"আম্রপালি পালিয়ে যায় পেছনে তার সমাজ তাড়া করে/ আম্রপালি বাঁচতে চায়"-


হাজার বছর ধরে এই নিষ্পাপ নারী আম্রপালিরা শুধু সমাজে অনুমোদিত লক্ষণরেখায় বন্দী জীবন কী কাটাবে? এটাই কি ভবিতব্য? ইতিহাস সাক্ষী সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই আম্রপালির উত্তরসূরিরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রতিবাদে মেতে ওঠে চায় রক্তক্ষয়ী অনুরাগে চাঁদের শতক গড়তে। কেননা যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা নিষ্ঠুরতাকে জয় করে সমাজের রুদ্ধদ্বার ভেঙ্গে কঠিন সত্যকে গ্রহণ করে তবে তারা পেতে পারে মুক্তি। এই সমাজগত সত্যের প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুখর তসলিমা নাসরিনের কবিতা। যে সমাজে নারী অসহায় ভোগ পণ্য হিসেবে স্বীকৃত, যৌন সামগ্রী হিসেবে চিহ্নিত সে সমাজে নারীর সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করা অনেকটা কঠিন। নারী শিক্ষা গ্রহণ করছে অথচ শিক্ষিত হচ্ছে না, নারী উপার্জন করছে অথচ আত্মনির্ভরশীল হতে পারছে না। অধিকাংশ নারীই পুরুষতন্ত্রের বাহক। তারা ভয় পায় নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে। তারা মেনে নিতে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। তাই কোন ব্যতিক্রমী নারীকণ্ঠ যখন স্বাধীনতার কথা বলে, সম্মান  মর্যাদার লড়াইয়ের কথা বলে সেটাও এক ধরনের সমাজ বিপ্লব। তাই তসলিমা নাসরিন বিপ্লবী।


সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা পঙ্গু করে রেখেছে সমাজের দুর্বল অংশ নারীকে।সংসারে শুধু ভাত-কাপড়ের সংস্থার নয়- নারী চায় অন্যকিছু সেটা বুঝতে চায় না সামাজিক পুরুষ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ।স্বামীর শারীরিক মানসিক নির্যাতন সহ্য করে নারীকে ঘর করতে হয় নিরুপায় অক্ষমতায় কেননা দাম্পত্যের বন্ধন ছিন্ন করার মতো ক্ষমতা নেই নারীর কাছে। নারীর নির্যাতন সভ্যতার মর্মমূলে যে তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা জাগায় সেই জিজ্ঞাসাকে জাতির সামনে স্পষ্ট করেছেন কবি তসলিমা নাসরিন।


একথা অস্বীকার করতে পারি না যে আজও নারীর স্বাধীনতা মর্যাদা অধিকার পদে পদে বিঘ্নিত হচ্ছে ধর্মীয় ও সামাজিক আইন ও সামাজিক বিধানের মাধ্যমে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীকে হতে হয় বৈষম্যের শিকার। তাছাড়া সদর অন্দরের বিভাজনে নারীকে অন্দরের বাসিন্দা বলে মনে করে নারীর সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। সমাজের বৈষম্যময় স্বীকৃত বিধানের বিরুদ্ধে তসলিমার সোচ্চারতা,-
"পুরুষের জন্য অধিকারের ব্যবস্থা হয়েছে, পুরুষের কথা বলার,... স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকার। নারীর জন্য রয়েছে দায়িত্বের ব্যবস্থা, সংসার সামলানো, পুরুষকে সুখ স্বস্তি  দেওয়া, সন্তান উৎপাদন করা। সন্তানাদি লালন-পালনের দায়িত্ব।"
পুরুষের মতো যদি নারীকে সমাজের সমান প্রাধান্য দেওয়া হয় তাহলে সমাজ নষ্ট হবে- সভ্যতার সর্বনাশ হবে- এটাই সাধারণত পুরুষতন্ত্রের ধারণা। এই সামাজিক ধারণার বিরুদ্ধাচারী তসলিমার কন্ঠে তাই আমরা শুনতে পাই,-
"সমস্ত পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে আমি লড়ছি না। আমি কেবল সমাজের নষ্ট নিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছি যে নিয়ম নারীকে দাসী করে, পণ্য করে, যৌন সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করে নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেওয়ার জন্য সমাজ রাষ্ট্র ও ধর্মের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করছি। আমি যখন লিখি আমি কাঁদি ঐ সুফিয়া খাতুন এর জন্য যাকে ধর্ষণ করে জ্যান্ত পুঁতে ফেলেছে কিছু লোক, কাঁদি ফরিদার জন্য যে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে পাড়ার এক ছেলে তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। মাকিনীবানুর জন্য যার বাবা বিয়েতে যৌতুক দিতে পারেনি বলে স্বামী তাকে মেরে হাত-পা ভেঙ্গে তালাক দিয়েছে। শরিফা খাতুন এর জন্য যাকে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে দা দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে স্বামী। কাঁদি নুরজাহানের জন্য যে মেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলেছে বলে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলেছে লোকেরা, ফুলমতির জন্য যে মেয়েকে প্রেম করার অপরাধে লোকেরা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে।"


