কবি রফিক আজাদের কাব্যগ্রন্থ ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজ’। এটি প্রকাশ হয় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। আমি তার এই বইটি পড়তে গিয়ে দেখলাম বইতে একটা কবিতা আছে শিরোনাম ‘ভাতদে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’। এই কবিতাটি অবলম্বনে সরকারী পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় ‘ভাতদে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’ ক্যাপসন শিরোনামে বিজ্ঞাপন চিত্রে কার্টুন ছবিতে কংকালসার শোয়া এক লোক হাতে একটা খাবার বাটি তাতে লেখা ছিল -আল্লাহ আমারে ভাতের খোয়াব দেখা। বিজ্ঞাপনের ছবিটি এঁকেছেন বিচিত্রা’র আর্টিস্ট লুৎফুল হক। পত্রিকার সম্পাদক ছিল শাহাদাত হোসেন। আমি (শেখ সামসুল হক) তখন ‘সাপ্তাহিক আমাদের কথা’য় কাজ করি। ‘সাপ্তাহিক আমাদের কথা’র সম্পাদক ফকির আমির হোসেন। বিচিত্রার এই ছবিটা দেখে আমি ‘আমাদের কথা’য় একটা ফিচার লিখি যা ছাপা হয় ১৯ শে এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে। ছবিটা এমন ভাবে আঁকা একাত্তর যুদ্ধ পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের ছবি এত নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তখন দুর্ভিক্ষে প্রচুর মানুষ মারা যায়। ২০ তারিখ ১৯৭৪ সালে অর্থাৎ সাপ্তাহিক আমাদের কথায় ১৯শে এপ্রিলে লেখা প্রকাশ হওয়া সংখ্যা মওলানা ভাসানীর পল্টনের জনসভায় পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। পরে ২০ এপ্রিল রাতেই এই পত্রিকার সম্পাদক ফকির আমির হোসেনকে চোখ বেঁধে রক্ষী বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। অফিস উলট পালট করে পত্রিকার সব কপি নিয়ে যায়। পরদিন আমি অফিসে গিয়ে শুনলাম সব ঘটনা। আমি সম্পাদকের বাসায় ফোন দিলাম। তখন বললো ফকির আমির হোসেন সাহেব আমাকে গা ঢাকা দিয়ে পলাতক থাকতে বলেছেন। আর মামলা হয়েছে কবি রফিক আজাদ, ফকির আমির হোসেন, আমি (শেখ সামসুল হক), শাহাদাত হোসেন ও লুৎফুল হকের নামে।


কোর্টে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করা হলো ফকির আমির হোসেন ছাড়া অন্য সকলের নামেই। সবাই তখন পলাতক। এদিকে মামলা পরবর্তীতে সূত্রাপুর থানা ঢাকার থাকার জায়গা এবং ফরিদপুর থানা আমার গ্রামের বাড়ী তল্লাশী করে পায় নাই। বাড়ী থেকে বলে দিয়েছে ২ বছর ধরে নিখোঁজ জানিনা কোথায় আছে। আগষ্ট ১৯৭৪ সালে ফকির আমির হোসেন জামিনে মুক্তি পেলো। মামলা চলতে থাকলো। কবি রফিক আজাদের সম্মন্ধী রক্ষীবাহিনী প্রধান ডেপুটি চীফ আনোয়ারুল আলম শহিদ। তিনি রফিক আজাদের মামলা উইড্রো করায় সহযোগিতা করলেন। রফিক আজাদ মুক্তি পেলো। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত হোসেন ও আঁকিয়ে লুৎফুল হক বিচিত্রা সরকারী পত্রিকার সরকারী লোক হিসাবে তারা দুজনে মুক্তি পেলো। শুধু আমার কোনো ব্যবস্থা হলো না। আমি তখন ছোটগল্পকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মির্জা আবদুল হাইর সাথে দেখা করে সব বললাম। তিনি তখন ওনার বন্ধু স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব জনাব জামসেদ আলীকে ফোন করে আমার বিষয়টা দেখার অনুরোধ জানালেন। আমি গিয়ে দেখা করলাম। তিনি আমাকে বললেন আপনি মামলা প্রত্যাহারের একটা আবেদন করেন। আমি পরামর্শ মতো মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানালাম। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব নাসিম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন উর্দুভাষী। একবর্ণও বাংলা বলতে বা লিখতে জানতেন না। তিনি আমার আবেদনের উপর লিখে দিলেন Discuss। তখন জামসেদ আলী বললো ঠিক আছে চেষ্টা করতেছি। চেষ্টা করতে করতে এভাবে দিনের পর দিন যায় আলাপ হয় কি-না জানিনা। আমার কাজের অগ্রগতি নেই। আমি প্রতি সপ্তাহে একবার সচিবালয়ে হাই সাহেবের সাথে দেখা করি। তিনি তার বন্ধু জামসেদ সাহেবকে ফোন করেন। এভাবেই বছর গড়িয়ে যায়। তখন আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসার তবারক হোসেনকে ধরলাম। তবারক হোসেনের ফুটবল খেলার প্রচুর নেশা ছিল। আমার সাংবাদিক বন্ধু বান্ধবরা সৌজন্য টিকেট পেতো। আমি সেই টিকেট সংগ্রহ করে তবারক হোসেনকে দিতাম। এভাবে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললাম। কী লিখবে বা লিখলে আমার পক্ষে কাজ হবে সে সব পরামর্শ করতাম তবারক সাহেবের সাথে। এদিকে হলে এসে পড়াশুনাতো আছেই। অন্যদিকে মামলার টেনশন। ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে আমার ফাইল সেই নাসিম সাহেবের টেবিলেই পড়ে আছে। এদিকে হাই সাহেবের ফোনে মির্জা জামসেদ আলীকে বললো আপনি নাসিম সাহেবের কাছ থেকে ফাইলটি চেয়ে নিয়ে আসেন। তখন তিনি এক পর্যায়ে নাসিম সাহেবকে বলে ফাইলটি চেয়ে এনে নিজের কাছে রাখলেন। আর ফাইলে নোট লিখে দিল সেই সেকশন অফিসার তবারক হোসেন সাহেব। তিনি লিখে দিলেন- এই মামলায় প্রথম অপরাধী কবি রফিক আজাদ। তিনি এ রকম কবিতাটি লিখেছেন। না লিখলে তো এটা হতো না। দ্বিতীয় অপরাধী সরকারী পত্রিকা বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত হোসেন তিনি এটা ছাপলেন। আবার কবিতার থিম অবলম্বনে বিচিত্রার আঁকিয়ে লুৎফুল হক কার্টুন ব্যঙ্গচিত্র আঁকলেন। তিনি তৃতীয় অপরাধী। আর চতুর্থ অপরাধী হচ্ছে শেখ সামসুল হক তিনি এই বিজ্ঞাপন চিত্র দেখে ফিচার লেখেন। ৫ম অপরাধী হচ্ছে সাপ্তাহিক আমাদের কথার সম্পাদক ফকির আমির হোসেন। তিনি না দেখে কেনো এমন লেখা ছাপালেন। আর শেখ সামসুল হক ফিচার লিখে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের নজরে দিলেন এবং সচেতন হবার দৃষ্টি আর্কষণ করলেন। এটাতো তার অপরাধ হয় নাই। তাহলে তাকে মামলা থেকে প্রত্যাহার করার বিষয়ে বিবেচনায় নেয়া যায়। এই জাতীয় লেখা লিখলেন। এই নোট দেয়ার পর আরো ১ মাস জামসেদ সাহেব নাসিম সাহেবের বিভিন্ন ব্যস্ততার কারনে দিতে পারলেন না। এভাবে দেরী হতে লাগলো ৭৬ সালের শেষের দিকে ফাইল সিএমএস আদালতে গেলো সেখান থেকে ওয়ারেন্ট প্রত্যাহারের জন্য প্রথমে সূত্রাপুর পরে ফরিদপুর থানায় রি-কল পাঠানো হলো। তারপর নিস্কৃতি পাওয়া গেলো।