আলোচনা  ২১১


ইউকিপিডিয়া মতে, কঙ্কাল বলা হয় কোন প্রাণির গাঠনিক কাঠামোকে (ইংরেজি:Skeleton) (গ্রীক σκελετός, skeletos "শুকনো শরীর", "মমি")এবং কঙ্কাল দু ধরনের হয়, বহিঃকঙ্কাল, যা প্রাণির বহিঃআবরণ এবং অন্তঃকঙ্কাল, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে রক্ষা করে।


অন্যদিকে  ত্রি-মাত্রিক শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য বলা হয় অর্থাৎ, জ্যামিতিশাস্ত্রের ন্যায় ভাস্কর্যকে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা সহ ত্রি মাত্রিক হতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়, ভাস্কর্য হলো, দৃশ্যশিল্পের এমন একটি শাখা, যাতে শক্ত বা প্লাস্টিক ( plastic) উপাদানের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক(উচ্চতা/গভীরতা দৈর্ঘ্য × প্রস্থ) অবয়বকে উপস্থাপন করা হয়। বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের, বহুমূখী আকৃতির ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়। রেনেসাঁ এবং আধুনিককালে এটি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। ভাস্কর্য আমাদের অভিজ্ঞতা এবং বোধকে নানাভাবে উজ্জীবিত করে। এর মাধ্যমে আমরা আনন্দ-বেদনার উপলব্ধি পাই; ভাস্কর্য আমাদেরকে বিস্মিত করে, সচেতন করে, স্মৃতিকাতরতাকে জাগ্রত করে কিম্বা নতুন স্বপ্ন দেখানো শেখায়। এভাবে আমাদের জীবনের ভাস্কর্য একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে এবং একই সাথে ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ককে নিবিড় করে তোলে। ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা খুঁজে পাওয়া যায়। একই সাথে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় দর্শন বা কথকথা, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ক্রমবিবর্তনের ধারাকে অনুধাবন করা যায়। ভাস্কর্যের শুরু হয়েছিল কবে থেকে, তা দিনক্ষণ ধরে যথাযথভাবে বলা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, পাথর যুগের শুরু দিকে ভাস্কর্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া ভাস্কর্য নমুনা অনুসারে যদি কালানুক্রমিক সূচি তৈরি করা যায়, তাহলে- তালিকার প্রথমেই পাওয়া যায় নারীমূর্তি। ধারণা করা হয়, মানুষের মূর্তি তৈরি শুরু থেকেই প্রেম, যৌনতা, সৌন্দর্য এবং উর্বর্তার দেবী হিসেবে নারীমূর্তি পূজিতা হয়েছে বিভিন্ন সভ্যতায়। ভাষা এবং সংস্কৃতির কারণে এই দেবী নানা নামে নানা ভাবে পূজিতা হয়েছে। এই সূত্রে ভেনাস আদিম দশা ছিল মাতৃদেবী। (সূত্রঃ ইউকিপিডিয়া এবং গুগুল এর অন্যান্য ওয়েবসাইট)


আলোচ্য কবিতার শিরোনাম “কঙ্কালের ভাস্কর্যের পাহাড়াদার”, তিনটি আলাদা আলাদা শব্দকে ‘কঙ্কাল’, ‘ভাস্কর্য’ এবং ‘পাহাড়াদার’, কবি কিভাবে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত করে কবিতাটি রচনা করেছেন, সেটাই ছিল আমার মূল আকর্ষন। শব্দ তিনটির সাথে আদতে কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু কবির ভাবনার গভীরতার কারনে সম্পর্কিত হয়েছে।


