▪ ফররুখ আহমদের সনেট কবিতাঃ-


মুসলিম রেঁনেসার কবি ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) একটি অসাধারণ কবিতাগ্রন্থের নাম ‘মুহূর্তের কবিতা’ সম্পূর্ণ সনেট কবিতাগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। প্রকাশের পরপরই সাড়া জাগিয়ে তোলে কাব্যাঙ্গনে। প্রকাশের কিছুদিন পরেই (১৯৬৪ সালে) সমালোচনা বের হয় পত্রিকায়। সমালোচনা করেন কবি-সমালোচক আবদুল কাদির এবং কবি-সমালোচক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। আবদুল কাদির লিখেনঃ ‘‘ফররুখ আহমদের অনেক সনেটেই কল্পনা ঐশ্বর্য ও ভাবের বিস্তার প্রচুর। তার কোন কোন সনেট বক্তব্য-প্রধান  হলেও কয়েকটি সনেট বাস্তবিকই গীতধ্বনিময় কবিতা। সাহিত্যে অনবদ্য সৃষ্টি ‘হাজারে না মিলে এক’। কাজেই স্বল্পসংখ্যক রচনার জন্যেই ফররুখ আহমদ সার্থক সনেটকার হিসাবেও মর্যাদার আসন পাবেন।
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ লিখেছেনঃ “মুহূর্তের কবিতা’য় বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে একটি বিশেষ জীবদৃষ্টি ও মানসধারা সম্মিলনের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে আছে। সনেটের নিপুণ শিল্পী হিসাবে ফররুখ আহমদের খ্যাতি সুদীর্ঘকালের; আলোচ্য সংকলনে এই নিপুণতার সঙ্গে এমন আর একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় উদ্ভাসিত হলো, যা এতদিন অধিকাংশ সমালোচকের কাছেই ছিল অপরিজ্ঞাত। সনেটের আঙ্গিকে ফররুখ আহমদ শুধু বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের সাধনা করেছেন এবং আরবী-ফারসী চলিত শব্দ ব্যবহার করেননি, এমন একটি ধারণা প্রায় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছিল, কিন্তু এ-ধারণাটি যে নিতান্তই ভ্রান্ত সে পরিচয় আলোচ্য গ্রন্থে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হলো।”
সনেটকেও মুহূর্তের কবিতা বলা হয়। তবে সে নাম বাঙালিদের জিহ্বায়-জবানে তেমন টেকেনি। সনেট বা চতুর্দশপদী-ই টিকে আছে এখনো। মুহূর্তে সৃষ্টি হয়ে সীমায়িত ফর্মে আটকানো হয় বলেই হয়তো কেউ তাকে এ নামে ডেকেছিল। তবে ফররুখের এ এক গ্রন্থ ছাড়া বাংলা ভাষায় মুহূর্তের কবিতা,  মুহূর্তের গল্প, মুহূর্তের নাটক, বা মুহূর্তের গদ্য নামে কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ আছে বলে আমার জানা নেই। ফররুখের আগেও না, পরেও না। কিন্তু ফররুখের কাছে সম্ভবত (বরং নিশ্চিতভাবে) এ নামই সবচে’ যুৎসই ও টেকসই মনে হয়েছিল। আজও উক্ত গ্রন্থের কবিতাসমষ্টিকে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তের জীবন্ত কবিতা, টসটসে তরতাজা প্রাণবন্ত কবিতা। গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকল কবিতার মূল বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, কীভাবে অর্ধশতবর্ষের আগের কবিতাও বর্তমানের জন্য সমানভাবে সত্য ও প্রযোজ্য। যেন আজকের ঠিক এ সময়ক্ষণের জন্য লেখা হয়েছিল এসব কবিতা। এখানেই একজন কবির কালজ, কালজয়ী ও কালোত্তর সফলতা। প্রতিভার পলিসে যুগের দূরত্ব ঘুঁচিয়ে নিজের সৃষ্টিকর্মকে সমকাল থেকে শাশ্বতকালে ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যেই একজন কবির শক্তি, স্বাতন্ত্র্য ও বুকউপচানো গৌরব নিহিত। তবু যুগের চরম নৈরাজ্যের দিকে দেখে কবির সন্দেহ হয়েছিল, মুহূর্তের এসব কবিতা ও কলতান সুরের সম্ভার খুঁজে পায় কি না? খুঁজে পায় কি না সফলতার পথের সন্ধান? তবে তিনি এও বলেছেন, নগণ্য ক্ষণিকের এ গান মিনারের দম্ভ ছেড়ে ধূলি কণিকার মূল্যই চায়।
কবির ভাষায়ঃ-


