▪ সনেট সম্পর্কিত প্রাথমিক আলোচনাঃ-


সনেট জাতীয় কবিতার জন্ম হয় ইতালিতে নবজাগরণের যুগসন্ধিতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। কেউ কেউ মনে করেন, প্রভঁস প্রদেশের ক্রুবাদুররা মুখে মুখে যেসব গান বা ছড়া সুরে সুরে গাইত সেখান থেকেই সনেটের উৎপত্তি। তবে অনেকের ধারণা সিসিলিতে আরবদের সংস্পর্শে এসে ইতালিতে সনেটের অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রাচীনতম ইতালি কবিতায় আরবি কবিতার প্রভাব খুব বেশি বলেই ধারণাটি অমূলক নয়।


ইতালিয় কবি পের্ত্রাককে (১৩০৪-১৩৭৪) সনেটের প্রবর্তক বা জন্মদাতা বলা হয়। কিন্তু সনেটের জন্ম বিত্তান্ত খানিকটা অস্পষ্টতায় ঢাকা সনেটের প্রথম প্রবর্তক হিসাবে পিয়ারাভনের নামও পাওয়া যায়। এছাড়াও জিয়াকোমো দ্য লেন্তিনোকে সনেটের উদ্গাতা মনে করা হলেও মূলত ফ্রান্সিস্কো পেত্রার্কা বা পেত্রার্কই হচ্ছেন সনেটের জনক।
ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে আরেজ্জোর গিট্টোন (১২৩৫-১২৯৪) ইতালিয় ভাষাতে শুধু সনেট লিখেই খান্ত হননি সনেটের রীতিনীতি ও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। গিট্টোন অন্তত ২৫০টির মতো সনেট লিখেছেন বলে জানা যায়। গিট্টোনের দাড় করানো রীতিনীতি অনুসরণ করেই সনেট লিখেছেন পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪) ও দান্তে আলিগিরি (১২৬৫-১৩২১)।


সনেটের জনপ্রিয়তা স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইতালিতে আরো যারা সনেট লিখে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা হলেন গুইত্তোনে দারেৎসা, দান্তে আলিগিয়ারি, চিনো দ্য পিস্তয়া, গুইদো কাভালকান্তি, ফাৎসিও দেলই উবের্তি, আন্তনিও মিনতুর্নো, জিওভান্নি দেল্লা কাশা, গিওভান্নি বোক্কাচিও, পিয়াত্রো বেম্বো প্রমুখ।
ইংল্যান্ডে এর সূচনা করেন স্যার টমাস ওয়াট (১৫০৩-১৫৪২) যদিও তিনি খুব বেশি সার্থক সনেট রচনা করেননি। তবে ইংরেজি সাহিত্যে তিনি সনেটের প্রথম উদ্গাতা হিসেবে সম্মানিত হয়ে আছেন। ওয়াটকে শেক্সপিয়রীয় (১৫৬৪-১৬১৬) সনেটের প্রথম আবিষ্কারকও বলা হয়ে থাকে। প্রায় সমসাময়িক কবি ‘আর্ল অব সারে’ হিসেবে খ্যাত হেনরি হাওয়ার্ড অবশ্য সনেট লিখে খ্যাত হয়েছিলেন। তবে তিনি পেত্রার্ক বা ওয়াটকে অনুসরণ না করে একটি ভিন্ন আঙ্গিক সৃষ্টি করতে সম হয়েছিলেন; যা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে এবং পরবর্তীকালে উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাকে এক ভিন্ন মাত্রা ও রূপ দিয়েছিলেন। বস্তুত তার হাত ধরেই ইংল্যান্ডে এর ব্যাপক শ্রীবৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন ঘটে।


কয়েক শতকের কবি পেত্রার্কীয় ধারা অনুসরণ করে সনেট লিখেছেন। আবার অনেকেই পেত্রার্ককে অনুসরণ করে নতুনত্বের  পরিচয় দিয়েছেন। যেমনঃ উইলিয়াম ওয়ার্ডসআর্থ (১৭৭০-১৮৫০) প্রায় ৫০০ সনেট লিখেছিলেন। উইলিয়াম হেনরি হাডসন তার Wordsworth and His Poetry বইয়ে ওয়ার্ডসআর্থকে The Greatest of English sonnet-writers হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি পেত্রার্কীয় রীতিতে সনেট লিখলেও ইতিহাসে তাঁর বিশেষ অবদান তাঁর উদ্ভাবিত নতুন রূপকল্পে যা নিম্নরূপঃ


