আলোচনা  ১৬০


কবিতাটি বেশ করুন এবং বিষাদের, একইসাথে রাষ্ট্র যন্ত্রের ব্যর্থতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি তো বটেই। রাষ্ট্র ব্যবস্থা একই সাথে এক যুবককে সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে তার যোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়ে আবার জীবিকার জন্য সেই সার্টিফিকেটের বিপরীতে তাকে অযোগ্য ঘোষনা করতে পারে না। এটা রাষ্ট্র পরিচালকদের ব্যর্থতা, তাদের অযোগ্যতা এবং তাদের অপরিনামদর্শীতা।


কবি মাহমুদুর রহমান মানিক তার কাব্য “সার্টিফিকেট” এ দারুন এক চপেটাঘাত এর মাধ্যমে শুরু করছেন কাব্যটি “ সার্টিফিকে্টে চাপা পড়ে যুবকের মৃত্যু”।


সার্টিফিকেট ব্যবস্থা উদ্ভব হয়েছে, কাউকে কোন বিষয়ে তার যোগ্যতা, দক্ষতা বা পারদর্শিতা্র প্রমান হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠান বা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি দ্বারা প্রদানকৃত একটি কাগজ যেটা দেখে অন্য কেউ সন্দেহাতীতভাবে সেই ব্যক্তির যোগ্যতা, দক্ষতা বা পারদর্শিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে। এখানে সার্টিফিকেট প্রদানকৃত ব্যক্তির উপস্থিতির প্রয়োজন নেই কিংবা সার্টিফিকেটধারী ব্যক্তিকে কোন প্রকার সন্দেহের তালিকায় রাখার কোন সুযোগও নেই।


কিন্তু সমস্যা হলো, পুরো ব্যবস্থাই যখন ভেঙে পরে, সার্টিফিকেট প্রদানকারী এবং গ্রহনকারী উভয়ে কিংবা কোন এক পক্ষ যদি অসৎ হয়ে যায় তখন আর সিস্টেম কাজ করে না, একজনের প্রতি আর অন্য জনের কোন আস্থা থাকে না এবং এভাবে পুরো সিস্টেমটাই অকার্যকর একটা সিস্টেমে পরিনত হয়। আমার জানা মতে সির্টিফিকেট নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনাস্থা ইত্যাদি আমাদের দেশের কিংবা এশিয়ান সাব-কিন্টিনেটে যতোটা জোড়ালো, পশ্চিমা বিশ্বে কিংবা ইউরোপে এতোটা জোড়ালো না। কেননা, একপক্ষ অসৎ উপায়ে সার্টিফিকেট অর্জন করতে চাইলেও অন্যপক্ষ তা প্রদান করবে না কোনভাবেই, তাকে সব রকম পরীক্ষার মাধ্যমেই সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়। কিংবা সার্টিফিকেট প্রদানকারী পক্ষ অসৎভাবে সার্টিফিকেট প্রদানে কাউকে উৎসাহিত করলেও অন্য পক্ষ তা গ্রহন করবে না এবং সবার উপরে থাকে রাষ্ট্র যন্ত্রের সুক্ষ্ম নজরদারী ব্যবস্থা। সে সার্টিফিকেট একাডেমীক (শিক্ষাগত) বা ভোকেশনাল (ট্রেড সম্পর্কিত) বা কোন প্রশিক্ষন কিংবা অন্য যে কোন প্রকার দক্ষতা বা পারদর্শিতা সম্পর্কিতই হউক না কেন।


কিন্তু আমাদের দেশের সর্বত্রই বিরাজ করছে “সার্টিফিকেট ব্যবসা”, এখানে চুরি বিদ্যার মাধ্যমে পিএইচডি ডিগ্রী থেমে নিম্ন পর্যায়ের সকল একাডেমীক সার্টিফিকেট অর্জন করা যায়, টাকার বিনিময়ে সম্মান সূচক সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, তৈল মর্দনের মাধ্যমে দক্ষতা, পারদর্শিতা কিংবা যে কোন প্রকার যোগ্যতার সার্টিফিকেট পাওয়া যায় এমনকি, সাহিত্য শিল্পকলায়ও নানা রকম সার্টিফিকেট বানিজ্য চলে আজকাল। ফলে সার্টিফিকেট এর ভ্যালু আজকাল আর খুব একটা নেই। কিন্তু তারপরও নিয়ম রক্ষার্থে যে কোন কাজেই একটা সার্টিফিকেট দরকার হয়, সার্টিফিকেট হলে সমাজে একটু হলেও সম্মান বাড়ে ফলে মানুষ যে কোন উপায়েই একটা সার্টিফিকেট বাগিয়ে নিতে চায়। এখানেই সমস্যাটা আরো জোড়ালো হয়ে দাঁড়ায়, একদিকে সার্টিফিকেট নিয়ে চরম অবিশ্বাস, অনাস্থা আবার অন্যদিকে সার্টিফিকেট এর জন্য নানারকম অসততা, নানা রকমের আয়োজন। সার্টিফিকেট নিয়ে এরকম একটা দ্বন্দ্ব নিয়েই কাব্যটি লেখা হয়েছে যদিও অনেকটাই একপাক্ষিক হয়ে গেছে অর্থাৎ সার্টিফিকেট অর্জনকারীর পক্ষেই গীত গাওয়া হয়েছে। সার্টিফিকেট অর্জন করা এবং তার যথার্থ মূল্য না পাওয়া যেমন চরম বাস্তবতা অন্যপক্ষে যেন তেন ভাবে, কোন প্রকার দক্ষতা ছাড়াই ভুড়ি ভুড়ি সার্টিফিকেটধারি সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন চিত্র সচরাচরই দেখা যায়।


