আলোচনা ৯৮


গত এক মাসে, একই শিরোনামে  বেশ কয়েকটি কবিতা পড়েছি অর্থাৎ “পাগলিটা মা হয়েছে”, মোটামুটি ভাবে বলা যায় সবকটি কবিতার মূল বক্তব্য একই কিন্তু উপস্থাপনায় ভিন্নতা এবং মূল বক্তব্যকে ঘিরে পারিপার্শ্বিকতায় ভিন্নতা আছে। সাধারণভাবে আমরা জানি বৈবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী পুরুষের মিলনের মধ্য দিয়ে নারী মাতৃত্ব লাভঁ করে অন্যথায় নারীর মাতৃত্ব সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। একমাত্র যীশু খ্রিষ্টের জন্ম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কবি আ জাহিদ রুদ্র সহ অন্যান্য কবিগণ এই শিরোনামে লেখা কবিতায় কয়েকটি জটিল এবং সামাজিকভাবে অমীমাংসিত প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছেন।


১। আসলে পাগল/পাগলি কে? পাগল বলে মেডিকেল সাইন্সে কোন শব্দ নেই, পুরোটাই সামাজিকভাবে তৈরি একটি শব্দ এবং এই শব্দ ব্যবহার করেই একে অপরকে কিংবা দলগতভাবে একজনকে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যায় কিভাবে?
২। পাগলির কি বিয়ে হতে পারে? সামাজিকভাবে স্বীকৃত বিয়ে? না হলে, পাগলি কি করে মা হয়?
৩। মা হওয়া অর্থাৎ মাতৃত্ব কি সামাজিক বিষয় নাকি শুধুই জৈবিক কোন বিষয়?
৪। পাগল/পাগলি শব্দ দিয়ে যখন কাউকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় তখন, এই সমাজেরই কেউ আবার তার সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয় কিভাবে?
৫। পাগলিটা মা হয়েছে’, পুরো ঘটনার পুরুষতান্ত্রিক মানুষিকতা এবং সামাজিক মনঃসমীক্ষণকে কিভাবে বিবেচনা করবো ?


আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, মাতৃত্বের প্রশ্ন কেবল জৈবিক সমস্যাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্দ থাকা সমীচীন নয়। কেননা মাতৃত্বের প্রয়োজন কেবল জৈবিক প্রয়োজন বলে ব্যক্তি বিশেষের মতামত থাকলেও মাতৃত্বের প্রয়োজন সামাজিক প্রয়োজনকে ঘিরেও আবর্তিত হয়। মানব প্রজাতির অস্তিতের স্বার্থেই মাতৃত্বের প্রয়োজন। অন্যদিকে মাতৃত্বের প্রশ্নটি কেবল কোন নির্দিষ্ট জাতি, পেশা, শ্রেণী কিংবা ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর জন্যই প্রযোজ্য নয়। নয় এককভাবে কেবলই নারীর সমস্যা। নারীর মাতৃত্ব সার্বজনীন, তাই মাতৃত্বের সমস্যাটি সমগ্র বিশ্ববাসীকেই বিচলিত করা স্বাভাবিক। মানব বিবর্তনের যাত্রা শুরু হয় নিরাপদ মাতৃত্বের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং সামগ্রিক মানব প্রজাতির বিকাশ ঘটে এই নিরাপদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যেমন বৈশ্বিকভাবে সামজিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, তেমনিভাবে অর্থনৈতিক সমস্যাকেও আঁচড় কাটে। এককভাবে কিংবা কোন জাতিগত সমস্যা হিসাবে মাতৃত্বের সমস্যাটিকে একপেশে ঠেলে দেবার কোন অবকাশ নাই। তবে মাতৃত্ব সমস্যা সমাধানে জাতিগত পার্থক্য আছে, আছে ব্যক্তি বিশেষে পার্থক্য, আছে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। এ সমস্যার উদ্ভবের সাথে জড়িয়ে আছে-সংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি (আচরণগত, বিশ্বাস ও মূল্যবোধনগত এবং  ঐতিহ্যগত), সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অসমতাভিত্তিক লিঙ্গিয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাষ্ট্রীয় কিংবা জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি। মাতৃত্ব প্রশ্নে আমাদের খন্তিত ভাবনায় রবারই সমাজ স্বীকৃত মাতৃত্বের কথাই ভাবি কিন্তু সমাজ অ-স্বীকৃত মাতৃত্বের (যেমনঃ যৌন কর্মীর মাতৃত্ব, বিরঙ্গনার মাতৃত্ব, ধর্ষিতর মাতৃত্ব, চির কুমারীর মাতৃত্ব, দেবদাসীর মাতৃত্ব, নর্তকীর মাতৃত্ব, পাগলিনীর মাতৃত্ব) কি হবে তা অমীমাংসিতই থেকে গেছে। যদিও সকল সন্তনই কোন না কোন নারী ও পুরুষের যৌন মিলনে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর সমন্বয়েই গঠিত হয়, তথাপি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কোন কোন সন্তানকে জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করে। উক্ত সন্তানের মায়ের মাতৃত্বকে পদদলিত করে প্রতিনিয়ত। মুলত ‘জারজ’ শব্দটির বুৎপত্তি ‘জ্যার’  থেকে। ‘জ্যার’ অর্থ গুপ্ত প্রণয়ী। এই প্রনয়ের সংসর্গে যে সন্তানের জন্ম অর্থাৎ জাত যে জাতক-জাতিকা তাকেই অভিধানে ‘জারজ’ বলে থাকে। বস্তুত জারজ শব্দটির যে ব্যাঞ্জনা তা এই শব্দের আভিধানিক তাৎপর্যের সঙ্গে মেলে না। কেননা ‘জার’ এর সংসর্গ ছাড়াও ধর্ষণ জাত সন্তান এবং যৌনকর্মীর সন্তানদের ও জারজ সন্তান হিসেবেই চিনহিত করা হয়। কাজেই শব্দটি ক্রমশ এর মূল অর্থ থেকে সরে এসেছে, এক কথায় এর তাৎপর্য দাঁড়িয়েছে এ রকম- স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ বা অজ্ঞাত পিতার মিলনে নারী যে সন্তান ধারন ও প্রসব করে সে-ই জারজ সন্তান।