অন্য কোন প্রানী বা মানুষের কঙ্কাল প্রাকৃতিক একটি কাঠামো, যার প্রান থাকে, জন্ম এবং মৃত্যু থাকে, সেইসাথে জন্মগত কিছু অধিকারও থাকে। কিন্তু ভাস্কর্যের সৃষ্টি হয় একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম হিসেবে যার একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র এবং জ্যামিতিক মাপ থাকে। ভাস্কর্য উপ্সথাপিত হয় সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি, দর্শন, বিবর্তন এবং সমসাময়িক বিষইয়াদি নিয়ে, যে কারনে একজন পাহাড়াদার প্রয়োজন হয়। মানুষ স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে তার নিরাপত্তা প্রয়োজন হতে পারে নানাবিধ কারনে কিন্তু সেই একই মানুষ যখন নিজেই তার দেহের স্ক্যালিটন বা কঙ্কাল নিয়ে ভাস্কর্য হিসেবে উপস্থাপিত হয় তখন দরোয়ানের প্রয়োজন হয় বৈকি। কবি সে কথাটাই বলতে চেয়েছেন তার কাব্যে।


একটি আর্ত চিৎকার এবং চিরসত্য দিয়ে কবিতা শুরু হয়েছে “ আমি জন্মেছিলাম জীববিজ্ঞানের ধারা অনুসরণ করে মানব শিশু হিসেবে, বিকশিতও হয়েছিলাম প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, অপার নির্মল আনন্দে। জ্ঞান এবং দৃষ্টিসীমার মধ্যে যা কিছু ছিলো, অপূর্ব সুন্দর”। এ পর্যন্ত মানব শিশুর জন্মপ্রক্রিয়া এবং তার বেঁড়ে ওঠা নিয়ে কোন সংশয়, সন্দেহ ছিল না, কোন অভিযোগও ছিল না। কিন্তু তারপর কি হলো?


পারিপার্শ্বিকতা আমাকে মানব শিশুর জন্মগত যে অধিকার তা থেকে বঞ্চিত করে, অবহেলা করে। আমার পরিপক্ক হয়ে বেঁড়ে ওঠায় বাঁধা না দিলেও, আমাকে আমার মতো অধিকার নিয়ে বাঁচতে শেখায় না, বাঁচতে দেয় না। আমার অনুভূতিতে “মানুষ” হিসেবে বেঁচে থাকার অনুভূতি জন্ম দেয় না। আমি ভাবতে শুরু করি “যে জীবন যাপন করি তা আমার নয়”। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় আমার ভাবনা ব্যহত হয়, আমার ভাবনায় প্রকৃতির নিয়ম বদলে যায়, মানুষের তৈরী নিয়মে আমি বেড়ে উঠতে থাকি আর নিজেকে অপ্রত্যাশিত ভাবতে শুরু করি। চারদিকের আপনজন কাউকেই আর আপন মনে হয় না। আমি শুধুই একটি কাঠামোগতভাবে মানুষ, আমার ভেতর একটি কঙ্কাল আছে কিন্তু কোন মানবিক বোধ নেই, কোন মানবিক মূল্য নেই। চারদিকে যেমন নানা ভাস্কর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, নিজেকে আমার জীবন্ত ভাস্কর্য মনে হতে শুরু করে। ভাস্কর্যের যেমন পাহাড়াদার দরকার হয়, আমিও তেমনি আমার নিজের কঙ্কাল দিয়ে তৈরি একটি ভাস্কর্যের পাহাড়াদার।


কি ভয়ানক এক অনুভূতি!! জীবন্ত একজন মানুষ হয়েও নিজেকে “কঙ্কাল ভাবতে শুরু করা”, সমাজ, সংসার, পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি “প্রাণহীন ভাস্কর্য ভাবতে শুরু করা”।  এ ভাবনা নিজে নিজেই তৈরী হয়নি। সমাজ, সভ্যতা আমাকে ভাবতে শিখিয়েছি, আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে।


নিজেকে কঙ্কাল ভাবার পেছনের কারনগুলো কবি বিস্তাতির ব্যাখা করেননি কিন্তু পাঠক মাত্রই পেছনের বিষাদ এবং প্রতিদিনের যন্ত্রনাদগ্ধ সময়ের কথা অনুমান করতে পারি।


কবি’র জন্য রইলো শুভেচ্ছা।