আলোচনা  ১৮২


বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে সবচেয়ে প্রাচীন। ধর্ম তাত্তিকদের মতানুসারে, আদি পিতা মাতা অর্থাৎ আদম (আঃ) এবং বিবি হাওয়া (আঃ) এর মাধ্যমে বিয়ে এবং পরিবার প্রথার প্রচলন শুরু হয় যদিও নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী কিংবা প্রত্নতাত্তিকদের এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান বিয়ে এবং পরিবার, সেক্ষেত্রে খুব একটা দ্বিমত নেই।


আলোচ্য কবিতা “আজব বিয়ে”, কবি এম এ মাসুদ রানা, সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে তার কাব্য রচনা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশে দুজন নারীর বিয়ে বেশ আলোচিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ রাষ্ট্র যন্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনায় জড়িয়ে পরেছেন। সে কারনে, কবি মাসুদ রানাও সমসাময়িক ইস্যুতে কাব্যের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। সাধারনত যে কোন সমসাময়িক ইস্যুতে, কোন দিবসকে কেদ্র করে (যেমন-মা দিবস, নারী দিবস, বিজয় দিবস) কিংবা কোন ঐতিহাসিক গুরুত্তপূর্ন দিনকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচিত হয়ে থাকে। আলোচ্য কবিতাটিও সেরকম একটি বিষয়। তাত্ত্বিক বিতর্ককে সামনে নিয়ে আসার জন্যই কবিতাটি আলোচনার জন্য বাছাই করা হয়েছে।


কবিতার শিরোনাম “আজব বিয়ে”, অর্থাৎ কবি “আজব” শব্দটি যোগ করে একটি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আমরা সাধারনত প্রচলিত ধ্যান ধারনার বাইরের কিছু দেখলে বা শুনলে, দীর্ঘদিনের অভ্যাসের বাইরের কিছু হলে কিংবা ধর্মতাত্তিক বিশ্বাসের ভিন্ন কোন বিষয় খুব সহজে গ্রহন করতে পারি না, বিতর্কে জড়িয়ে পরি কিংবা সচেতনভাবে বিতর্কে না জড়িয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে থাকি। কবিতার আলোচ্য ইস্যু বিয়ে এবং সমকামীতা। সচরাচর ধারনায় বিয়ে বলতে আমরা যা বুঝি বা যেভাবে আমাদের সামাজীকিকরন করা হয়েছে, আলোচ্য বিয়েটি সে ধারার বাইরে অর্থাৎ দুজন নারীয় মধ্যকার বিয়ে যা সমকামীতাকে নির্দেশনা দেয়। সমকামীতা কে আমরা গ্রহন করবো নাকি বর্জন করবো, সেটা নিয়েই মূলত বিস্ময় প্রকাশ।


আমি যখন বিশববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম, একটি কোর্স, “সংস্কৃতি, অন্য সংস্কৃতি এবং ভিন্ন সংস্কৃতি” এর অধীনে আমি একটি এস্যাইনমেন্ট করেছিলাম “সংস্কৃতি ভিন্নতায় বিয়েঃ গতানুকতিকতা এবং বহুমাত্রিকতা”। সেখানে পৃথীবির তাবৎ সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যায়ন (আদিবাসী সংস্কৃতিসহ) করে, ২২  প্রকার বিয়ের প্রচলন বের করেছিলাম, তার মধ্যে হাতে গোনা দুয়েকটির সাথে আমাদের অল্প কিছু পরিচিতি আছে, বেশীর ভাগ বিয়ে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। সমকামী বিয়ে, তার মধ্যে একটি, সেখানে দুজন নারীর মধ্যে বিয়ে হয় কিন্তু একজন নারী স্ত্রী এবং অন্য নারী স্বামী হিসেবে গন্য হয়। স্বামীর (স্বামীর ভূমিকায় নারী) ইচ্ছেনুযায়ী স্ত্রী ( স্ত্রীর ভূমিকায় অন্য নারী) যে কোন পুরুষের সাথে সহবাস করতে বাধ্য হবে এবং সন্তান স্বামীর (স্বামীর ভূমিকায় নারী) বংশ মর্যাদা পাবে কিন্তু স্বামীর ভূমিকায় যে নারী থাকেন তিনি তার ইচ্ছেনুযায়ী যে কোন পুরুষের সাথে সহবাস করতে পারবেন এবং সেই সন্তানও তার বংশমর্যাদায় পরিচিত হবে। সেই সমাজে পুরুষের কোন বংশ নেই, পুরো বংশ মর্যাদাই নারীদের (স্বামীর ভূমিকায় নারী) এখতিয়ারে থাকে। তখনো আমিও খুব বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম !!