‘পাগলিটা মা হয়েছে”, কবি আ জাহিদ রুদ্র পুরো কবিতাটিই এ পর্যন্ত আলোচিত তাত্ত্বিক কাঠামোকে সামনে রেখেই লিখেছেন, যদিও তাত্ত্বিক কাঠামোকে ভিত্তি ধরে মুলত ‘পাগলির’ উপর কিছু নরপশুর অত্যাচার এবং মা হওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাতৃত্বকে সামাজিকভাবে অবমাননার এক কুৎসিত চিত্রই শুধু একেছেন। তথাপি কবিতার প্রতি লাইনে লাইনে ফুট উঠেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও আচরণের নগ্নতা এবং সামগ্রিকভাবে সভ্য সমাজের অসভ্যতা। পাগলিটি যখন ছিন্ন বস্ত্রে এখানে সেখানে ঘুরে  বেড়াতো, যখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় বার বার কেঁপে উঠত তখন কেউ তার দিকে ফিরে তাকায়নি, পাগলি বলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নই থেকেছে, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্যতা তার ছিল না।  কিন্তু যখনই সমাজপতির চোখ পড়ল পাগলির উপর, তার যৌন লালসা মেটানোর সহজ এবং সস্তা পথে পেয়ে গেল, তখন পাগলিটি হয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য মুল্যবান তারপর আবার তার এবং সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটির অবস্থান হয়ে গেল রাস্তার কুকুরের ন্যায়,  শিশুটি সমাজপতিদের বাড়ির বাইরে গেটের রাস্তায় মায়ের স্তনে মুখ রেখেই জানান দিল তার অস্তিত্ব। ভাবা যায়, কি বীভৎসতা ফুটে উঠেছে এই কবিতায় !!!! যে সন্তান গৌরবের হতে পারতো, সেই সন্তানই এখন অস্পশ্য, যে সন্তান পিতার স্নেহে বড় হতে পারতো, সেই সন্তানই এখন পাগলির সন্তান, জারজ সন্তান, সভ্যতা আমাদের কি শেখাচ্ছে, এরই নাম সভ্যতা !!!


উত্তেজিত হরমোন এর কোন দায়বদ্ধতা নেই, যৌন লালসার কোন সীমাবদ্ধতা নেই, ক্ষমতাবান সমাজপতিদের কোন অপরাধ নেই, সব অপরাধ শুধু পাগলিটির, কেন তার যোনি এত সস্তা হোল, কেন তার যৌবন পুষ্ট শরীর সমাজপতিদের আকৃষ্ট করলো, কেন সে ‘পাগলি’ আখ্যা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না???  পাগলির উপর যৌন অত্যাচার আর তার প্রসব বেদনা এ সমাজের কেউ শুনতে পায় না, কেবল শুনতে পায় রাস্তার কুকুর।


সভ্যতার পচনকে এক পাগলির নিস্পাপ মাতৃত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করে তথাকথিত সমাজ, সভ্যতা এবং মানবতার অহেতুক গর্বের গালে চড় দেয়ার সাহসিতকতার জন্য কবি আ জাহিদ রুদ্র’র প্রতি রইলো অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।