শুরুতে, ২০১১ সাল থেকে  এ পর্যন্ত বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে উথ্থাপিত সমালোচনাগুলো একটু দেখে নেয়া যাক। বিশেষকরে কিছু কবি-সাহিত্যিক, কিছু অনলাইন পত্রিকা এবং সোশাল মিডিয়ায় আলোচিত মূল বিষয় মোটামুটি তিনটি, সেগুলো হলো:
১. ইংরেজি সাহিত্যকে ঢাকা লিট ফেস্টের মাধ্যমে প্রমোট করা হচ্ছে এবং
২. এই আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের ভাষা শহীদদের অবমাননা করা হচ্ছে!
৩. এই ফেস্ট আয়োজনের আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা নেই!


সবাই কমবেশি অবগত আছেন, ঢাকা লিটের‌্যারি ফেস্টিভ্যাল, সংক্ষেপে ঢাকা লিট ফেস্ট, একটি সাহিত্য উৎসব যা প্রতিবছর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে। আন্তর্জাতিক ভাবধারার এই সাহিত্য আয়োজন যা ইতিমধ্যে দেশ এবং আন্তর্জাতিক উভয় পরিমণ্ডলে বেশ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রবন্ধটির শিরোনাম বিবেচনায় এই আয়োজনটিকে কেন সহযোগিতা করা, এর পরিসর বৃদ্ধি  এবং প্রমোট করা প্রয়োজন- তা উত্থাপিত সমালোচনাগুলোর  যৌক্তিক উত্তর খুঁজলেই স্পট হবে।


প্রথম সমালোচনা- "ইংরেজি বা ভিনদেশি সাহিত্যকে প্রমোট বা উপনিবেশ সংস্কৃতি জিইয়ে রাখার প্রয়াসে এই ফেস্ট আয়োজিত হয়" এই অভিযোগটি আসলেই অগ্রহণযোগ্য! শুরুতে যখন  এই ফেস্ট এর নাম "হে ফেস্টিভাল" ছিলো তখনই মূলত এই বিতর্কেরও শুরু, কারন ইংল্যান্ড এই নাম একটি সাহিত্য আয়োজন করা হয়। তবে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে ঢাকা লিস্ট ফেস্ট হওয়াতে বিশ্বের বুকে কিন্তু এটি বাংলাদেশকে উপাস্থাপন করছে। নামকরণ বিতর্ক থেকে এটি মুক্তি পেলেও এখনও এর বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক ঠিকই আছে! এর কারন হলো- অনেক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বোদ্ধা মনে করেন এই ফেস্টিভ্যালে অংশ নেন যারা তারা তাদের স্টলগুলোতে ইংরেজি ভাষার এবং ভিনদেশি লেখকদের বই বা প্রকাশনা রাখেন ও সেগুলো বিপনন করেন, আলোচনা অনুষ্ঠানসমূহে বিদেশি লেখক বক্তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়-  এভাবেই ভিনদেশি সাহিত্য বা ইংরেজি সাহিত্যকে প্রমোট করা হচ্ছে! কিন্তু এই ব্যাপারটিও আসলে ভিন্নভাবে দেখা উচিত। কারন এখন বৈশ্বিক সমাজ ব্যবস্থা পুরো পৃথিবী একটি গ্রাম, এবং কয়েক বছরের মধ্যে এই গ্রাম আরো ছোট হয়ে আসবে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে, এমনকি কয়েক দশকের মধ্যে এই পৃথিবী  পুরোপুরি ভার্চুয়াল বাস্তবতায় প্রবেশ করবে, যাহোক এসব ভবিষ্যত বিজ্ঞান চিন্তা! আসলে, এই আয়োজনের মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে না, বরং ইংরেজি সাহিত্যের সাথে আমাদের মেলবন্ধন ঘটাতে সহায়তা করা হচ্ছে, ভিনদেশি লেখকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে। যদি কেউ বলে এটিরও দরকার নেই- তা স্রেফ মূর্খতা। কারন এই আয়োজন যদি নাও করা হয় পাঠকেরা কিন্তু  অনলাইন বা অফলাইন যেভাবেই হোক ভালো লেখকদের বই সমূহ, জনপ্রিয় বইসমূহ সংগ্রহ করবে, তা ইংরেজি বা  যে ভাষার সাহিত্যই হোক। তার চেয়ে কি এটি ভালো নয়- সরাসরি ভিনদেশি বা স্বদেশি লেখকদের সাথে একটু দেখা সাক্ষাতের আয়োজন করা, ভিন্নভাষায়  বা নিজের ভাষায় অন্যদের সাথে ভাবের আদান প্রদান বা কাগজের বইয়ের একটু উৎসবমুখর কেনাকাটা? অবশ্যই এই কাজগুলি ভালো কাজ অন্তত কিছু না করার চেয়ে বা ঘরে বসে বসে কল্পনায়  বাংলা সাহিত্যের বিশ্বজয়ের চিন্তা করার চেয়ে! কারন বাংলা সাহিত্যের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে দেশি এবং বিদেশি সবার সাথেই কাজ করতে হবে সাহিত্য নিয়ে।