নারীবাদী রচনা আমরা অনেকেই অনেক পড়েছি। কিন্তু তা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তসলিমা নাসরিনের অনন্যতা হল প্রতিদিনের মুহূর্তগুলি,প্রতিমুহূর্তের অভিজ্ঞতা গুলি সঞ্চিত তার লেখনীতে। নারী মনের দুঃখ যন্ত্রণা এই বেদনাবিদ্ধ হৃদয়কে তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে- প্রতিবাদী হয়েছেন ধর্ম বিধান ও সামাজিক আচরণের। বড় যন্ত্রণা ময় এই প্রতিবাদ।


কবি তসলিমা নাসরিন মনে করেন আমাদের দেশে সীতা,সাবিত্রী,বেহুলা, দ্রৌপদী প্রমুখ সতী নারীদের দিন শেষ। যে দেশে, যে সমাজে এবং যে জলবায়ুতে তিনি মানুষ হয়েছেন,সেই সমাজ সম্পর্কে তার দুঃখ অনেক। তিনি মাঝে মাঝেই বলেন- তাঁর ধর্মাবলম্বীতে একজন রামমোহন ও একজন বিদ্যাসাগরের মতো মহান ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করা আবশ্যক। শুধু হিন্দু সমাজেই নয়, সমস্ত নারী জাতি আজ তাদের অনেক অধিকার পেয়েছে এই দুই মনীষীর দ্বারা। তাই তিনি তাঁদেরকে শ্রদ্ধা জানান। তসলিমা নাসরিন মনে করেন- হিন্দু সমাজে নারীরা যতটুকু স্বাধীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নারীরা সে তুলনায় অনেক বেশি পরাধীন।


(এ প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে নারী ও পুরুষ একই আল্লাহর দুই শারীরিক রূপ সুতরাং এদের মধ্যে তেমন মৌলিক পার্থক্য নেই। কোরআনে 'আল নিসা' অধ্যায়ে বলা হয়েছে,তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন জোড়া। নারীর প্রতি সমস্ত বৈষম্যের সমাপ্তি ঘোষণা করে কুরআনে বলা হয়েছে-" আমি তোমাদের মধ্যে কোন কর্মনিষ্ঠ পুরুষ ও নারীর কর্ম বিফল করিনা। তোমরা পরস্পর সমান।" ইসলামে এই ধারণা বাতিল করা হয়েছে যে জন্মসূত্রে পুরুষ হওয়ার জন্য পুরুষ  শ্রেষ্ঠ আর নারী নিকৃষ্ট।)


মুহূর্তের সেই বেড়াজালে অস্থির হয়ে তিনি লেখেন- প্রতিবাদের কবিতা, বেদনার কবিতা, ঘৃণার কবিতা, লজ্জার কবিতা, ব্যাঙ্গের কবিতা, অপমানের কবিতা ইত্যাদি। তিনি মনে করেন পুরুষ ভোগী, ধর্ষক,অত্যাচারী এবং শাসক। নারী হয়ে তিনি পুরুষতন্ত্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছিলেন বলেই আজ দেশান্তরী। তাইতো তসলিমা নাসরিন বাংলা সাহিত্যে চিহ্নিত হয়ে আছেন নারীবাদী কবি, কামুক কবি ইত্যাদি বিশেষণে।