কখখক : কগগক :: ঘঙঙঘ : চচ
কখখক : কগগক :: ঘঙঘঙ : চচ


আবার সিডনি (১৫৫৪-১৫৮৬)  প্রথমে পেত্রার্ককে অনুসরণ করলেও ইংরেজ কবি ওয়াট ও সারকে অনুসরণ করেন। সিডনির পর এডমন্ড স্পেন্সার অত্যন্ত সাড়া জাগান। তিনি ‘কবিদের কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে জন মিল্টন, শেলি, জন কিটস, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, ডি. জি. রসেটি, ক্রিশ্চিনা রসেটি, রুপার্ট ব্রুক প্রমুখ সনেট লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে ওয়াট এবং সারের পর ইংরেজি সাহিত্যে সনেটের প্রভাব দীর্ঘ দিনের জন্য হ্রাস পেয়েছিল, সেই ভগ্নদশা থেকে স্যার ফিলিপ সিডনির হাত ধরে সনেটের পুনরাগমন ঘটে; যাকে নতুন আঙ্গিক দিয়েছিলেন মহাকবি উইলিয়াম শেক্সপিয়র। তাই সারে নন, সিডনিই হচ্ছেন তার পথিকৃৎ। এলিজাবেথীয় যুগে তিনি যেমন সাড়া ফেলেছিলেন তেমনি সর্বসময় ব্যাপী ভিন্ন আঙ্গিকের সনেটীয়ার কবি হিসেবে শেক্সপিয়র বিশ্ব খ্যাত হয়ে আছেন।


এখানে আট চরণের স্তবক (Stenza ev Verse group) বা ‘অষ্টক’ (Octave) এবং পৃথক ছয় চরণের ‘ষটক’ (Sestet) মিলিয়ে দু’টি অংশ থাকে। অনেকে এই বিভক্তি অনুসরণ করেন না।
এখানে ভাবের যে গাম্ভীর্য ও সংযম থাকা আবশ্যক সেখানে যুক্তারমূলক মিল বা ডাবল মিল রাখা সমীচীন নয়।
সনেটের শেষ দুই বা এক পঙ্ক্তিতে ভাবের পূর্বতম অভিব্যক্তি থাকা প্রয়োজন। মিলবিন্যাসে সনেটের প্যাটার্ন অনুসরণ জরুরি। এখানে অহেতুক হস্তপে কাম্য নয়। পাশাপাশি স্বরান্ত মিলের দুর্বলতাকে পরিহার করে চলতে হবে। সনেটের এই বাঁধাধরা নিয়ম বেশ দৃঢ় বা কঠিন তা অনস্বীকার্য। তাই প্রমথ চৌধুরী তার ‘সনেট’ কবিতায় লিখেছেনঃ
"ভালবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন
শিল্পী যাহে মুক্তি লভে অপরে ক্রন্দন"
সনেটের মিলের কাজ প্রধানত দুটিঃ তা বিভিন্ন চরণকে একসূত্রে গ্রথিত করে সনেটের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে প্রয়োজনমতো চতুষ্ক, ত্রিক ও যুগ্মক সৃষ্টি করে। এইভাবে যে সাংগঠনিক একক (structural unit) সৃষ্টি হয় তার সাথে চিন্তা বা ভাবের একক মিলে যায় বলে ভাব ও রূপের দিক থেকে এককটি অতিরিক্ত শক্তি লাভ করে।
পেত্রার্কীয় বা ইতালীয় সনেটের মিলবিন্যাস সাধারণত ‘অষ্টক’ বা ১ম ও ২য় ‘চতুষ্ক’ মূলত একই যথা কখখক/কখখক/ রূপে প্রকাশ করা হয়। ‘ষটক’ হচ্ছে ১ম ও ২য় ‘ত্রিক’ সাধারণত গঘঙ/গঘঙ বা গঘ গঘ গঘ রূপে লিখিত হলেও এই মিলবিন্যাস ষটকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে দেখা যায়।


