আগুন ধরা ফোসকা পড়া পেটে
কিছুটা রসদের ছিটা দিয়ে কষ্টের উষ্ণতা ভুলে
কিচ্ছুক্ষণ ঘুমিয়ে যাওয়া রাতের বুকে;
আবার জেগে ওঠা দু চোখে সেই রাত নিয়ে অহরহ ...
*****