আলোচনা  ১৫১


কালচার এর বাংলা প্রতিশব্দ আমরা সবাই জানি “সংস্কৃতি” কিন্তু আন-কালচার এর বাংলা প্রতিশব্দ কি? অপ-সংস্কৃতি, উপ-সংস্কৃতি, ভিন্ন সংস্কৃতি নাকি অন্য সংস্কৃতি? আমরা নৃবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনার সময় তিন ধরনের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম-


সংস্কৃতি (Culture)-সংস্কৃতি কোন প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়, এটা মানুষ জৈবিকভাবেও পায় না, পায় সামাজিকভাবে। সেই সাথে সংস্কৃতি স্থবির কোন ব্যাপারও নয় বরং এটি নানাভাবে অবিরাম বদলাচ্ছে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির থাকে নানা মাত্রা, নানা অনুষঙ্গ। মূলত সংস্কৃতি হলো কোন এক জনগোষ্ঠির দৈনন্দিন জীবন যাপন পদ্ধতি, প্রনালী এবং বৈশিষ্ট্য। কিন্ত আমরা সাধারনভাবে সংস্কৃতি অর্থ বুঝি, কবিতা, গান, সাহিত্য, নাচ, ভাস্কর্য্, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি। এগুলো একটি সংস্কৃতির নানা উপাদান মাত্র। যে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদিও কোন সংস্কৃতির উপাদান।


অন্য সংস্কৃতি (Other Culture)- একটি বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে নানা ধরনের সংস্কৃতি বিরাজমান থাকে, তাকে বলা হয়ে থাকে অন্য সংস্কৃতি। কেউ কেউ এটাকে উপ-সংস্কৃতিও (Sub-Culture) বলে থাকে, কিন্তু উপ-সংস্কৃতি মূলত একটু হেয় অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।


ভিন্ন সংস্কৃতি (Another Culture)- কোন একটি সংস্কৃতি থেকে প্রায় সম্পুর্ন ভিন্ন একটি সংস্কৃতিকে বলা হয় “ভিন্ন সংস্কৃতি”


একটি উদাহরন দেয়া যাক- পুরো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলা হয় “বাংলাদেশী সংস্কৃতি”, তাহলে এর মধ্যে যে বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক ভিন্নতা আছে কিংবা পাহাড়ে, সমতলে আদিবাসীদের জীবন যাপনে ভিন্নতা আছে সেটা হলো, অন্য সংস্কৃতি (Other Culture, আবার বাংলাদেশের তুলনায় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি হলো-ভিন্ন সংস্কৃতি (Another Culture)


কিন্তু আন-কালচার বলে কিছু নেই, মানুষ যা কিছুই করুক বা বলুক সেটা হবে, সংস্কৃতি (Culture), নয়তো অন্য সংস্কৃতি (Other Culture) কিংবা ভিন্ন সংস্কৃতি (Another Culture)। আমরা অনেকটা গালি অর্থে কিংবা কাউকে হেয় করার জন্য বলে থাকি “আন-কালচার”, অনেকটা কথ্য ভাষায় একটা অযৌক্তিক প্রচলন। সংস্কৃতি চর্চার ভালো মন্দ মাপার কোন মাপুনি নেই, আছে কেবল “অন্যতা” কিংবা “ভিন্নতা”।


আলোচ্য কবিতায় কবি দুটো প্রেক্ষাপটকে বর্ননা করেছেন এবং তুলনামূলক বিচারে কালচার/ আনকালচার বলে অভিহিত করেছেন যেটা কবি’র নিজের ভাষ্য নয় বরং অন্যরা যেভাবে হেয় করার জন্য আন-কালচার শব্দ ব্যবহার করে থাকে, সেটা থেকে বিরত থাকার জন্য কিংবা সেই আচরনটা খুব ভালো কোন আচরন নয় বিধায় কবি উপহাস করে কবিতাটি রচনা করেছেন। উপহাসের একটা চমৎকার নমুনা শেষ ছত্রে-


পৃথিবীতে স্মার্ট মানুষ থাকুক
নইলে বৃদ্ধাশ্রম চলবে কিভাবে?
পৃথিবীতে আনস্মার্ট পিঁপড়ে থাকুক
নইলে মাড়িয়ে দিলে মরবে কে?


কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার “টুকরো ভাবনা” বইতে অনেকগুলো টুকরো টুকরো ভাবনার কথা লিখেছেন। বইয়ের “বিশ্বায়নের কালে লাখালেখি” অংশে নিজের একটি অভিজ্ঞতা লিখেছেন, সেটি এই কবিতা আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক মনে করে, এখানে জুড়ে দিলাম।


আমি আমস্টার্ডামে পড়াশুনা করেছি অনেকদিন। সেখানে আমার এক পরিচিত বাঙালি বিয়ে করেছেন সে দেশেরই এক ডাচ মেয়েকে। তাদের এক দিনের এক কথোপকথনের কথা বলি-


তারা আমস্টার্ডামেই আরেক বাঙালি পরিবারে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলো। মেয়েটি ফিরে এসে বলছে, সেদিন ডিনারে তোমার সেই বাঙালি পরিবারের লোকজন যেভাবে ভাত হাত দিয়ে মাখাচ্ছিলো, আঙ্গুল দিয়ে চেটে খাচ্ছিলো, তাতে আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করছিলাম। আসলে, ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখেছি যে আমরা তো জন্তু জানোয়ার না, সুতরাং খাওয়ার সময় আমরা হাত ব্যবহার করি না, হাত দিয়ে খাওয়া একটা অসভ্যতা। আমরা সব সময় চামচ দিয়ে খাই, সভ্য সমাজের এই আচরনটা তোমার সেই বাঙালি পরিবারটি এখনো রপ্ত করতে পারলো না?


বাঙালি লোকটি মনে খুব কষ্ট পেলো, সে বললো, শোন-


আমরা যখন দাওয়াত খেয়ে ট্রামে ফিরছিলাম, তখন তোমার কি মনে আছে যে, আমাদের সামনের সীটে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এসে বসেছিলো? কিছুক্ষনপর মেয়েটা ছেলেটার কোলের উপর বসলো, তারপর একে অন্যকে প্রকাশ্যে চুমু খাচ্ছিলো, আরো কিছুক্ষন পর ছেলেটার হাত মেয়েটার সারা শরীরের বিভিন্ন অংশে চলাচল করছিলো। এখন কথা হচ্ছে, আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখেছি যে, আমরা জন্তু জানোয়ার না, কিছু কাজ আমরা পাবলিকলি করি না, প্রাইভেসী মেইনটেইন করি, পাবলিকলি এসব করা অসভ্যতা, জন্তু জানোয়ারদের সভ্যতা জ্ঞান নেই, তাই তারা পাবলিকলি সেক্সও করতে পারে কিন্তু আমরা তা কোনভাবেই পারি না।


এখানে সমস্যাটা কোথায়?
এরা দুজনেই, নিজের নিজের সংস্কৃতিকে বড় করে দেখছে, নিজেরটাকেউ ভালো মনে করেছে, সভ্য মনে করছে আর অন্যের সংস্কৃতিকে ছোট করে দেখছে, হেয় করছে, অসভ্য ভাবছে। এখানে কোনটা সঠিক কিংবা কোনটা আসল সংস্কৃতি, তার মানদন্ড কি?


এরা দুজনেই যার যার নিজস্ব সংস্কৃতির লেন্স, নিজের সংস্কৃতির স্কেল দিয়ে অন্যের সংস্কৃতিকে বিচার করছে এবং একমাত্র সত্য, ভালো কিংবা সভ্য বলে বিচার করছে। আমি যে মূল্যবোধ, আচার, নৈতিকতায়  বড় হয়ে উঠেছি, সেটাকেই সঠিক মনে করে অন্যেরটাকে হেয় করার নাম “সাযোজ্যতাবোধ” বা এথনোসেন্ট্রিজম (ethnocentrisom)। এথনোসেন্ট্রিক মানুষ অনেকটা এক চোখা ধরনের হয়………।


আমরা অনেকেই এথনোসেন্ট্রিক মনোভাবাসম্পন্ন, ফলে আমাদের প্রতিদিনের আচরনে সেটা প্রকাশ পায় এবং একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বের মূল কারনটাই, নিজেকে বড় ভাবা, নিজের মতামতকেই উত্তম ভাবা, নিজের কাজকেই সবচেয়ে ভালো মনে করা অর্থাৎ এথনোসেন্ট্রিক মনোভাব সব সময় মনে গেথে রাখা।