#সনেটের সাধারন বৈশিষ্ট্যঃ


★ সনেটে থাকে ১৪ টি চরণ/পঙক্তি।
★ সনেটের প্রথম ৮ চরণ/পঙক্তিকে বলে ‘অষ্টক’ এবং শেষের ৬ চরণ/পঙক্তিকে বলে ‘ষটক’।
★ অষ্টকে একটা ভাব ঘণীভূত হয়ে প্রকাশ পায় আর ষটকে তা ব্যাখ্যা থাকে।
★ সনেটে অষ্টক হচ্ছে মূল এবং ষটক হচ্ছে উপসংহার।
★ চার পঙক্তি/চরণ নিয়ে চতুষ্ক গঠিত হয়।
যেমনঃ
★ তিন পঙক্তি/চরণ নিয়ে  ত্রিপদীকা গঠিত হয়।
★দুই পঙক্তি/চরণ নিয়ে সমিল দ্বিপদীকা গঠিত হয় যেখানে শেষে মিল বিদ্যমান থাকে।
★ প্রত্যেক রীতিতে রচিত সনেটে অন্তমিল লক্ষ্য করা যায়
প্রত্যেক পঙক্তির পরিশেষে মিলের ক্রম বিন্যাসই অন্ত্যমিল।
যেমনঃ
কি দুঃখে, হে পাখি, তুমি | শাখার উপরে (৮+৬) ক
বসে, বউ কথা কও, | কও এ কাননে?- (৮+৬) খ
মানিনী ভামিনী কি হে | ভামের গুমরে, (৮+৬) ক
পাখা-রূপ ঘোমটায় | ঢেকেছে বদনে? (৮+৬) খ
[বউ কথা কও/মাইকেল মধুসূদন দত্ত]


→লক্ষ্য করুন এখানে প্রথম ও তৃতীয় পঙক্তির শেষে 'রে' অন্ত্যমিল এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ পঙক্তির শেষে 'নে' অন্ত্যমিল বিদ্যমান।
★ সনেটের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো ভোল্টা(Volta)। ভোল্টা মানে মেজাজ বদল। পেত্রার্কীয় রীতিতে অষ্টক থেকে ষটকে যাওয়ার সময় মেজাজ বদল ঘটে। শেক্সপিয়ারীয় রীতিতে শেষের দ্বিপদীকাতে মেজাজ বদল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া ফরাসী রীতিতে ষটকের প্রথম দ্বিপদীকাতে মেজাজ বদল লক্ষ্য করা যায়।
★ বাংলায় সনেট সাধারণত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত হয়।
★ সনেটে ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়েই কবি হৃদয়ের গভীর আনন্দ বা বেদনা বা বিশেষ অনুভূতি ব্যক্ত হয়।
★ সনেট গাঢ় বদ্ধ রচনা, তার দেহ সংহত এবং মিতায়তন।
★ সনেটে একটি মাত্র ভাবের দ্যোতনা লক্ষ করা যায়।
★ সনেট রচয়িতার কঠিন পরিমিতি বোধ কাম্য।
★ সনেটের ভাষা হবে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল যাতে কোনো দুর্বোধ্যতা থাকবেনা।


★ ছন্দের পয়ার বা Lambic Pentameter থাকা বাঞ্জনীয়।
lambic ছন্দ ইংরেজী কবিতার একটি বিশেষ ধারার ছন্দ, যে ছন্দে একটি Weak syllable-এর পরে একটি Strong syllable বসে foot বা পর্ব গঠন করে তাকে Iambic ছন্দ বলে।
যেমনঃ
Come live with me and be my love,
And we will all the pleasure prove
[The Passionate Shepherd to his love/Christopher Marlowe]
বাংলার পয়ার ছন্দটিকেও ঠিক একইভাবে ভেঙে দেখানো যায়ঃ
সুন্দর দেখিয়া গবী | কহিল স্বামীরে।
কাহার সুন্দর গবী | দেখ বনে চরে।।
দিব্যবসু বলে, এই | বশিষ্ঠের গবী।
কশ্যপের অংশ জন্ম | জননী সুরভী।।
[মহাভারত/কাশীদাসী]


