'মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে  উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি  সেই দিন হব শান্ত!”


অসুস্থ হওযার পূর্ব পর্যন্ত যিনি এই নীতিতেই অটল ছিলেন, তিনিই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১১ই জৈষ্ঠ, ১৪২২ বঙ্গাব্দ, ১১৭ বছর পূর্বের এই দিনে (২৫ মে, ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ) আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।


কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ  নির্বিশেষে, বিশেষ করে শোষিত মানুষের মুখপাত্র। তিনি কখনও শোষক শ্রেণীর তাবেদারী করেন নি। এটাই ছিল কবির জীবনের সব চাইতে বড় বৈশিষ্ট। দুঃখকে সঙ্গী করেই তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাই তো তাঁর শৈশবের আরেক নাম ছিল দুখু মিয়া, তাই বলে তাঁর কর্মে তিনি দরিদ্র বা গরিব ছিলেন, সেটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও তাঁর সাহিত্য কর্মের উজ্জলতা, রাজনীতিতে সুবিধাবাদী শ্রেণীর কাতারে যোগ না দেয়া, জাতীয়তাবাদী চেতনার ঝান্ডাকে উড্ডীন রাখার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তিনি এ উপমহাদেশের একজন উজ্জল নক্ষত্র।


এ উপমহামেশের বিশেষ করে বাংলা ভাষা-ভাষীদের মাঝে কৃষক, শ্রমিক, সাহিত্যসেবী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, সবাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যখন তাঁকে নিয়ে কথা বলেন, সবাই তাঁকে আপনজন বলতেই গর্ব বোধ করেন। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি কখনও সম্মান বা সুযোগ-সুবিধার পিছনে দৌড়ান নাই। যা সত্য ও ন্যায়ানুগ ভেবেছেন তাই সবার সামনে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। যেটাকে অসুন্দর ও অন্যায় ভেবেছেন সেটার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছেন। তিনি কখনও কোন বিশেষ গন্ডীতে আবদ্ধ থাকেন নাই। এমন কি তিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই পর্যন্ত করেছেন। শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধমে তাদের সাহস যুগিয়েছেন। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে আবার আন্দোলনে ও শামিল হয়েছেন।


তিনি ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারকে কখনও প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে এদেশের মানুষের মুক্তির কথাও ভাবতেন। জ্ঞান-গরিমায় তিনি আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্ত ছিলেন। তিনি অনগ্রসর ও বঞ্চিত মানুষকে আপন জনের মত করে ভাল বাসতে পারতেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিশীল অবদান তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। আজকের বাংলাদেশ তাঁর জন্মস্থান না হলেও এ দেশ ছিল তাঁর পছন্দের চারণক্ষেত্র। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালে তাঁর শৈশবের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামের আলী আকবর খানের বোন নার্গিসকে বিয়ে করে ঘর জামাই থাকার শর্ত মানতে না পেরে বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল ইসলাম খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই স্ত্রীর গর্ভেই তাঁর সন্তানদের জন্ম হয়।


তাঁর সৃষ্টিশীল সাহিত্য সাধনা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, করেছে সমাজকে গতিশীল ও শিক্ষাকে করেছে জীবন ঘনিষ্ঠ। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, গজল, কীর্তন, প্রবন্ধ কোন বিষয়ই তাঁর লেখনীর বাইরে ছিল না। তিনি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। তাঁর লেখনীর মাঝে শিশুদের জীবন গঠন ও তাদের আনন্দের খোরাকেরও কোন কমতি ছিল না। তিনি আমাদের জন্য যা করে গেছেন বা রেখে গেছেন, যে কারণেই হোক আমরা তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারিনি, এ ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিৎ।


তারপরও আমরা ভাগ্যবান এই কারণে যে, ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত আমরা তাঁকে আমাদের মাঝে পেয়েছি।  কবি তাঁর একটি গানে লিখেছেন, 'মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই', কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁকে সেখানেই সমাহিত করা  হয়।


তাঁর জানাজা নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের  মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী(উদ্যান) ময়দান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান। বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ্যে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।


আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।