তসলিমা নাসরিনের প্রতিটি শিল্প কর্মেই নারীজাতির কথা উঠে এসেছে। তিনি মনে করেন নারী সব সময় নির্যাতিতা। নারীর কোন দেশ নেই। সব দেশে নারী সমান দুঃখে দুঃখি। নারী কবিতায় আমরা দেখতে পাই তিনি উল্লেখ করেছেন " আমার দেশের নারী গলিত শবের মতো নর্মদায় ভাসে।" তা আসলে তসলিমা নাসরিনের দেশের নারী নয়, তা প্রকৃতপক্ষে সমস্ত নারী জাতিকেই চিহ্নিত করে।  'সুইজারল্যান্ডের মেয়ে' কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন সুইজারল্যান্ডের মেয়েরাও আমাদের দেশের নারীর মতোই একই রকম দুরবস্থার শিকার। তাই তিনি বলে ওঠেন 'নারী ছাড়া কেউ নেই নারীকে বাঁচায়'।
তসলিমা নাসরিন 'নারী' নামে অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন, এমনকি প্রতিটি কবিতাতেই নারীর স্বপ্নভঙ্গের কথাই যেন ফুটে ওঠে-
"অবুঝ কিশোরী মেয়ে,স্বপ্ন সাধ ভাঙ্গে তার,দুঃখে বাঁধে বুক এরকম বুঝি হয়, পৃথিবীর এরকমই নিয়ম-কানুন।"
কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে এক কুমারী কন্যার বিবাহের দিন থেকে তার সংসার জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিকথা। বিবাহের দিন যে মেয়েটি অজানা সুখের ভয়ে আত্মহারা, তার কি হবে এ কথা ভাবতে ভাবতে নীলাভ শরীরে কাঁপন দেখা দিয়েছে। অবশেষে স্বামীর সঙ্গে সহবাসের ফলে বিয়ের রাতেই শরীরের নিষিদ্ধ অশোক বাসা বেঁধে ফেলে এবং যথাসময়ে জন্ম দেয় বিকলাঙ্গ শিশু। পদে পদে অত্যাচারিত হয় সেই নারী। এখানেই তসলিমা নাসরিনের প্রশ্ন,তা-ই কি আসলে নারীর ভাগ্য?
তসলিমা নাসরিন মনে করেন পুরুষেরা নারীকে অনেক ব্যাপারেই অশ্লীল করে তোলে। নারী পতিতা হওয়ার পেছনে পুরুষ সম্প্রদায়ই দায়ী। রাস্তা-ঘাটে,অফিস-আদালত, বাসে-ট্রামে সব স্থানেই  নারীকে শ্লীলতাহানির শিকার হতে হয়। এমনকি নারী পণ্যদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। যে কিশোরী মেয়েটি ভালোবেসে প্রেমিকের হাত ধরে সবকিছু  জলাঞ্জলি দিয়ে দেশান্তরিত হয় তার প্রেমিকের সঙ্গে, সে একদিন মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায় শহরের নিষিদ্ধ পল্লীতে। নারীর জীবন তার নিজের হলেও এ জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ অধিকার পুরুষের। বিবাহের পর স্বামী ইচ্ছে করলেই যখন তখন -মুখে থুথু, গালে চড়, সময়ে অসময়ে যৌনতার শিকার, ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দেওয়া, ঘরে আবদ্ধ করে রাখা, চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলা সবকিছু করতে পারে। কিন্তু নারী তার পরিবর্তে পুরুষের জন্য মঙ্গল কামনা করে, জীবন বলিদান দেয়। নারীরকে সর্বদাই তার সতীত্ব প্রমান  দিতে হয়।  তাইতো 'শুভ বিবাহ' কবিতায় কবির কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই--
"যেন তাকে ভালবেসে গলে যায় সোনালী মোমের মতো
কোনও পুরুষের দেখে দু'চোখ না তুলে
আজীবন যেন দেই  সতীত্ব প্রমাণ।"