#সনেটের শ্রেণীবিভাগ ও গঠনঃ-


• প্রসিদ্ধ সনেট মূলত দুই প্রকার।
১. পেত্রার্কীয় সনেট (Petrachan Sonnet)
২. শেক্সপীরিয়ান সনেট (Sexperian Sonnet)


• তবে আরো ৩ প্রকার সনেট যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে।
৩. স্পেনসেরিয়ান সনেট (Spenserian Sonnet)
৪. ফরাসী সনেট (French Sonnet)
৫. মিলটনিক সনেট (Miltonic Sonnet)


• এছাড়াও সাহিত্য জগতে আরো কয়েক প্রকার সনেটের রীতি লক্ষ্য করা যায়।
৬. টের্জা রিমা সনেট (Terza Rima)
৭. কার্টাল সনেট (Curtal Sonnet)
৮. আধুনিক সনেট (Modern Sonnets)
৯. অক্সিটান সনেট (Occitan Sonnets)
১০ কাওডেট সনেট (Caudate Sonnets)
১১ ওয়ার্ড সনেট (Word Sonnets)
ইত্যাদি।


• আমার সনেটের এই পর্ব আলোচনায় উপরে উল্লেখিত প্রথম সারির ৮ প্রকার সনেট গুলো সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো...


▪ পেত্রার্কীয়/ইটালিক (Petrachan/Italic Sonnet) সনেটঃ
সনেটের জনক ইতালিয় কবি ফ্রান্সিসকো পেত্রার্কের (১৩০৪-১৩৭৪) রচিত সনেটের রীতিকে 'পেত্রার্কীয় সনেট' বলা হয়। একে 'ইটালিয় সনেট'ও বলা হয়।
সনেটকে সুন্দর জায়গায় নিয়ে যান পেত্রার্কের মতো শক্তিমান কবি। ১৪ লাইনের কবিতাকে অষ্টক ও ষষ্টক এই দুইভাগে ভাগ করেন তিনি। ১৪টি চরণে সংগঠিত কবিতার প্রতিটি চরণে সাধারণভাবে মোট ১৪টি করে অক্ষর থাকে। এর প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক (Octave) এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক (Sestet) বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি থাকে।


লরা নামে একটি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে লেখা পেত্রার্কের প্রেমের কবিতাগুলো বিশ্বের সুন্দরতম প্রেমের কবিতা হিসেবে স্বীকৃত।


#পেত্রার্কীয় রীতির সনেটের বৈশিষ্ট্যঃ-


★ পেত্রার্কীয় সনেট ১৪ পংক্তির হয়। প্রথম ৮ পংক্তিকে ‘অষ্টক’ এবং পরবর্তী ৬ পংক্তিকে ‘ষটক’ বলে।


★ অষ্টক অংশে প্রশ্ন কিংবা বিবরণের মাধ্যমে কবিতার মূল ভাববস্তুর আভাস/অবতারণা দেওয়া হয় আর ষটক পর্বে সে প্রশ্নের বা অবতারণার উত্তর বা সমাপ্তি সূচিত হয়।


★ কবিতার মেজাজ বদল (ভোল্টা) ঘটে অষ্টকের পর।


★ এই সনেটে কখনও অষ্টক ও ষটক পৃথকভাবে অবস্থান করে আবার কখনও এক অবিভক্ত কবিতারূপে সনেটের সমগ্র গঠনটি পরিস্ফূট হয়।


★ পেত্রার্কীয় রীতিতে অষ্টক দুইটি 'চতুষ্ক' এবং ষটক দুইটি 'ত্রিপদীকা নিয়ে গঠিত। অর্থাৎ এর গঠন বিন্যাসঃ [৪+৪||৩+৩]