বাংলাদেশের ঘটনায় দুজন নারীর বিয়ে অর্থাৎ সমকামী বিয়ে কিন্তু এখানে প্রজন্মের ধারাবাহিকতা কিভাবে রক্ষা হবে তা জানি না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় আইনে সমকামী বিয়ে এখনো আইনি মর্যাদা লাভ করেনি। সারা বিশ্বে সমকামী বিয়েকে রাষ্ট্রিয়ে আইনে অন্তর্ভুক্তির জন্য আন্দোলন চলেছে, কোন কোন দেশ ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসলামী আইনে, সমকামী বিয়ে কোনভাবেই বৈধ নয়।


সমকামী বিয়ের বৈধতা নিয়ে নানা তাত্ত্বিক বিতর্ক জড়িয়ে পরছে, এখানে সেখানে নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিও আলোচিত হচ্ছে-উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মানবাধিকার দৃষ্টিভঙ্গি, নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি ইত্যাদি।


বিলকিস আর আঁখির বিয়ে কবি’র কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে, প্রচলিত ধারার বাইরের বিষয়কে মেনে নিতে পারেননি তাই পুরো কবিতা জুড়েই কিছু প্রশ্ন রেখেছে যার সমাধান নেই এ ধরনের সমকামী বিয়েতে।


দুজন নারীর মধ্যে বিয়ের বৈধতা দিলে প্রজন্মের ধারাবাহিকতা অব্যহত থাকবে কি করে? আবার উল্টোও হতে পারে, দুজন পুরুষের মধ্যে বিয়ে হলে, নারীর গর্ভ ছাড়া প্রজন্মের ধারাবাহিকতা কিভাবে রক্ষা হবে?


মেয়ে ছেলেই হলে বিয়ে বংশে প্রদীপ জ্বলে
বিলকিস আখির কি হবে, একটু যাও বলে।
বাবা হবে কে তারা শুনবে কি মায়ের ডাক?
হায়রে ভাবতে ভাবতে হয়ে যাচ্ছি অবাক।


দুজন নারীতেই যদি বিয়ে প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে তবে আর পুরুষের প্রয়োজনীয়তা কি?


এই সমাজে মেয়েই করেছে, মেয়েকে বিয়ে
কি করবে মেয়েরা আর এই ছেলে দিয়ে।


সমকামী বিয়ে ব্যবস্থাকেই কবি “আজব দুনিয়া” আমে আখ্যায়িত করেছেন-


আখির প্রেমে, বিলকিস আসলো বাড়ি
বিয়ে বলে নাকি করেছে, এই দুই নারী।
কি যে এক আজব শুনলে কথা ঘুরে মাথা
ফেসবুকে হলো পরিচয় ফোনে হয় কথায়।


সমকামী বিয়ে ব্যবস্থা যারা টিকিয়ে রাখতে চান, যারা মানবাধিকার বলে চেচামেচি করেন, তাদের কাছেও এর যথার্থ উত্তর নেই। ধর্মের বানী যদি উল্লেখ নাও করি, মাবন সভ্যতার প্রশ্নেই প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রশ্নের সঠিক সমাধান দরকার অন্যথায় প্রকৃতির সাথে যুদ্ধের ভয়াবহতা মানব সভ্যতাকেই সামাল দিতে হবে একদিন।


কবি’র জন্য রইলো শুভেচ্ছা।