বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক যুগ এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে যে সাহিত্যিক জাগরণ শুরু হয়েছিল, তা কেবল একটি ভাষার পরিবর্তন নয়—বরং একটি জাতির মানসিকতার রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি। এই পরিবর্তন ও নবচিন্তার ধারায় মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

১. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬)

তিনি বাংলা সাহিত্যে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে খ্যাত। তাঁর কবিতা ও গান ছিল শোষণবিরোধী, সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার ধারক। “বিদ্রোহী”, “চক্রবাক”, “সানাই” প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতি ও প্রতিবাদী চেতনাকে একাকার করেছেন।
🔸 "ত্রি ভূবনে প্রিয় মুহাম্মদ / আমার কলিজার চেয়ে প্রিয় দুজাহানের বাদশা,মানবতার মুক্তির দূত,শান্তির বাহক আল্লাহর হাবিব,হজরত নূর নবিজী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর শান গাওয়া হয়েছে।"

২. আল মাহমুদ (১৯৩৬–২০১৯)

আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। গ্রামীণ জীবন, প্রেম, ধর্ম ও রাজনীতি তাঁর কবিতায় অনন্যভাবে উঠে এসেছে। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “সোনালী কাবিন” বাংলা কাব্যের এক মাইলফলক।
🔸 তিনি ভাষার দার্শনিক সৌন্দর্যকে এক ভিন্ন মাত্রা দেন।

৩. শামসুর রাহমান (১৯২৯–২০০৬)

নগরজীবন, গণতন্ত্র ও মানবতা তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। ষাটের দশকে তিনি নাগরিক কবিতার অন্যতম কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। “ধূসর সময়”, “বীর পুরুষ” সহ বহু কবিতায় তিনি সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন।

৪. সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫–২০১৬)

একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। তাঁর “নিষিদ্ধ লোবান”, “নীল দংশন” এবং “স্মৃতি ও স্বপ্নের শহর” প্রভৃতি কাব্য ও উপন্যাসে গভীর দার্শনিকতা ও মনস্তত্ত্ব প্রতিফলিত হয়।

৫. হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮–২০১২)

তিনি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। “হিমু”, “মিসির আলি”, “শুভ্র” ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি তরুণ প্রজন্মের হৃদয় জয় করেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস “আগুনের পরশমণি” এবং মানবজীবনের টানাপোড়েনভিত্তিক বহু উপন্যাস তাঁর সৃষ্টি।

৬. আহমদ ছফা (১৯৪৩–২০০১)

একজন দার্শনিকচিন্তক, প্রাবন্ধিক ও লেখক হিসেবে পরিচিত। তাঁর “আত্মজীবনী”, “যদ্যপি আমার গুরু” গ্রন্থগুলো আমাদের সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে।

৭. সেলিনা হোসেন (জ. ১৯৪৭)

বাংলাদেশের প্রথম সারির নারী লেখক। তাঁর উপন্যাস “হাঙর নদী গ্রেনেড” মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। নারী, সমাজ ও সংস্কৃতির সংঘাত তাঁর সাহিত্যের মূল বিষয়।

৮. আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮–১৯৭৯)

বাংলা ব্যঙ্গ-সাহিত্যে তাঁর তুলনা বিরল। “আয়না”, “ফুড কনফারেন্স”, “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” তাঁর বিখ্যাত রচনা। তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ব্যবহার করেছেন।

৯. হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯–২০২১)

তিনি ছোটগল্প ও উপন্যাসে সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, বাস্তবতা ও অস্তিত্বের সংকট তুলে ধরেন। তাঁর “আত্মজা ও একটি করবী গাছ” পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

১০. আনিসুজ্জামান (১৯৩৭–২০২০)

তিনি একজন প্রথিতযশা গবেষক, প্রাবন্ধিক ও ভাষা-সংগ্রামী। সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণধর্মী রচনা আমাদের সাহিত্যচিন্তাকে সমৃদ্ধ করছে।


আধুনিক বাংলা সাহিত্য শুধু কবিতা কিংবা উপন্যাসের সীমায় আবদ্ধ নয়; এটি একটি চলমান ইতিহাস, যেখানে মুসলিম সাহিত্যিকগণ সময়, সমাজ ও আত্মার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। তাঁদের লেখায় ধর্ম, প্রেম, বিদ্রোহ, মানবতা, দেশপ্রেম, স্মৃতি ও সংস্কৃতি চিরকাল বেঁচে থাকবে।