★ খাঁটি পেত্রার্কীয় সনেটের অষ্টকের মিল বিন্যাস নিম্মরূপঃ- (১) ১ম, ৪র্থ, ৫ম ও ৮ম পঙ্‌ক্তিতে এবং (২) ২য়, ৩য়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঙ্‌ক্তিতে মিল থাকে।
যেমমঃ
১ বসন্তের আগমনে | আজো আছে দেরি, [৮+৬] ক
২ পর্বতের স্তরে স্তরে | বিরাজে তুষার। [৮+৬] খ
৩ চুরি করে ফিকে রং | গোলাপী ঊষার [৮+৬] খ
৪ লাজমুখে ফুটিয়াছে | ঝাঁকে ঝাঁকে চেরি। [৮+৬] ক
৫ পত্রহীন শাখাগুলি | ফেলিয়াছে ঘেরি, [৮+৬] ক
৬ বসিয়া তাহার অঙ্গে | কুসুম আসার। [৮+৬] খ
৭ সে জানে,যে বোঝে অর্থ | ফুলের ভাষার, [৮+৬] খ
৮ বসন্তের ঘোষণার | তুমি রত্নভেরী। [৮+৬] ক


লক্ষ্য করুন এখানে ১ম, ৪থ, ৫ম এবং ৮ম পঙক্তির শেষে মিল 'রি' (দেরি/চেরি/ঘেরি/ভেরি) [ক] বিদ্যমান।
আবার ২য়,৩য়,৬ষ্ঠ এবং ৭ম পঙক্তির শেষে মিল 'র' (তুষার/ঊষার/আসার/ভাষার) [খ] বিদ্যমান।


ষটকে দুই বা তিন প্রকার ভিন্নতর অন্ত্যমিল বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
★ খাঁটি পেত্রার্কীয় রীতির অন্ত্যমিল নিম্নরূপঃ


• কখখক : কখখক :: গঘঙ : গঘঙ/ABBA : ABBA :: CDE : CDE
• কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘগঘ/ABBA : ABBA :: CDC : DCD
→অষ্টকের মিলবিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে খাঁটি পেত্রার্কীয় রীতির ষটকে নিম্নের চার প্রকার মিলবিন্যাসও ব্যবহৃত হয়ঃ
• কখখক : কখখক :: গঘগ : গগঘ/ABBA : ABBA :: CDC : CCD
• কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘঘগ/ABBA : ABBA :: CDC : DDC
• কখখক : কখখক :: গঘঘ : গঘগ/ABBA : ABBA :: CDD : CDC
• কখখক : কখখক :: গঘঙ : ঙঘগ/ABBA : ABBA :: CDE : EDC


#দুইটি পেত্রার্কীয় সনেটের উদাহরণঃ-


★ ১.
Italian Sonnet/Petrarchan Sonnet:
[{“The Sheaves”} /Edwin Arlington Robinson]


Where long the shadows of the wind had rolled, A
Green wheat was yielding to the change assigned;  B
And as by some vast magic undivined  B
The world was turning slowly into gold.  A
Like nothing that was ever bought or sold  A
It waited there, the body and the mind;   B
And with a mighty meaning of a kind   B
That tells the more the more it is not told.  A


So in a land where all days are not fair,  C
Fair days went on till on another day  D
A thousand golden sheaves were lying there,  C
Shining and still, but not for long to stay–  D
As if a thousand girls with golden hair  C
Might rise from where they slept and go away.  D
{Sestet}
[অন্ত্যমিলঃ  ABBA : ABBA :: CDC: DCD]


★ 2.
[{The New Colossus} /BY EMMA LAZARUS]


Not like the brazen giant of Greek fame, A
With conquering limbs astride from land to land; B
Here at our sea-washed, sunset gates shall stand B
A mighty woman with a torch, whose flame A
Is the imprisoned lightning, and her name A
Mother of Exiles. From her beacon-hand B
Glows world-wide welcome; her mild eyes command B
The air-bridged harbor that twin cities frame. A
{Octave}
“Keep, ancient lands, your storied pomp!” cries she C
With silent lips. “Give me your tired, your poor, D
Your huddled masses yearning to breathe free, C
The wretched refuse of your teeming shore. D
Send these, the homeless, tempest-tost to me, C
I lift my lamp beside the golden door!” D
{Sestet}
[অন্ত্যমিলঃ ABBA : ABBA :: CDC : DCD]


#বাংলা সাহিত্যে পেত্রার্কীয় রীতির সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ-


বাংলা সাহিত্যে পেত্রার্কীয় রীতির চর্চা বাংলা সনেটের সূচনা লগ্ন থেকেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১০৮ টি সনেটের বেশিরভাগই পেত্রার্কীয় রীতির প্রতিফলন ঘটেছে।এছাড়াও দেবেন্দ্রনাথ সেন, বিহারীলাল চক্রবর্তী, অক্ষয় কুমার বড়াল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিষ্ণু দে, কামিনী রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফররুখ আহমেদ, প্রমথ চৌধুরী, সতেন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ প্রমুখ কবি পেত্রার্কীয় রীতি অনুসরণ করে সনেট রচনা করেছেন। অনেকেই সনেটের এই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমানে কালের অনেক কবিও সনেটের এই প্রসিদ্ধ রীতি অনুসরণ করে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করতেছেন।


#বাংলা সাহিত্যের দুইটি পেত্রার্কীয় সনেটের উদাহরণঃ-


১.
★১৪ মাত্রার পেত্রার্কীয় সনেটঃ-


পেয়েছিনু আশীর্ব্বাদ | করেছিনু আশা (৮+৬) ক
আমার জীবনে হবে | পূর্ণ কোন দিন (৮+৬) খ
সেই পুরুষের বাণী। | যত স্নেহ ঋণ (৮+৬) খ
আনন্দে করিব শোধ; | মোর চিন্তা ভাষা (৮+৬) ক
বহি লয়ে যাবে মোর | মোর ভালবাসা (৮+৬) ক
পশি বৃহত্তর স্রোতে; | যদিও সে ক্ষীণ (৮+৬) খ
পার্ব্বতী সরিৎ যথা, নিজে নামহীন। (৮+৬) খ
নগণ্য, মিটাবে তব | কাহারো পিপাসা। (৮+৬) ক
{অষ্টক}
আপনার যতটুকু | ঢালিব নিঃশেষ, (৮+৬) গ
লুপ্ত ক্ষুদ্র স্বার্থ সুখ | বহুর ভিতর (৮+৬) ঘ
বাড়াইয়া শক্তি ভক্তি, | চেতনা, সাধন; (৮+৬) ঙ
নাম ধাম, জ্ঞাতি গোত্র, | জাতি ধর্ম দেশ (৮+৬) গ
সব ভেসে গিয়ে রবে | শুদ্ধ, অনশ্বর (৮+৬) ঘ
বিপুল জীবন নদ, | সত্য সনাতন। (৮+৬) ঙ
{ষটক}
{জীবন পথে: ঝরা ফুল (বহুর ভিতরে)/কামিনী রায়}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক : কখখক :: গঘঙ : গঘঙ]


২.
★ ১৮ মাত্রার পেত্রার্কীয় সনেটঃ-


সময়-শাশ্বত, স্থির। | শুধু এই খঞ্জন চপল   ক
গতিমান মুহূর্তেরা | খর স্রোতে উদ্দাম, অধীর   খ
মৌসুমী পাখীর মতো | দেখে এসে সমুদ্রের তীর,   খ
সফেদ, জরদ, নীল | বর্ণালিতে ভরে পৃথ্বীতল।   ক
সন্ধ্যাগোধূলির রঙে | জান্নাতের এই পাখী দল   ক
জীবনের তপ্ত শ্বাসে, | হৃদয়ের সান্নিধ্যে নিবিড়,   খ
অচেনা আকাশ ছেড়ে | পৃথিবীতে করে আসে ভীড়;  খ
গেয়ে যায় মুক্তকণ্ঠে | মৃত্যুহীন সঙ্গীত উচ্ছল।   ক
{অষ্টক: পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}
মুহূর্তের এ কবিতা, | মুহূর্তের এই কলতান    গ
হয়তো পাবে না কণ্ঠে | পরিপূর্ণ সে সুর সম্ভার,   ঘ
হয়তো পাবে না খুঁজে | সাফল্যের, পথের সন্ধান,-  গ
সামান্য সঞ্চয় নিয়ে | যে চেয়েছে সমুদ্রের পার;   ঘ
তবু মনে রেখো তুমি | নগণ্য এ ক্ষণিকের গান   গ
মিনারের দম্ভ ছেড়ে | মূল্য চায় ধূলিকণিকার।    ঘ
{ষটক: পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}


{মুহূর্তের কবিতা(মুহূর্তের কবিতা)/ফররুখ আহমেদ}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘগঘ]


----★★★-----


→চলবে...