আলোচনা  ২০৮


কবিতাটি পড়ে বেশ কিছুক্ষন বিমর্ষ ছিলাম। কয়েকটি শব্দ, শব্দগুচ্ছ, লাইন বিধ্বস্ত করেছে, মস্তিস্কে ঝড় তুলেছে। নিজের জীবনে্র আয়ানায়, আশেপাশের দেখা, শোনা নানা জীবনের গল্প/অ-গল্পগুলো চোখের সামনে ভাসছিলো। আমাদের আগোচরে জীবনের কতো গল্প থাকে, কতো হাহাকারগুলো নীরবে নিভৃতে কাঁদে!!! স্থানিক দূরত্বের মাপুনি হলো মাইল/কিলোমিটার যদিও আজকাল সময়ের হিসেবে দূরত্ব মাপা হয়, কিন্তু সম্পর্কের দূরত্ব মাপার সূচক কি? সম্পর্কের ক্ষেত্রে দূরত্ব বলে আদৌ কিছু আছে নাকি পুরোটাই চাওয়া –পাওয়ার হিসেবের গরমিল? সম্পর্কের দূরত্ব কি স্থায়ী কোন বিষয় নাকি সময়ের আবর্তনে তার রূপে ভিন্নতা পায়? কবিতাটি পড়তে পড়তে নিজেকেই নিজে অনেক প্রশ্নে জর্জরিত করেছিলাম।


পুরো কবিতায় যে শব্দ/লাইনগুলো ভাবিয়েছে বেশঃ


শব্দ এবং শব্দগুচ্ছঃ
• ক্ষত-বিক্ষত
• যোজন যোজন দূরত্ব
• অসহায়ত্ত
• নিরাপত্তাহীনতা


লাইনগুলোঃ
• অন্যায়কে সমর্থন করলে অন্যায় কমে যায়না
• বৃষ্টির দিনেও মানুষ খুন করতে দ্বিধাবোধ করেনা
• নির্বোধ আর নির্লজ্জতার ভেতরও সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে
• দুর্বোধ্য ভাষা আর তীক্ষ্ন দাবানল
• জীবনের অর্থ জীবনই জানে
• ক্ষত-বিক্ষত অনুভূতিগুলো
• প্রাপ্তিহীন বিস্তীর্ণ সকল স্বপ্নগুলো
• এত দক্ষ পৈশাচিকতা নিশ্চয়ই প্রচুর সাধনায় প্রাপ্তি


সম্পর্কেকে ঘিরে যে নিরাপত্তাহীনতা, অসহায়ত্ত, নির্ভরতা, চাওয়া পাওয়ার হিসেব কিংবা দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে নানা অভিযোগ, অভিমান, অনুযোগ ইত্যাদি থাকে তার মূলে গিয়ে সমস্যাকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন কবি। গ্রামীন ফোনের বিজ্ঞাপনে প্রতিনিয়ত দেখছি “কাছে থাকুন”,  গ্রামীন ফোনের এটা একটা ব্র্যান্ড ম্যাসেজ। কিন্তু কাছে থাকার মানে কি? শারীরিকভাবে কাছে থাকা, গা ঘেষেগেষে থাকা, একসাথে বসবাস করা? আমরা অনেকেই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এবং এই কবিতার শুরুতে কবি বলেছেন-“যোজন যোজন দূরত্ব এক ছাদের নীচে থেকেও দূরত্ব হতে পারে”।


সম্পর্কের ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে কাছাকাছি থাকা সম্পর্কের গুনগত মান নিশ্চিত করে না রবং আত্মার কাছাকাছি, মনের কাছাকাছি থাকাকেই বোঝায়। স্থানিকভাবে অনেক দূরত্বে থাকেও মনের কাছাকাছি থাকা যায় এবং সম্পর্কের ঘ্রান নেয়া যায়, সম্পর্কের তাপ উপভোগ করা যায়। তবে যে, গ্রামীন প্রবাদ বলে-চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়। আসলে সবগুলো কথাই সত্য, ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞ্রার আলোকে এবং প্রেক্ষিত বিবেচনায়। আমি সব সময়, প্রায় সব মানবিক কিংবা বিশ্বাস, অবিশ্বাস দর্শন ইস্যুগুলোতেই “প্রেক্ষিত বিবেচনা” এর উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও “কাছে থাকুন”, একই ছাদের নীচেও যোজন যোজন দূরত্ব” কিংবা “চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল”, সবগুলোই প্রেক্ষিত বিবেচনায় সত্য।


সম্পর্ক মানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকার আবেগ, অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছে অনিচ্ছে, চাওয়া পাওয়া......গুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে এবং সম্মানের সাথে মেটা্নো, পারস্পরিক সমঝোতা, সেক্রিফাইস এবং কম্প্রোমাউজ এর মাধ্যমে নিজেদের পরিচালিত করা। সে সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী থেকে শুরু করে যে কোন ধরনেরই হউক না কেন।


মানব জীবনের সম্পর্কের বাইরে আর কিছুই নেই। সে সম্পর্ক ঋণাত্মক কিংবা ধনাত্মক হতে পারে, সে সম্পর্ক সামাজিক, রাষ্ট্রিয় কিংবা কর্মজীবনের নীতিমালায় নানা ধরনের হতে পারে কিন্তু শেষ বিচারে কোন না কোন সম্পর্কের মধ্য দিয়েই মানব জীবন আবর্তীত হয়, ঘুরতে থাকে এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এমনকি “একাকীত্ব”ও কোন না কোন সম্পর্কের নেতিবাচক এক্সটেনসন। সন্নাস যাপনও সম্পর্কের বাইরের কিছু না, প্রকৃতির সাথে, নিরাকার ক্ষমতার সাথে এক ধরনের সম্পর্ক। ফলে সম্পর্ক স্থাপন মানব জীবনের একটি অবাশ্যম্ভাবী বিষয়, এটা ঘটতেই হবে, এতা থাকতেই হবে, কোন না কোন ফর্মে।


আলোচ্য কবিতা, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তার নেতিবাচকতার কারন ও ফলাফল নিয়েই পুরো আয়োজন ছিল কবি’র। এখানে নানা বিষয়গুলো উঠে এসেছে, রূঢ় আচরন, দক্ষ অভিনয় কৌশল, পৈশাচিকতা, নির্লজ্জতা ইত্যাদি বিষয়গুলো যখন সম্পর্কের মাঝে অবস্থান করে তখন সম্পর্কেগুলো অভিশাপ আকারে আসতে থাকে এবং এক পর্যাবে নাভিশ্বাস ওঠে মনে।


কখনো কখনো সম্পর্কের প্রয়োজনে কোন অন্যায় মেনে নিলে, সেটা অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কমে যাবার কথা কিন্তু সেটা যখন বাড়তেই থাকে তখন সে অন্যায় মেনে নেয়ার আর কোন অর্থই থাকে না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য ভাষাগুলো দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে সমস্ত স্বত্বা জুড়ে, সকল কোলাহলকে নিস্তব্ধ করে দেয় মুহূর্তেই।


সম্পর্কের যাতাকলে পিষ্ট জীবন অবশেষে মেনে নিতে শেখে, দিশেহারা মন নিজেকেই শোনায়, “জীবনের অর্থ কেবন জীবনই জানে”, ক্ষত বিক্ষত অনুভূতিগুলো থাকে প্রাপ্তিহীন, বিস্তীর্ণ পথে হাটে স্বপ্নগুলো।


কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা।