আলোচনা ০৬


আজ বেশ কিছুটা সময় পাবার কারনে কবি সমীর প্রামাণিক এর পাতা ভিজিট করলাম, ১০-১৫ টি কবিতা পড়ার সুযোগ হল, আলোচ্য কবিতাটি (রাসায়নিক সূত্র) নজর কাড়ল আলোচনার জন্য । অনেকের মন্তব্য পড়লাম, কিছুটা ভিন্ন মতের কারনে কবিতাটি আলোচনায় আনতে চাইলাম যদিও কবিতাটি অনেকদিন আগে (২৪.০৮.২০১৭) প্রকাশিত হয়েছে তখন আমি এই আসরের সদস্য হইনি।


কবিতাটি চমৎকার কতগুলো সামাজিক প্রপঞ্চ (প্রেম এবং যৌনতা, ভালবাসা এবং প্রেম, অভিনয় এবং ভালবাসা) নিয়ে লিখা। কোন কোন প্রপঞ্চে কবি নিজেই নিজের মত করে সিন্ধান্ত দিয়েছেন ঠিকই (ভালোবাসাহীন প্রেম দিব্যি চলছে টগবগিয়ে !)  কিন্তু আশ্চর্য বোধক চিনহ দিয়ে পাঠকের ভাবনায় দৃষ্টি গোচর করেছেন।  আবার কোথাও কোথাও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, অমীমাংসিত রেখেছেন কবির নিজের সিদ্ধান্ত। পাঠকের ভাবনা নিয়ে কবি খেলতে চেয়েছেন, পাঠক প্রশ্নগুলোকে নিয়ে কিভাবে ভাবে, তা দেখতে চেয়েছেন, যেমন- ‘ভালোবাসায় অভিনয় আর অভিনয়ের ফাঁকে ভালোবাসায় হাঁফ ধরে যায়’ কিংবা ‘প্রেমহীন যৌনতা আর যৌনতা ছাড়া প্রেম’ । আবার  আশ্চর্য এক দক্ষতার মাধ্যমে রাসায়নিক সুত্র ব্যবহার করে (ক্ষার মাত্রেই ক্ষারক কিন্তু, ক্ষারক মাত্রেই ক্ষার নয়) পাঠকের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছেন কবি। একদিকে পাঠককে মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছেন আবার অন্যদিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত রেখে, ভাবনা প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছেন, পুরো কবিতাটিতে কবির এক অসাধারন দক্ষতার পরিচয় মেলে ।


পৃথিবীতে সত্য বলে কিছু নাই, আমার মনে হয় ‘সকল সত্যিই অর্ধ সত্য’, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু কিছু প্রমানিত সত্য আছে যেমন- সকল প্রাণীর মৃত্যু অবধারিত আবার কিছু গাণিতিক সত্য (২+২=৪) এবং বৈজ্ঞানিক সত্য আছে যেমন- পানির মধ্যে হাইড্রোজেন এনং অক্সিজেন থাকে, কবি যেমনটা লিখেছেন-ক্ষার মাত্রেই ক্ষারক কিন্তু, ক্ষারক মাত্রেই ক্ষার নয়।


কিন্তু সামাজিক প্রপঞ্চ গুলোর ক্ষেত্রে এরকম কোন অর্ধ সত্য কিংবা প্রমানিত সত্য বলে কিছু নেই। ভালবাসার মধ্যে প্রেম থাকে নাকি প্রেমের মধ্যে ভালবাসা থাকে, কোনটা কার চেয়ে বড় কিংবা কোনটা কার আগে?? পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষ একই রকমভাবে ভাবে না, পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তির ভাবনা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর।  কিন্তু কবি তার নিজের সিন্ধান্ত জানিয়েছে, ‘ভালোবাসাহীন প্রেম দিব্যি চলছে টগবগিয়ে! নেতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রেমের মধ্যে ভালবাসা থাকাকেই আদর্শ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু কোনটা প্রেম আর কোনটা ভালবাসা তার কোন বৈশ্বিক মাপকাঠি নেই ফলে নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচকতা ব্যক্তি, সমাজ এবং সংস্কৃতি নির্ভর প্রপঞ্চ। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এ ধরনের বোধগুলো তৈরি হয় একেক সমাজে একেক রকমভাবে।


কবি সামাজিক প্রপঞ্চগুলোকে তুলনা করতে চেয়েছেন আপাত প্রমানিত বৈজ্ঞানিক সূত্র দিয়ে, ‘ক্ষার মাত্রেই ক্ষারক কিন্তু, ক্ষারক মাত্রেই ক্ষার না’, নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছেন পাঠককে, কিন্তু সামাজিক প্রপঞ্চগুলো বৈজ্ঞানিক সূত্র মেনে চলে না, সেখানেই পাঠককে স্বাধীনতা দিয়েছেন নিজের মত করে ভাবতে।  বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ক্ষার-ক্ষারক এর মত করে প্রেম এবং যৌনতা, ভালবাসা এবং প্রেম, অভিনয় এবং ভালবাসা, ভাবা যাবে না কিন্তু পাঠক তার নিজের সংস্কৃতির আলোকে ভাবতে পারবে, সে স্বাধীনতা ত আছেই।


আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ‘ভালবাসা ছাড়া যৌনতা’ অগ্রহণযোগ্য,  ‘ভালবাসায় অভিনয়’ অগ্রহণযোগ্য, আবার ‘প্রেম ছাড়া যৌনতা’ অগ্রহণযোগ্য ইত্যাদি। আবার এটাও সত্য, কোন দেশের কিংবা সময়ের সমাজচিত্র এবং সংস্কৃতিক আবহ স্থির থাকে না,  প্রবাহমান থাকে সব সময়।


সব মিলিয়ে কবিতাটি যেমন সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন আবার নানা ভাবনারও জন্ম দিয়েছেন। পরিবর্তনের প্রবাহকে আমরা কিভাবে গ্রহন করবো কিংবা আদৌ গ্রহন করবো কিনা তা নিয়েও ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।  সব কবিতা পাঠককে ভাবায় না, এই কবিতাটি আমাকে খুব ভাবিয়েছে। সাধারনভাবে প্রচলিত ভাবনায় নিজেকে জড়িয়ে রাখলে এখানে ভাবনার কিছুই নেই কিন্তু গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ভাবনার নানা সূত্র তৈরি করেছে কবিতাটি।


অনেক শুভেচ্ছা কবি  সমীর প্রামাণিক কে এত চমৎকার একটি কবিতা উপহার দেয়ার জন্য। ভাল থাকবেন সব সময়।