মুহূর্তের এ কবিতা | মুহূর্তের এই কলতান
হয়তো পাবে না কণ্ঠে | পরিপূর্ণ সে সুর সম্ভার,
হয়তো পাবে না খুঁজে | সাফল্যের, পথের সন্ধান,
সামান্য সঞ্চয় নিয়ে | যে চেয়েছে সমুদ্রের পার;
তবু মনে রেখো তুমি | নগণ্য এ ক্ষণিকের গান
মিনারের দম্ভ ছেড়ে | মূল্য চায় ধূলি কণিকার।


(মুহূর্তের কবিতা/ মুহূর্তের কবিতা)
[পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০]

মুহূর্তেই এবং মুহূর্তের জন্য যেসব চিন্তা-চেতনা-উপলব্ধি-ভাবনা কবিকে এবং কবির শিল্প-কৌতূহলকে নাড়া দিয়েছে, সেগুলিকে কবি মূল্যহীন মনে করেননি। মনে করেননি এগুলি মুহূর্তে ম্রিয়মান অপঝলক। এ রকম মনে করা একজন কবির জন্য উচিতও নয়। বিশেষ করে তিনি যদি হন স্বভাবজাত, প্রতিভাধর, প্রতিভাসচেতন ও নিরীক্ষাপ্রবণ কবি। মূল্যহীন মনে করেননি বলেই তিনি এগুলিকে চিরস্থায়িত্ব দান করেছেন কবিতার কিমিয়াজাত ভাষ্যধারায়। মুহূর্তের কবিতা’র অন্তর্ভুক্ত ‘দুর্লভ মুহূর্ত’ কবিতায় দেখতে পাই এর সত্যায়িত চিত্রায়নঃ


এমন মুহূর্ত আসে | এ জীবনে হয়তো ক্বচিৎ  ক
(সে মুহূর্ত, তবু আসে, তবু ফিরে আসে)  খ
যখন বিক্ষত মন | ব্যথা কিম্বা বিষণ সন্ত্রাসে  খ
পড়িতে চাহে না বাধা, | ফিরে পেতে চায় না সম্বিৎ  ক
ফিরে পায় তপ্ত বক্ষে | যে মুহূর্তে হারানো সঙ্গীত  ক
আকাশের, বাতাসের, | শিশির ঝরানো ঘাসে ঘাসে  খ
সমুদ্রের হৃদপিন্ডে- | অথবা প্রিয়ার বাহু পাশে  খ
প্রাণের মূর্ছনা মেশা | জীবনের আশ্চর্য ইঙ্গিত।  ক


জন্ম নেয় কবিতার | রক্ত দল তখনি জীবনে,  গ
যে কবিতা মিশে আছে | পৃথিবীর অরণ্যে, পাহাড়ে   ঘ
যে কবিতা অর্ধস্ফুট | গোলাপের পাত্রে সংগোপনে   গ
সুরভি প্রশ্বাসে আর | বিগত রাত্রির অশ্রুধারে   ঘ
শিশিরে; প্রকাশ যার | নিজেরে হারায়ে বারে বারে    গ
কাঁদিয়াছে বহু বর্ষ | অন্ধকার মাটির বন্ধনে।   ঘ


(মুহূর্তের কবিতা/দুর্লভ মুহূর্ত)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}
[অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গঘগঘগঘ]


