হে কবি --
মানব সভ্যতার আজ ভয়ানক অসুখ।
বড়ই ভয়ানক।
সীমাহীন বিপন্নতা আজ পৃথিবীর দিকে দিকে,
জীবনের সমস্ত ছন্দই আজ বড় এলোমেলো,
আশঙ্কার ঘন কালো মেঘ ক্রমশ জমাট বাঁধছে
পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে.....একটু একটু করে।
একটু একটু করে আমরাও এগিয়ে চলেছি মহাপ্রস্থানের পথে।
এখনো ঘুমিয়ে আছো কবি একাকী এ কোন নিভৃতবাসে !
জেগে ওঠো, চেয়ে দ্যাখো --
খোলা আকাশের নিচে আজ আমরা অসীমের যাত্রী।
দাসত্ব আজ আমাদের নিত্যসঙ্গী।
আজ আমাদের দেহে অবিশ্রাম ক্ষুধার চাবুক।
শুনতে পাচ্ছো না ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না !
দেখতে পাচ্ছো না রাষ্ট্রশক্তির রেলের চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া
পরিযায়ী শ্রমিকের লাশ !
উপলব্ধি করতে পারছো না
বিপন্ন-নিরন্ন মানুষের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কৈশোর !
অথচ ওরা আজ কত উদাসীন !


হে কবি --
ওরা হিসেব করছে আজ মৃত্যুর।
টিভির পর্দায়, ইন্টারনেটে গোনা হচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
জানি, আমাদের মৃত্যুর হিসাব কোথাও লেখা থাকবে না।
আমাদের ছবিও ছাপা হবে না কোনওদিন
আধুনিক ভারতবর্ষের কোনো সংবাদপত্রে।
চিত্রাবতীর ধূসর বালুচরে
আমাদের জ্বলন্ত চিতার পাশে দাঁড়িয়ে
দুফোঁটা চোখের জলও ফেলবেনা কেউ কোনওদিন।
শহর থেকে অনেক অনেক দূরে চিত্রাবতী চড়ে
আমাদের জন্য থাকবে শুধু সন্তানহারা পিতার বুকভরা কান্না।
বিস্মৃতির কোনো এক অতল সমুদ্রে তাও হয়তো হারিয়ে যাবে
কোনো এক মায়াবী দুঃসময়ে !
কারণ দাসত্ব যে আমাদের দিনলিপি !
হাওয়াই চটি পরে হাওয়াই জাহাজে চড়ার স্বপ্ন
আমাদের মানায় না।
তাই ওদের জন্য বরাদ্দ থাকে
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত উড়োজাহাজের নরম আসনগুলো,
আর আমাদের জন্য পরে থাকে
অন্তহীন এক পথ চলা....।


হে কবি --
মনুষ্যত্বের এই ঘোর অপমানে
এখনো ঘুমিয়ে থাকবে অনন্ত নিভৃতবাসে !
হাজার বছরের নিস্তব্দতা ভেঙে জেগে ওঠো।
হাজার বছরের নীরবতা ফেলে ফিরে আসো।
ভেঙে দাও বিভেদের প্রাচীর ,
খুলে দাও ওদের ব্যাভিচারের মুখোশ
যারা জীবনকে শুধু লাভ-লোকসানের খাতায় হিসাব করে ,
ভেঙে দাও ওদের চোখে লাগানো উদাসীনতার চশমা ,
ওরা বুঝুক --
অসহায় নিপীড়িত মানুষ গুলো সমাজের বোঝা নয়, সম্পদ।
ওরা জানুক --
নগরে-বন্দরে, পথে-প্রান্তরে, কোদাল-শাবল-গাঁইতি হাতে
মেহনতি মানুষ গুলোই বয়ে নিয়ে চলে সভত্যার রথ।
যুগ-যুগান্ত ধরে।
সেই মানব সভ্যতার আজ ভয়ানক অসুখ।
বড়ই ভয়ানক।


হে কবি --
তুমি তো সমগ্র পৃথিবীর।
ঘুমিয়ে থাকা তোমার কি শোভা পায়!
তোমার আদর্শ জন-গণ-মন-ভারতবর্ষ।
তোমার মুক্তধারা ঐক্যের বার্তা বহন করে আনবে
সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে।
মানুষ খুঁজে পাবে মুক্ত জীবনের ছন্দ।
তোমার মন্ত্র মৃত্যু পথযাত্রীদের উত্তরণের পথ দেখাবে।
তোমার দর্শন সমগ্র বিশ্বকে পাখির এক নীড়ে পরিণত করার।
তোমার কাছেই শিখেছি --
জীবনের প্রয়োজনে একলা চলার মন্ত্র।
তাই কি বিপ্লব, কি যুদ্ধ, কি মহামারী,
মানব সভ্যতার এই সংকটে
আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরাই থাকবো তোমার সাথে।
আমরা সেই খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের দল।
জানি আমাদের জন্য বাজবে না কোনো পবিত্র ঘন্টাধ্বনি,
আমাদের জন্য জ্বলবে না কোনো মঙ্গলময় আলোকশিখা,
অভিনন্দনের কোনো পুষ্পবৃষ্টিও কোনওদিন বর্ষিত হবে না
আমাদের মাথায়।
তবুও জানি তুমি আছো আমাদের সাথে।
আমাদের জীবনে,
আমাদের মরনে,
আমাদের শয়নে.....স্বপনে।
তাই আজ মিলিয়ে আসা আলোর পথে
রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকি শুধু তোমারই প্রতীক্ষায়।
ফিরে এস তুমি।
ফিরে এস কবি।
ফিরে এস এই পৃথিবীর বুকে।
আরো একটি বার।
শুধু একটি বার।