আবার, আমাদের দেশে, জীবনটাই শুরু হয় ভূয়া সার্টিফিকেটের মাধ্যমে। এদেশের প্রায় ৯৮% মানুষের জন্মতারিখ সঠিক না (আমাদের প্রজন্মের), ভূয়া সনদ, এ প্রজন্মের ইতিহাস আবার ভিন্ন রকম, ইচ্ছে করেই জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে বয়স কমানো হয়। জীবনের শুরু থেকে পদে পদে ভূয়া সার্টিফিকেট আমাদের জীবনের এক অবশ্যম্ভাবী অংশ, সবই একটা রাষ্ট্র যন্ত্রের অদক্ষতা এবং সার্বিক অপরিকল্পনার ফসল। এমনকি, এখানে জীবিত মানুষ তার মৃত্যু সনদও বানাতে পারে, কি আজব এক সিস্টেম!!!


একটা সত্য ঘটনা বল-
আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধ, বেশ অনেক বছর আগে (২০-২২ বছর), আমেরিকান এম্বেসীতে ভিসার জন্য বার বার দাড়াচ্ছিলো, প্রতিবারই কোন না কোন পেপারস এর জন্য ফেরত দিয়ে দেয়। শেষবার, উনি ভিসা কাউন্সিলর এর সাথে ইন্টারভিউ এ বলেছিলো, “তুমি যদি ভিসা দিতে না চাও তাহলে আমাকে বলে দাও, শুধু শুধু নানা রকম পেপার চেয়ে আমাকে আর হয়রানি করো না। বলেই, উনি ওনার ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়েছিলো, আমি যখন আমার ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে পেরেছি, সুতরাং যে কোন পেপার আমি তোমাকে দেখাতে পারবো, সুতরাং তুমি আর কোন পেপার চেও না। ডেথ সার্টিফিকেট দেখে, ভিসা কাউন্সিলর এর চোখ ছানাবড়া, এটা কি করে সম্ভব!! একজন জীবত ব্যক্তি তার ডেথ সার্টিফিকেট দেখাচ্ছে!!! ভিসা কাউন্সিলর আর কোন পেপার না চেয়ে তার ভিসা দিয়েছিলো, উনি এখন আমেরিকাতেই থাকে এবং আমেরিকার নাগরিক”


আলোচ্য কবিতায়, এক যুবক নানা রকম যোগ্যতার এবং পারদর্শিতার সব রকম সার্টিফিকেট অর্জন করেও জীবনের পরতে পরতে নানা ঘাত প্রতিঘাতের শিকার হচ্ছিল, সার্টিফিকেট এর ফটোকপি করতে করতে তার জীবন বিষাদে পরিনত হয়েছিল, প্রেম থেকে শুরু করে সব জায়গায় তার সার্টিফিকেট কোন সাহায্যই করতে পারেনি তাকে, তাহলে কেন এই সার্টিফিকেটের পেছনে ছুটোছুটি? কে দেবে এর উত্তর??


কবিতার ব্যবহৃত বেশ কিছু লাইন আমার দারুন পছন্দ হয়েছে-


• সার্টিফিকেট চাপা পড়ে যুবকের মৃত্যু
• প্রতিদিন সকালে হাজার হাজার সার্টিফিকেট, সুদীর্ঘ অপেক্ষায় অফিস থেকে অফিসে
• ফটোকপি মেশিনে জীবন বন্দী আর প্রেম
• প্রতিদিন সকালে হাজার হাজার সার্টিফিকেট, অফিসের টেবিলে থরে থরে জমা পরে।
• নো ওরি উই হ্যাভ সার্টিফিকেট'স ভুড়ি ভু।।
• সার্টিফিকেট চাপা পড়ে যুবকের মৃত্যু...


কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা