বিশ্বব্যাংক পৃথিবীর মানুষকে একটি গ্রাফ
একে বুঝিয়ে দেন
অর্থনৈতিক শ্রেনীবিন্যাস, সামাজিক-অর্থনৈতিক স্তরায়ন।


গ্রাফ রেখা ধরেই শুরু হয়
প্রতিটি জন্ম নেয়া নুতন শিশুর জীবন রেখা।
পরিবারগুলো মরিয়া হয়ে গ্রাফ রেখা অনুসরন করে
গ্রাফ রেখা বরাবরই চলতে শেখানো হয়
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।


আমরা সবাই
জীবনের কাছে পরাজিত হলেও, কিচ্ছু মনে করি না
তবুও, গ্রাফ রেখার উচুতে যেতে চাই;
গ্রাফের রেখাই আমাদের জীবনের ধ্যান জ্ঞান,
আমাদের শিক্ষা, আমাদের জীবন, আমাদের জন্ম-মৃত্যু,
সবই গ্রাফের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এমনকি
আমাদের সম্পর্কগুলোও গ্রাফের নীচে চাপা পড়ে প্রতিনিয়ত।


বিশ্বব্যাংক যেখানে গ্রাফের সর্বনিম্নে রেখা টেনেছেন
নিম্নবিত্ত হিসেবে;
সেখানেই জন্মেছিলেন, আমার দাদা
তিনি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন গ্রাফের সর্বনিম্ন সীমা ছুইয়ে দিয়েই।
আমার বাবার জীবনও শুরু হয়েছিল
সেই রেখাতেই।


বাবা দীর্ঘদিন নিম্নবিত্তের রেখাতেই ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন
অনেক শখ ছিল;
নিম্নবিত্তের রেখা অতিক্রম করে, নিম্ন-মধ্যবিত্তের রেখাতে পৌঁছাবেন।
অনেক ধার দেনা করে, জীবনের শ্রম বন্ধক রেখে
নারায়নগঞ্জ, কাশিপুর গ্রামে
পৈতৃক ভিটায় একতলা দালান ওঠালেন, বাবা;
যদিও বাবা মায়ের তখন জীবনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থ।
বুকের পাজর ভেঙ্গে
সাত সন্তানকে জীবনের গ্রাফ রেখার আরেকটু উপঢ়ে ঠেলে দেবার
কি প্রানান্তকরন প্রচেষ্টা!!!


ঈশ্বরের কৃপায়
বাবাও একদিন সুযোগ পেয়ে গেলেন
নিম্ন-মধ্যবিত্তের রেখা অতিক্রম করে মধ্যবিত্তের রেখা বরাবর ছুটে চলার;
আরব দেশে চাকুরীর সুবাদে
আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম
বিশ্বব্যাংকের সেই অংকিত মধ্যবিত্ত রেখার লেজে।


মধ্যবিত্তের লেজে পা দেয়া মাত্রই
চারদিকে ওতপেতে থাকা সর্পকূলদের
দংশনে দংশনে আমাদের জীবন বিপন্নপ্রায়।
অবশেষে, জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই
শহরমুখী যাত্রা,
এবার গ্রাফের নিম্নমুখী পতন
মধ্যবিত্ত থেকে একটু নেমে গিয়ে
মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্তের মাঝামাঝি অবস্থান।


বাবা মা, দীর্ঘদিন
গ্রাফ রেখার উত্থান পতনের জীবন্তসাক্ষী ছিলেন;
বলা যেতে পারে,
পুরো জীবন ধরেই গ্রাফ রেখার এই মশকরা সয়েছেন নীরবে।
মায়ের চৌকষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আর
জীবনের কাছে হার না মানা এক লড়াকু অদম্য শক্তি
আবারো আমাদের গ্রাফের মধ্যবিত্ত রেখায় স্থায়ী জায়গা করে দেয়।


এবার শুরু হয়
পরের প্রজন্মের গ্রাফ রেখার লড়াই;
বাবা মা এর বড় সন্তান অর্থাৎ বড় ভাই
এরই মধ্যে গ্রাফের সর্বোচ্চ চূড়া, মানে উচ্চ বিত্তের রেখা ছূয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের শ্রেনী বিন্যাস রেখাকে
আমি “অহমিকা রেখা” বলি;
তিনি সেই রেখা স্পর্শ করেছেন, কোনপ্রকার অহমিকাবোধ ছাড়াই।
বিশ্বব্যাংকের জন্মের শহরের পাশেই বসবাস করছেন।
এরই মধ্যেই এক সন্তান
উচ্চবিত্তের রেখাকেও ছাড়িয়ে গেছেন, নিজ গুনে
অন্যরা এখনো, মধ্যবিত্ত রেখাতেই গড়াগড়ি খাচ্ছেন।
বোধকরি আরো একপ্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে।


বাবা মা মধ্যবিত্তের রেখাতেই
তাদের জীবনের সমাপ্তি টেনেছেন;
সন্তানদের গ্রাফ রেখার উপরের যাবার সম্ভাবনাও এঁকেছেন।
অবশেষে, ফিরে গেছেন যেখান থেকে
গ্রাফ রেখার সাথে লড়াইটা শুরু করেছিলেন, চিরশান্তিতে ঘুমোচ্ছেন।


আমি মাঝে মাঝেই
বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যাই;
তাদের লড়াই স্থানটার সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকি;
পলস্টার খসে পড়া দেয়াল থেকে ভেসে আসে
মান্নাদে, হেমন্ত, সতিনাথ আর রবীন্দ্রনাথের সুর।


আমরা তখনো বিশ্বব্যাংকের গ্রাফ রেখার সাথে
খুব একটা পরিচিত ছিলাম না।
শেষ বিকেলে, সেই একতলা দালানের বারান্দার গ্রীলে
মাথা ঠেকিয়ে
আমাদের সময় কাটতো “মান্নাদে”র সাথে।
বিশ্বব্যাংক আমাদের সব ভুলিয়ে দিয়েছে;
গ্রাফের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ভুল শিক্ষাটা শিখিয়েছে।


ফিরে আসি
ইট কাঠ নগর সভ্যতায়; ঢাকা শহরে
বাবা মা এর সাথে সেদিনের মতো শেষ দেখা হয়, কাশিপুর কবরস্থানে;
তাদের পাজরের পাটাতনে তৈরি দালানের ভগ্নদশার খবর দেই
তারা ভীষনভাবে কষ্ট পান


তাদের কষ্টের রঙ গায়ে মেখে
আমি যাত্রা শুরু করি ঢাকার উদ্দেশ্যে......


জানুয়ারি ২৫, ২০২৩, রাত ৮টা
মিরপুর, ঢাকা


(নোটঃ কবি রশিদ হারুন এর ‘একটি সাদা কবিতার থীম অবলম্বনে লেখা এই কবিতা)