জড়জগতের ঝড়ঝাপটায় এখন আমরা ও পুরো বিশ্ব কতটুকু ক্লান্ত? তা হয়তো কেউ-ই জরিপ দিয়ে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারবে না। কারণ যে ব্যক্তি বোঝানোর কসরত করবে, সে হয়তো আমাদের চেয়েও বেশি কষ্ট-ক্লান্ত। ক্লান্ত একই সঙ্গে বিশ্বমানবের শরীর ও মন, মনন ও মস্তিষ্ক; ক্লান্ত মানুষের সাধারণ ও বিশেষ বিবেক। ক্লান্তির শেষ কর্ম বা পরিণতি কী রকম? তা বৈজ্ঞানিকভাবে হয়তো কেউ প্রমাণিত করতে পারবে না। ক্লান্তি-কষ্ট পরিমাপের থার্মোমিটার না থাকতে পারে। তবে মানুষমাত্রই তা অনুভব করে একেকজন একেকভাবে। কবির কাছে কষ্ট-ক্লান্তি হৃদয়ের স্তব্ধতা ও বোবাত্ব দিয়ে অনুমেয়। ক্লান্তিবেদনায় সকল সুর থেমে যায়, নিভে যায় অনুভূতির সকল বাতিঘর। একটি পাখী যখন বেদনায় হিম হয়ে যায়, পাখাতে যখন পায় না সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার দুর্দান্ত গতি; নিঃসাড়-নিস্পন্দ যখন হয়ে যায় তার উড়ালমন, তখন সে আর ফেরে না বাসায়। মুক্তি তার কাছে অযুক্তিতে পরিণত হয়। তেমনি সমকালপ্লাবিত যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া কবির মন আর মুক্তি খোঁজে না শুধু অসার কথায়। কিন্তু যুক্তি ও মুক্তিবিহীন অসার জীবন নিয়ে কবি বাঁচতেও চান না। ভারগ্রস্ত জীবনে কবি ফিরিয়ে আনতে চান দুরন্ত প্রাণের মূর্ছনা। নতুন সৃষ্টির বিস্ময়ে জাগাতে চান উদ্দাম গতি। তাঁর (মানে সমগ্র জাতির) উড়ালোন্মুখ হৃদয় বজ্রবেগ সৃষ্টি করতে চান প্রমুক্ত হাওয়ায়। কিন্তু চরম দুঃখ ও হতাশার ব্যাপার হলো, চলিঞ্চু বিবেকদংশিত পরিস্থিতিতে, মৃত্যু-স্তব্ধ রাতের ছায়ায় এবং অবরুদ্ধ আবেষ্টনে সংগ্রামী মানুষ ও মানসের সকল সাহস ও শক্তি লুপ্তপ্রায়। কবির ‘ক্লান্তি’ কবিতায় যেমনঃ-


আমার হৃদয় স্তব্ধ, | বোবা হয়ে আছে বেদনায়,  ক
যেমন পদ্মের কুঁড়ি | নিরুত্তর থাকে হিমরাতে,  খ
যেমন নিঃসঙ্গ পাখী | একা আর ফেরে না বাসাতে;  খ
তেমনি আমার মন | মুক্তি আর খোঁজে না কথায়।  ক
যখন সকল সুর | থেমে যায়, তারা-রা হারায়,  ক
নিভে যায় অনুভূতি | আঘাতে, কঠিন প্রতিঘাতে,  খ
নিস্পন্দ নিঃসাড় হয়ে | থাকে পাখী, পায় না পাখাতে  খ
সমুদ্রপারের ঝড় | ক্ষিপ্র গতি নিশান্ত হাওয়ায়।  ক

মুখ গুঁজে পড়ে আছে | সে পাখীর মত এ হৃদয়  গ
রক্তক্ষরা। ভারগ্রস্ত | এ জীবন আজ ফিরে চায়  ঘ
প্রাণের মূর্ছনা আর | নবতর সৃষ্টি বিস্ময়,  গ
উদ্দাম অবাধ গতি | বজ্রবেগ প্রমুক্ত হাওয়ায়;  ঘ
অথচ এখানে এই | মৃত্যু-স্তব্ধ রাত্রির ছায়ায়    ঘ
রুদ্ধ আবেষ্টনে আজ | লুপ্ত হয় সকল সঞ্চয়।  গ


(মুহূর্তের কবিতা/ক্লান্তি)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}
[অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গঘগঘঘগ]


