আলোচনা ১০


নোটঃ প্রতিদিন একটি কবিতা নিয়ে ভাবার জন্য, আলোচনা করার জন্য সময় বরাদ্দ করি কিন্তু আসরে কবিতা প্রকাশিত হয় প্রায় ১৭০-২০০ কবিতা। প্রথমে কবিতার শিরোনাম স্ক্যান করার পর, ১৫-২০ কবিতা খুব আকর্ষণ করে, কিছু কবিতার শিরোনাম আকর্ষণ করে ঠিকই কিন্তু বক্তব্য আকর্ষণ করে না, আবার স্ক্যান করে পাই ৫-১০টি কবিতা। নিজের সীমাবদ্ধতার কারনে এর মধ্যে সব কবিতার অর্থ উদ্ঘাটন করতে পারি না। ফলে তৃতীয় ধাপে খুঁজে পাই, নিজের পছন্দের কবিতা । শিরোনাম, বক্তব্য, সহজবোধ্য, বক্তব্য উদ্ঘাটনের সক্ষমতা, সব মিলিয়ে ৩-৫ টি কবিতা পছন্দের হয়ে উঠে প্রতিদিন।


কবি মনোজ ভৌমিক (দুর্নিবার কবি) এর “শব্দটা আজ ভীষণ মেকী” কবিতার শুধুমাত্র শিরোনাম নিয়েই একটি কবিতা হতে পারে। চমৎকার একটি শিরোনাম, পুরো কবিতার বক্তব্য ধারণ করার ক্ষমতা রাখে।  চারটি শব্দ (শব্দ, আজ, ভীষণ এবং মেকী) ব্যবহার করে শিরোনামকে আকর্ষিত করা হয়েছে। যে কোন শব্দের পেছনে অনেক বক্তব্য লুকিয়ে থাকে, সম্পর্ক আড়াল থাকে ফলে পাঠকের মনে কবিতার ভেতরে গিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়, একবারে শুরুতেই পাঠক ভাবতে থাকে ‘শব্দ’ টি কি হতে পারে? যখন ‘আজ’ শব্দ ব্যবহার হচ্ছে তখন তুলনামুলক প্রেক্ষাপট জানার জন্য পুরো কবিতা জুড়ে অপেক্ষা থাকছে। কবি তার কবিতায় কোথায় জোরালো বক্তব্য রাখতে চাচ্ছেন তা ‘ভীষণ’ শব্দ দ্বারা পাঠকের আকর্ষণ তৈরি করছে এবং সবশেষে ‘মেকী’ শব্দের দ্বারা বর্তমান অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠে যা পাঠককে শুরুতেই ভাবনার জগতে নিয়ে যায়, তাহলে আগে কেমন ছিল, এখন কেন মেকী হল, মেকী হবার কারন কি... কবিতা পড়ার আগেই পাঠক ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, কবিতার শিরোনাম এর কৃতিত্ব এখানেই।


একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্ক নিয়েই পুরো কবিতা। আফসোস জানানো হয়েছে, সভ্যতার নামে, আধুনিকতার জালে আটকে পরে, যান্ত্রিকতার আগ্রাসনে আমারা সম্পর্ককে হারিয়ে ফেলেছি, ছিনতাই হয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। সম্পর্ক শব্দটি নিজেই নিজের ব্যাখা দেয়, এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, ভালবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা অর্থাৎ মানুষের মানুষের অরগানিক সম্পর্ক। সমাজে আমারা নানা সম্পর্কের জালে একে অপরের সাথে আটকে থাকি, বৃত্তবন্দী থাকি, কারনে অকারনে একে অপরের হয়ে উঠি, একজনের নিঃশ্বাসের সাথে আরেকজন লেপটে থাকি কিন্তু ইদানিং সে সম্পর্কের জাল ইদুর কেটেছে, কোন জড়ানো সম্পর্ক নেই, এক একজন সতন্ত্র, সম্পর্কের কোন কাঠামোতেই আমরা আর নেই।


কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, চ্যাটিং এসবই আমাদের অন্যের সাথে যোগাযোগ মাধ্যম, বস্তুগত প্রয়োজনের মাধ্যম, হৃদয়ের কোন প্রয়োজন নেই। আগে সম্পর্ক গুলোই বলে দিত আমাদের ঠিকানা কিন্তু এখন কারো সাথে যোগাযোগ বলতে চাইলে ইমেইল এড্রেস দরকার হয়, তাই কবি খুব আফসোস করে লিখেছেন  “এত্ত বড় একটা শব্দ এরও আবার ঠিকানা চাই গো”। জন্মের পর থেকেই আমরা ‘মানবিক সম্পর্ক গুলো’ অনুভব করতে শিখতাম কিন্তু এখন ‘সম্পর্ক’ বুঝতে হলে ‘ইয়াহু কিংবা গুগোল সার্চ দিতে হবে, এর মানে কি জানার জন্য? মানবিক সম্পর্ক থেকে ‘রবোটিক’ সম্পর্কের দিকে যাত্রাকেই কবির দীর্ঘশ্বাসে ফুটে উঠেছে ‘ভীষণ মেকী’ শব্দের আড়ালে ।


অবহেলায়, অযত্নে আমারা ‘সম্পর্ক’কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি, কি তার পরিণতি তার এক ভয়াবহ রূপ নীচের দুটি লাইনে এঁকেছেন কবি-


ফেসবুকেতে জড়িয়ে ধরে, সহানুভূতির চাদর দিয়ে
দু'দিন পরে সে সম্পর্ক পৌঁছে যাবে বৃদ্ধাশ্রমে।


খুব কঠিন কথা কত সহজে কবি উচ্চারন করেছে নীচের লাইনে, ভাবতেই গা শিউরে উঠে। সেলফির জোয়ারে আমারা এতই ভাসছি যে, মেয়ে তার মৃত বাবাকে জড়িয়ে সেলফি তুলছে এবং ফেবুতে প্রকাশ করে পাবলিককে দেখাচ্ছে।

মরা বাপকে জড়িয়ে ধরে, মা মেয়েতে ভীষণ কাঁদে।
সেলফি নেওয়া সেই সম্পর্কটা, গভীরভাবে পাবলিক দেখে!


সবশেষে কবি সতর্ক বানী উচ্চারন করেছে, সবাই যদি হাল ছেড়ে দিই তাহলে তার পরিনতি ভয়াবহ হবে। নীচের কয়েকটি লাইনে তার আশংকা ব্যক্ত করেছেন।


আজকে এখন ভাবি মনে, ছেড়ে দিই ঐ শব্দটাকে
কী হবে ওকে বেঁধে রেখে!
যে সম্পর্কে সম্পর্ক নাই, সে সম্পর্ক কেন দেখাই।


আমার কাছে অসাধারণ এক কাব্য মনে হয়েছে, বুকের ভেতর টনটন করে উঠছে। অন্য পাঠকের মনের অনুভূতি জানি না কিন্তু আমি ভীষণভাবে ব্যথিত। অনেক শুভেচ্ছা থাকলো কবির জন্য।