এক রাতে আষাঢ়ে মেঘ এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাটোপ দিলো। পরদিন দুপুরের মেইল ট্রেনে বুবুও হোস্টেল থেকে ফিরলেন। মা রোয়াকে ধবধবে সাদা কাপড়ে শুয়ে ছিলেন। ঠিক যেন আঙিনাজুড়ে একটুকরো দলছুট শরত মেঘ। মা হয়েছিলেন প্রশস্ত একখন্ড আলো, কিছুটা অপার্থীব।
  
এর মাঝে মাতবর চাচা এসে জানালেন এক বুড়ো কড়ই ডাল ভেঙে গিয়ে ত্রেপল টানানো কবর খোঁড়ার কাজ ভেস্তে দিয়েছে। “কবরভরা এখন পানি, শুধু পানি। কিছু আছে বাসায়?”


কিছুটা পরেই এক কালো দাড়কাক রান্নাঘরে এসে কান্না জুড়েছে। “কা কা কা কা”। মা ওটাকে রোজ দুপুরে খাবার দিতেন। আমি কাক তাড়িয়ে একটা বালতি নিয়ে মাতবর চাচার সাথে পুকুরের ধারে এগুই। পুকুরে মাছের ঘাই, পানি তার বাড়ছে ক্রমাগত। পশ্চিম ধারে সাত পুরুষ শুয়ে আছে এক জীর্ণ কড়ই গাছের নিচে। গিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই। কবরের কাদাপানিতে একটা ব্যাঙ কাটছে ডুবসাঁতার।  


সন্ধ্যে নাগাদ তৈরী হলো এক নতুন ঘর। ভিজে জবজবে। সাত পুরুষ পেলো এক নতুন সঙ্গী। আবার কোন নিচ্ছিদ্র এক জোসনা রাতে কড়ই তলে হবে যখন আলোর সমাহার, তখন আমিও আসবো গল্প শুনতে। জোনাকীর আলো আর সতেজ ঘাস তখনো থাকবে এই পুকুরপাড়ে?  


আমি ভাবি হাসগুলো কি আর খোঁয়াড়ে ঢুকবে আজ। “আ চই চই চই চই আ আহ”। আজ পেয়েছে তাদের শামুকের নেশা।    

কেন যে আজ আধার ঘনিয়েছে সময়ের আগেই। হু হু করে বুবু কাদে বা বাতাস বয়। আদ্র পৃথিবীতে সবই অনিশ্চিত। অথচ ভেবেছিলাম এই রাতে বাতাবি লেবু, ডিমসেদ্ধ, আর পোড়া মরিচের ডাল খাবো। উনুনও ভিজে কাক।  


নিশাস্বপ্নে দেখি মা কাফন জড়িয়েই কবর থেকে উঠে এলেন। গুটিগুটি পায়ে (যেরকম হাটেন সর্বদা)  রান্নাঘরে গিয়ে কিছু খুঁজছেন, এই ছড়ান সংসারের এখানেই হবে ইতি? “কাক কই গেলো? কই? কই?” স্বপ্ন ভেঙে গেলে পাই বুবুর চুলে বাসমতি নারকেলের ঘ্রান। বাইরে আষাঢ় আরো ঘন হয়।


অবশেষে পরিত্যক্ত হাঁসের খোজে মধ্যরাতে পুকুর নামি আমি, সাতার কেটে ভাবি কোথায় মাঝপুকুর। হাসগুলো সব কই? সাতপুরুষের ভিটে কিন্তু এর তল কেউ কেন ছোয়নি কখনো। এক বুড়ো কালিবাউশ ঘাই মারে কনকনে শীত ফিরে এলে।  


ভোররাতেই বুবু ফিরে যায় ট্রেন ধরে আবার হোস্টেলে। তখন মনে পড়ে বুবু ঠিক আমার বুবুতো নয়, আমার মা ঠিক বুবুর মাও নয়। তবু বুবুর চুলের ঘ্রান রয়ে যায় খোদাই করা আবলুসের মতো।  


তখনো বৃষ্টি, আরো সমুদ্দুর। এক আষাঢ়ে ঘুমের নেশা আমাকে জড়িয়ে ধরে, আষ্টেপৃষ্টে। একা কাক এসে ডাকে অযথাই উঠোনজুড়ে। হাসগুলো এখনো ফিরে পাইনি। মাতবর চাচার হাক শোনা যায় দুরবর্তী গ্রামে। “পানিগো পানি, পানি, তেতুলিয়া জাগছে আবার”।