তসলিমা নাসরিন পুরুষের ভালোবাসার পেছনে যৌনতাকেই আবিষ্কার করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হৃদয়কে অস্ত্র করে 'লজ্জাবতী' নারীকে খুলে খুলে দেখে, উপভোগ করে।  বাস্তবিক নারীর শরীরই যখন পুরুষের কাম্য তখন পুরুষ দু'হাতে নারীর 'স্তনগুচ্ছ' ছুঁবে। তাছাড়া 'ঠোঁট  বা নিভাঁজ নগ্নতা', 'নিটোল নিতম্ব', ইত্যাদির বাইরে নারীর মধ্যে পুরুষেরা আর কিছু খুঁজে পায়না। তাই নারীকে স্পর্শ করে হৃদয় বিহীন শরীরটাই খুঁজে পায়। তবুও 'সনদপত্র' মেলে ধরে পুরুষ খুঁজে বেড়ায় নারীর সতীত্ব। তসলিমা ব্যঙ্গের কশাঘাতে প্রশ্ন করেন:
" সতীত্ব কাহাকে বলে?
আমি এর সংজ্ঞা চাই, সতীত্ব কাহার নাম, আমি এর রক্ত পুঁজ ঘেঁটে ত্বক ছিঁড়ে, সুখদ মাংসের কাঁচা স্বাদ পেতে চাই।"
কবি তসলিমা নাসরিন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পুরুষ চালাকির মাধ্যমে 'সতীত্ব' নামক অলংকারে নারীকে বন্দী করে রাখে। আসলে নারীর জীবনে 'সতীত্ব' একটা মস্ত অভিশাপ। পুরুষ সর্বদা দোষ করলেও,অনেক অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকলেও তাদেরকে 'সতীত্ব' নামক কোন রসাল শব্দের গন্ডিতে দাঁড়াতে হয় না, কারন পুরুষরা ভদ্রলোক। তসলিমা নাসরিন বলেন 'পুরুষদের জন্য সতীত্বের সনদ লাগে না "।


পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শুধু নারীকেই কুৎসা বাচক শব্দ দ্বারা বিদ্ধ করে অনেক ক্ষেত্রে আলাদা করে রাখা হয়েছে। নারীর ক্ষেত্রে এরকম একটি ব্যবহৃত শব্দ 'বেশ্যা বা পতিতা'। যাদের পেশা পুরুষের যৌন ক্ষুধা মেটানো। এই নারীদেরকে বেশ্যায় পরিণত করার পেছনে যারা দায়ী তারাই পুরুষ। তসলিমা নাসরিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ্যা সতী নারী থেকে পৃথক নয়,তবুও সামাজিক মানুষ বেশ্যাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। বেশ্যার মূলকাজ পুরুষের সেবা করা, যে বেশ্যা পুরুষের ইন্দ্রিয় সুখের কারণ তাকে সমাজে চলতে গেলে নানা রকম অপমানসূচক বাক্যের শিকার হতে হয়। তাকে দেখলেই সমাজ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে ওই 'বেশ্যা যায়'। তসলিমা বেশ্যাকে দেখেন মানুষের মতো। তারাও আমাদের মত মানুষ। তাদেরকে মানুষ বলতে চায় না পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, কারণ তারা নারী। 'বেশ্যা যায়' কবিতায় তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনই নারীকে মানুষ বলে স্বীকার করতে চায় না--
" যে কারণে নারী বেশ্যা হয়, যে সংসর্গে
একই সংসর্গে অভ্যস্ত বয়ে  পুরুষ পুরুষই  থাকে।
বেশ্যারা পুরুষ নয়,মানুষের মতো অথচ মানুষ নয় তারা নারী।


তসলিমা যে সমাজে বড় হয়েছেন সেখানে সুলেখার মতাে মেয়েরা স্কুলে পা দেবার সঙ্গে
সঙ্গে তাকে আপাদমস্তক বােরখায় ঢেকে ফেলতে হয়। তাই তার চুল উড়ে না; কিন্তু তার
‘গা-গতর বাড়ে’, ‘চুল বেড়ে নিতম্বে গড়ায়, তার স্তন হয় বুকে। পুরুষ শাসিত সমাজ
নারীর মুখমণ্ডল ঢাকার জন্য পর্দা প্রথার নিয়ম বানিয়েছে, তাই নারীকে বােরখার আড়ালে
থাকতে হয়। এমন কি নারী তার অধিকার পর্যন্ত আদায় করতে সাহস পায় না, কারণ তার
বাক্‌রােধ করা হয়েছে। নারী অসুস্থ হলেও পুরুষ ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিষেধ। তাই
তসলিমা ব্যঙ্গ করে বলেন— নারীকে খাঁচাই বাঁচায়। নারীর জোরে হাসা নিষেধ, জোরে কথা
বলা নিষেধ, পুরুষের সঙ্গে মেশা নিষেধ, একা ঘর থেকে বেরােনাে নিষেধ এবং আরও অনেক
নিষেধ মানতে হয় তাদেরকে।


কুমারী নারী প্রাপ্ত বয়স্ক হলে বারবার তাকে পণ্য দ্রব্যের মতাে পুরুষের সামনে উপস্থিত
হতে হয়। কারণ তার বিয়ে হবে, তাই বিভিন্ন পুরুষ এসে সেই নারীকে পরখ করে জিজ্ঞেস
করে— সে রান্না জানে কি না, সে লজ্জাবতী কি না, গান জানে কি না এবং আরও নানা
ব্যাপার। মেয়েটিকে দোকানে বাজারজাত সামগ্রির মতাে হেঁটে দেখাতে হয়, চুল খুলে দেখাতে
হয়, দাঁত দেখাতে হয় ইত্যাদি। মেয়েটির সব ভালাে লাগলেও তার গায়ের রঙ কালাে বলে
কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি নয়। কিন্তু যে যুবক পুরুষেরা মেয়েটিকে দেখতে আসে, তাদের
কেউ কালাে, কেউ গুণহীন, কেউ রােজগারহীন এবং কেউ আরও অযােগ্য। অবশেষে মেয়েটিকে
যেদিন একাধিক পুরুষ মিলে ধর্ষণ করল তখন কেউ তার রূপ দেখল না। তারপর কোনাে
মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে থেকে যায় গণ্ডগােল। এর মূলে— পণ। মেয়ের বিয়েতে পণ
দিতে সমীরণ মণ্ডলের মতাে পিতা চাষের জমি বিক্রি করেন; তাতেও যখন হয় না তখন
বাড়ি-ঘর বিক্রি করতে হয় এবং অবশেষে পরে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করেন।
তারপর মেয়েটির বিবাহিত জীবনে শুরু হয় অত্যাচার। উঠতে বসতে তাকে গা এবং মার।
খেতে হয়। এদিকে বকেয়া পণের জন্য চলে মানসিক নির্যাতন। পণ দিতে দেরি দেখে স্বামী তার স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে। এতে নিরুপায় কন্যার পিতা হাহাকার করা ছাড়া আর কোনাে
পথ খুঁজে পান না। তাই পুরুষ জাতের প্রতি তসলিমার লেখনি আক্রমণাত্মক। শেষ পর্যন্ত
তিনি 'পারো তো ধর্ষণ করো' কবিতায় নারীকে উপদেশ দেন—
“লােকে বলবে, ছি ছি, বলুক।
লােকে বলবে এমন কি নির্যাতিতা নারীরাও যে তুমি মন্দ পুরুষের মতােই
বলুক, বলুক যে এ তাে কোনও সমাধান নয়, বলুক যে তুমি তাে তবে ভাল নও
বলুক, কিছুতে কান দিয়াে না, তােমার ভাল হওয়ার দরকার নেই,
শত সহস্র বছর তুমি ভাল ছিলে, মেয়ে, এবার একচু মন্দ হও।”


এভাবেই তার কথায় বার বার
উচ্চারিত হয়েছে ক্রোধ, প্রতিবাদ ও বেদনার নানা সুর যা তাকে উপশম দেয় আশার চন্দন
প্রলেপ। একজন দেশান্তরী নারী এর থেকে বেশি কি-ই বা করতে পারেন।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
মমতাজ বেগম মহাশয়া ও কুমার বিষ্ণুচন্দ্র দে মহাশয়ের রচনা থেকে তথ্য সংগ্রহ।