শ্বাস যতক্ষণ... ততক্ষণই, আমি প্রাসঙ্গিক। সূর্য ডুবে গেলে অন্ধকার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে,ক্রমে। চাঁদ, তারা    কথা বলে তখন। সূর্যের কথা আর তখন বলা বা, শোনা হয়েও ওঠে না।


রবীন্দ্রনাথ সেই কবে চলে  গেছেন।  তাই তাঁর  প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। তাঁর বলে   যাওয়া কথাগুলো আজও চলনসই কি না, ভেবে দেখার দরকার আছে বইকি! পর্যালোচনা করে, যাচাই করে, দেখার প্রয়োজন, কথাগুলোর প্রাসঙ্গিক সারবত্তাও।    


আজ যখন ব্যক্তিপরিসরে কিংবা সামাজিক বৃত্তে, এমনকি দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা পৃথিবীর  পরিমণ্ডল জুড়ে  হিংসা, বিভেদ  মাথাচাড়া দিয়ে  উঠছে-ক্রমশ অমানবিক উদগ্র স্পৃহা উচ্চকণ্ঠে  কোলাহল করে মুখরিত করছে চারপাশ-যখন  মিথ্যার দাপটে সত্য সিঁটিয়ে রয়েছে ঘরের এককোণে-তখন  তাঁর অমোঘ বাণী “চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির,”-ই তো আমাদের শক্তি যোগাবে, সাহস দেবে।      


যন্ত্রনির্ভর একবিংশ শতাব্দী। যন্ত্র অনুষঙ্গ যত বাড়ছে ততই ব্যক্তি মানুষ সাহচর্যহীন হচ্ছে। হচ্ছে বন্ধুবিহীন নির্বান্ধব। নিঃসঙ্গ একাকিত্বের অনুভব দীর্ণ করছে আমাদের, সবসময়। মানুষ বলেই সে সঙ্গ  চায়। চায়  অবলম্বন। রবীন্দ্রগানের কথকতায় যেন উন্মুক্ত আকাশকে কাছে পাই, বুকের শূন্যস্থান পূরণে।  নিজের সবটুকু    সমর্পণ  করে, উজাড় করে,  নিশ্চিন্ত,  ভারমুক্ত হতে পারি। আনন্দে-দুঃখে-শোকে,  রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের পরম বন্ধু, প্রাণসখা, শেষ আশ্রয়, অবলম্বন, আজও।      


কিছু ভাবনা থাকে সমকাল থেকে অনেকটা এগিয়ে-কালোত্তীর্ণ। কিছু ভাবনা আবার সবসময়ের জন্যেই সত্য-চিরন্তন। রবীন্দ্র ভাবনায় ঠিক তেমনটাই খুঁজে পাই। মননে চিন্তনে যা সর্বাধুনিক। তাঁর     “রক্তকরবী”, “ডাকঘর” আজও মনকে নাড়া দিয়ে যায়, সমানভাবে। “কাবুলিওয়ালা”, “পোষ্টমাস্টার”  যেন আমাদের চারপাশে আজও জীবন্ত, একইভাবে।  


জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেককাল আগে। তবু, উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া  ভূমিহীন, গৃহহীনের সেই আর্তি  “এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি-/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি”-  এ কান্না, হাহাকারের এ ভাষা, কেড়ে নেওয়ার এই অমানবিক প্রক্রিয়া আজও জারি রয়েছে যে, সমান নির্মম  ভাবে।  


চিরন্তন কথকতায় তিনি যা শুনিয়েছেন, তা আজও সমানভাবে সত্য। সর্বকালীন। হানাহানি নয়,   প্রতিশোধ নয়, ভালবাসার মন্ত্রে শুধু মানবধর্ম পালনই, স্থান পেয়েছে তাঁর ভাবনায়।  ক্ষমাধর্মের জয়গান   ধ্বনিত হয়েছে বারবার, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি  তাদের ক্ষমা  করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?”


“রথ ভাবে আমি দেব/ পথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব/ হাসে অন্তর্যামী”- ধুমধামের ঢক্কানিনাদের মাঝে লোকারণ্যে হারিয়ে যাওয়া অন্তরের এমন আন্তরিক সাধন পূজন যে আজও বড়ো প্রয়োজন।  


“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি  শিশিরবিন্দু”- তাঁর মতো এমন ভ্রামণিক আর কেই বা আছেন। নিজের নিকটতমের প্রতি এমন নিগুঢ় নিরীক্ষণ আর কেই বা দেখতে সক্ষম হয়েছেন!


অন্ধকার জীবনপথে পথ হারিয়ে গেলে তিনিই আমাদের সঠিক পথের দিশা দেখান আজও; ধ্রুবতারার মতো ধীর স্থির নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে!    


শ্বাসবায়ু যেমন সঞ্জীবনী শক্তি যুগিয়ে দেহকে রেখেছে সদা প্রাণময়, গতিশীল; রবীন্দ্রনাথ তেমন করে, ছিলেন–আছেন-থাকবেন, জীবনভর... আজীবন। তবে, বাইরের চোখ দিয়ে দেখা যায় না, সে মহান শক্তির অপার মহিমা! শুধু, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝে নিতে হয়, সে শক্তির প্রকৃত স্বরূপ, প্রতি শ্বাসের অনুভবে...