আলোচনা ৬৮


দেশী এবং বিদেশী শব্দ দুটিই মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরির মূল কারিগর। মানুষ তার নিজের স্বত্বা হারায়, মানবতাবোধ নষ্ট করে এমনকি মানুষে মানুষের আত্মিক সম্পর্কগুলো নষ্ট হয় ‘দেশী’ এবং ‘বিদেশী’ শব্দের আড়ালে। আমাদের দ্বৈত চরিত্র প্রকাশিত হয়, নানা প্রলোভন তৈরি হয় কেবল এই শব্দ দুটির কারনে।  আমরা আত্ম পরিচয়ের গৌরবে, সংস্কৃতির অবগাহনে দেশী থাকতে চাই আবার নানামুখী সুবিধা পেতে কখনো কখনো বিদেশী হতে চাই। দেশী খাবার চাই বিদেশী প্রসাধন চাই, দেশী সুখ চাই আবার বিদেশী সুবিধে চাই ইত্যাদি।


কবি আর্যতীর্থ তার কবিত ‘বিদেশী’তে চমৎকার একটি বিষয় নিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নানা সংকট আর দ্বিধা গ্রস্ত মনের সমসাময়িক বাস্তবতা।  কোন একটি দেশে, দেশী কিংবা বিদেশী পরিচয়ের সাথে নানামুখি বিষয় জড়িয়ে পরে, দৈনন্দিন জীবনের সুবিধে ভোগ (দুধওয়ালা দুধ দেবে না, সবজিওয়ালা না বলে দেবে মুখের ওপর,হাসপাতাল শপিং মল বা শ্মশানঘাট, কেউ আসতে চাইবে না মানুষের সংস্রবে) থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব বিষয় সম্পর্কিত নানামুখি (চাকরি, বাসস্থান, জমি, স্কুল কলেজে ভর্তি) বিষয় জড়িয়ে পরে।


এই যেমন, এখন বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয় পত্র ছাড়া কোন কাজ হবে না (মোবাইল সিম কার্ড কেনা যাবে না, ব্যাংক একাউন্ত খোলা যাবে না ইত্যাদি) ফলে, জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকলে কিংবা হারিয়ে গেলে নানামুখী বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। নিজের পরিচয় একটি মুল্যবান সম্পদ, সেটি ছাড়া নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই খুব মুশকিল। ফলে মানুষ নিজের পরিচয় পত্র নিয়ে নানামুখী আতঙ্কে থাকা (হারিয়ে গেল কিনা, চুরি হতে পারে কিনা, যথেষ্ট মাত্রায় নিরাপত্তার সাথে পরিচয় পত্রটি রাখা হল কিনা ইত্যাদি)


কবি এরকম এক প্রেক্ষাপটে, আরও একটি চরম বাস্তবতা কিন্তু  দুর্বিষহ জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন। আদিবাসী (সাঁওতাল, কোল , ভীল, ওঁরাও) কিংবা দলিত কিংবা অন্য কোন পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী (বেদে, জিপ্সি) যাদের পরিচয় পত্র নিয়ে আরও ভিন্নমুখী জটিলতা তৈরি হয় যার পেছনে থাকে রাজনৈতিক নানা মারপ্যাচ আর সমীকরণ।  ফলে নিজ দেশে থেকেও, নিজ জন্মভুমিতে থাকেও ‘বিদেশী’ নামকরণ জূটে যেতে পারে, সে ধরনের আতঙ্ক আর এক মাত্রার বিভীষিকা তৈরি করে নাগরিক জীবনে।


কবিতার মুল বক্তব্য, খুব সাধারণ, দেশী বিদেশী নামকরণ এক চরম বাস্তবতা, তাকে মেনে নিয়েই কিভাবে আতঙ্কহীন নাগরিক জীবনধারা বের করতে পারি তা এখন সময়ের দাবী । চমৎকার এক বিষয় নিয়ে কাব্য রচনার জন্য কবির প্রতি রইলো অসীম শ্রদ্ধা এবং অভিবাদন।