দ্বিতীয় সমালোচনা হলো- "এই আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা হচ্ছে" এটি মূলত একটি ভুল ব্যাখ্যা।  ভাষা শহীদদের স্মরণে আমরা পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে আয়োজন করি অমর একুশে গ্রন্থমেলা।এছাড়া তাদের স্মরণে বা একুশের চেতনায় বা বাংলা ভাষার প্রসারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান, মেলা, ইত্যাদি আয়োজিত হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙনে। সুতরাং এই একটি বিশেষ আয়োজন,  এই লিট ফেস্ট একুশের চেতনা বা ভাষা শহীদদের জন্য মোটেই অবমাননাকর হবার কথা নয়! আমাদের ভাষা শহীদদের চাওয়া বা একুশের চেতনা কখনই এই আয়োজনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং সহযোগী। কারন বাংলাদেশের সাহিত্য এবং বাংলা ভাষা দুটোই এই আয়োজনের মাধ্যমে বিস্তৃত বিশ্বায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। আমাদের সাহিত্য নিয়ে ভিনদেশি লেখকদের ও পাঠকদের আগ্রহ বাড়াতে ঢাকা লিস্ট ফেস্ট ভুমিকা পালন করতে পারে। আমাদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়সমুহ ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার সুযোগ রয়েছে এই ফেস্টিভালের সৌজন্যে। বলতে পারেন এই কাজটিও একুশের চেতনার পরিপন্থী! কিন্তু না। আমরা যদি শুধুই বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করি বা বই প্রকাশ করি তাহলে কি করে বিশ্বজুড়ে বাংলা সাহিত্যের জয়গান আশা করতে পারি? বিশ্বে কত শতাংশ মানুষ বাংলা সাহিত্য পড়ে? তাই ভিন্ন ভাষার পাঠক ও লেখকদের আমাদের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করতে হলে প্রথমে বাংলা সাহিত্যকে এমন আয়োজনের মাধ্যমে পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন করতে হবে, তাদের সহিত্যের মান এবং বিষয়বস্তু বুঝতে হবে তারপর আমাদের সাহিত্যকে তাদের পাঠের উপযোগী করে অনুবাদ করতে হবে। এভাবেই প্রথমত ইংরেজি ভাষায় বাংলা সাহিত্যকে উপস্থাপন করে তাদের মধ্যে  আমাদের সাহিত্য এবং ভাষার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। এটি করতে পারলে তারাই পরবর্তীতে আমাদের ভাষা শিখতে আগ্রহী এবং আমাদের সাহিত্যকে তাদের ভাষায় তারাই অনুবাদ করবে বা বাংলা ভাষা শেখার মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির রস আস্বাদন করবে। কিন্তু আমরা যদি কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় আমাদের সাহিত্যকর্ম সীমাবদ্ধ করে রাখি তাহলে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবো বিশ্বসাহিত্য জগত থেকে। এটি কি একুশের আত্মত্যাগের লক্ষ্য হতে পরে না, বরং বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ও  বাংলা ভাষার বিস্তৃত বিশ্বায়নই লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ঢাকা লিট ফেস্ট এর আয়োজন ভাষা শহিদদের অবমাননা নয় উল্টো এটি তাদের স্বপ্নকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস।


তৃতীয় সমালোচনাটির উত্তর মোটামুটিভাবে পূর্বের  দুটো থেকে অনেকটা স্পষ্ট। তবুও বলা যেতে পারে- ঢাকা লিট ফেস্ট একটি অপ্রয়োজনীয় আয়োজন এর স্বপক্ষে যুক্তি কি? একটিই যুক্তি থাকতে পারে তা হলো- পরীশিলিত ভাবে বললে  "সংরক্ষণশীলতা" আর সাধারণভাবে বললে "কুপমণ্ডুকতা"। কারন হলো তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কোন পাঠকের পড়াশুনা করার কোন সীমান্ত নেই, কোন সাহিত্যেরও কোন ভৌগলিক সীমারেখা নেই! আমরা আমাদের পাঠকদের শুধু বাংলা সাহিত্য মগ্ন রাখতে পারব না। তারা শেক্সপিয়র পড়ে, তারা মায়া এঞ্জেলো পড়ে, তারা পিটার হ্যান্ডকে পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। নীলখেতে গেলেই দেখতে পারেন ইংরেজি বই বা ইংরেজি বইয়ে অনুবাদ কেমন চলে! কিন্তু বিশ্বব্যাপী বাংলা কমিউনিটি এর বাইরে কি কোথাও বাংলা বই বিক্রি হয়? এ থেকে বোঝা যায় বিশ্ব সাহিত্যে আমাদের অবস্থান বা ভিন্ন ভাষা ভাষীদের কাছে আমাদের সাহিত্যকর্ম বা সাহিত্যকদের আবেদন কতটুকু! এই সমস্যাটি উত্তরণ করে, সারা বিশ্বেরবুকে আমাদের সাহিত্যের আবেদনময়তা কি বাড়ানো উচিত নয়?  কিভাবে বাড়াবেন? আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের সমালোচনা করে! ভুল চিন্তা, বরং দেশে বা বিদেশে  বেশি বেশি এমন আয়োজন করা উচিত। যাতে করে তারা আমাদের জানতে, পড়তে আগ্রহী হয়। আমরা তাদের সাহিত্য পড়ব, তারা আমাদের সাহিত্য পড়বে- সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা দুটোতে অংশগ্রহণ করে আমাদের সাহিত্যের মুকুট অর্জন করতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে কোন অর্জন আসবে না।


পরিশেষে বলতে চাই, বাংলা সাহিত্যকে এবং আমাদের কবি-লেখকদের  বিশ্বব্যাপী সমসাময়িক সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একটি নির্ভরযোগ্য আয়োজন হতে পারে  ঢাকা লিট ফেস্ট। বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার প্রসার ও বাংলা সাহিত্যের বিস্তারে এই আয়োজনটি  ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং  অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর মধুরতম সুফল ভোগ করবো। একটু রসিকতার ছলে বলা যায়- "আমরা ওদের চা পান করি, ওরা আমাদের চা পান করুক, পরে আমাদের চায়ের স্বাদ বেশি হলে- ওরা আমাদের চায়ের জন্য  চেঁচাবে!"  সুতরাং, ঢাকা লিট ফেস্ট এর সমালোচনা নয়, সহযোগিতা করুন।
‐------------------