আলোচনা ১৩


অর্থনৈতিক মানদণ্ডে আমরা শ্রেণী বিশ্লেষণ করে থাকি। দারিদ্র্য রেখার উপরের অংশকে তিনভাগে বিভক্ত করে বলি, উচ্চ বিত্ত (upper class), মধ্য বিত্ত (middle class ) এবং নিম্ন বিত্ত (lower class) একই ভাবে দারিদ্র্য রেখার নীচের অংশকে নিয়ে বলি খুব দরিদ্র (ultra poor), প্রান্তিক (marginalized) এবং বিচ্ছিন্ন (excluded)। সমাজের প্রান্ত রেখায় বা তার কাছাকাছি অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীকেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়। তেমনি, ভাবনা, চিন্তা কিংবা অনুভূতির জগতে এরকমভাবে শ্রেণী বিন্যাস করা না হলেও কখনো কখনো ‘প্রান্তিক অবস্থা’ বিরাজ করে।  অজানা কোন আশংকা, সক্ষমতার অভাব কিংবা মানুষের চরম দুঃসময়ের পাশে দাঁড়াতে না পারার অক্ষমতা মানুষকে ভাবাতে ভাবাতে প্রান্তে দাড় করায়, মানুষ অসহায় হয়ে পরে, নিঃসীম অন্ধকারে ডুবে থাকে।


প্রান্ত রেখা কাব্যে কবি অনিরুদ্ধ সৌরভ,মানুষের ভাবনার জগতে প্রবেশ করে দেখতে চেয়েছেন কেন মানুষ তার চিন্তায়, ভাবনায়, অনুভূতিতে ‘প্রান্ত রেখায়’ অবস্থান করে, কি তার মূল কারন, সেটা কি কেবল নিজেকে কেন্দ্র করে নাকি আশাপাশের মানুষের জন্যও মানুষ তার ভাবনায় প্রান্তিক অবস্থা অনুভব করে। অনুভুতি কতোটা জোড়াল হলে, কতটা স্পর্শকাতর হলে মানুষ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কেঁদে উঠে। কতোটা মানবিক হলে মানুষ নিজের অবস্থান ভুলে, অন্যের অবস্থানকে ভেবেই খাদের কিনারে দাড়িয়ে হৃদয় দিয়ে উচ্চারন করতে পারে, “প্রান্ত রেখা’ শব্দটি।


বর্তমানে আমি কাজ করছি, বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা শিবিরে, খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে, মানবিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক বিবেচনা এবং মানুষের অসহায়ত্ব। কবির কাব্যেও যেমন ফুটে উঠেছে ‘শরনার্থী শিবিরে ত্রাণ সামগ্রীর বড় অভাব প্রান্তরে’, এরকম কোন বিপর্যয়ে মানুষের উচিৎ নিঃস্বার্থ এবং নিঃশব্দে এগিয়ে যাওয়া, নিজের কিছুটা হলেও বলিদান দেয়া, এরকম ভাবনাতেই আলোকিত থাকা, যেমনটা কাব্যে খুব চমৎকার করে বলা হয়েছে, ‘মোম বাতির মতো নিঃশব্দ আত্মবলিদানে আলোকিত করে ভাবনার কানন”।


একটি শরণার্থী শিবিরে কতট বিপর্যয়, অসহায়ত্ব আর হৃদয় বিদারক দৃশ্য থাকতে পারে তা পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে পাওয়া গেলেও, অনুভূতিতে পাওয়া যায় ভিন্নচিত্র, আর তখন বিশালতার মাঝেও শুন্যতা বিরাজ করে, মায়াবী তারার আলো খুজে পাওয়া যায় না, পৃথিবীর রঙ হারিয়ে ধূসর হয়ে যায়, “এখানে আমার ধূসর পৃথিবীতে জল নেই,নেই মেঘের টুকরয়া, তারাহীন অনুর্বর আকাশ ভরা শূন্যতা”।  নিজের বাস্তবতায় কোন মানুষ খাদের কিনারে না দাঁড়ালেও অনুভূতিতে কিনারা কিংবা প্রান্তিকতা অনুভব করতে পারেন। নিজেকে অন্যের অবস্থানে রিপ্লেস করতে সবাই পারে না, হৃদয়ে অসীম শক্তি,তীব্র অনুভূতি প্রবণ না হতে পারলে সেটা সম্ভব হয় না।


কবি রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং অমানবিক সমাজচিত্র একে, এরকম তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন মানুষের অভাব অনুভব করে বলেন “দাঁড়িয়ে আছি জীবন রেখার প্রান্তে, শূন্য মনে মেঘ জমেছে অজান্তে।
কবির জন্য শুভ কামনা রইলো।