পঞ্চাশ বছর আগের একটি কবিতায়, কিংবা একটি কবিতার কিছু পঙক্তিতে আজকের জ্যান্ত বাস্তবতার রূপায়ন কী অসাধারণ ধারাভাষ্যে হতে পারে, তার একটি উদাহরণ দেখা যাকঃ-


দুঃস্বপ্নের রাত্রিশেষে | তাই আজ প্রার্থনা আমার
স্বর্ণ ঈগলের মত | মুক্ত হোক এই বন্দী মন,
আসুক পল্বলে ফিরে |জীবনের বিপুল স্পন্দন
দীনতার সব গ্লানি | ভেঙে যাক প্রাণের জোয়ার
সব ভ্রান্তি দূরে যাক, | পুড়ে যাক মিথ্যার বন্ধন;
বলে যাব মুক্তকণ্ঠে | এ পৃথিবী তোমার আমার।


(মুহূর্তের কবিতা/মুক্তি স্বপ্ন)
[পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০]


তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলে না দিলে যেকোনো পাঠক মনে করতে পারে, এগুলি সদ্যপ্রকাশিত কবিতার কিছু নির্বাচিত পঙক্তি, যেগুলোতে প্রত্যেকের হৃদয়ে জমে থাকা দুর্বিসহ জীবনকথার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ‘সাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র মতো আশরীরমন কৃত্রিম আধুনিক যুগের মানুষের ক্ষত অঙ্গ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত-পুঁজ। মানুষ, মানুষের জীবন ও জগৎ আজ বড়ই ক্লেদাক্ত। মানুষ আজ এ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, শান্তি চায়। চায় বেঁচে থাকার অধিকার। জাতি চায় স্বাধীন দেশের মাটির গন্ধ-স্পর্শ। কবিও একজন মানুষ (এবং অসাধারণ মানুষ) হিসেবে দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে স্বর্ণ-ঈগলের মতো মুক্ত হতে চেয়েছেন উক্ত কবিতায়। ফিরে পেতে চেয়েছে জীবনস্পন্দন। কবি শুধু প্রার্থনার হাত প্রসারিত করে ক্ষান্ত হননি। তিনি সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন অধিকারের ভাষা ‘বলে যাব মুক্তকণ্ঠে এ পৃথিবী তোমার আমার।


একটি কবিতাগ্রন্থে তাসবীর দানার মতো থরে-থরে সাজানো একশটি সনেট। কী নেই তাতে? জীবন-জগত, নিসর্গ-মাটি, রোমান্টিক কবিভাবনা, প্রেম-সৌন্দর্য-যৌবন, স্বদেশ-স্বজাতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য-ধর্ম, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, আদর্শানুরাগী কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন, সত্যে-সুন্দরে নিবেদিত কবিচিত্তের আত্মবিশ্লেষণ এবং এছাড়াও আরো অনেক কিছু। এত কিছুর পরও কবির হৃদয় অতৃপ্ত। তৃপ্তিপ্রয়াসী পিপাসিত কবিহৃদয়ে এখনো উত্তাল ঢেউয়ের স্রোত। সবকিছুকে কবির মনে হয়েছে শুধু নিমিষের রঙ, দরিয়ার গোত্রহীন বুদ্বুদ। যেখানে লক্ষ যুগ পলকেই মিটে যেতে পারে, সেখানে এসব বুদ্বুদের কান্না-হাসির খবরই বা কে রাখে? তবু মুহূর্তের আনন্দ একেবারে মূল্যহীন নয়। মুহূর্তের আনন্দও কখনো কখনো শাশ্বত আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দিক দিগন্তে। এরকম আনন্দের সঙ্গে উপমায়িত হতে পারে ‘মুহূর্তের কবিতা’। শাশ্বত ও চির আলোকোদ্ভাসিত আনন্দের জন্যই ১০০ তম সনেটেও কবির অসাধারণ অতৃপ্তিবোধ! কবির ‘শেষ কথা’য় যেমনঃ-


কিছু লেখা হল আর | অলিখিত রয়ে গেল ঢের,   ক
কিছু বলা হল আর | হয়নি অনেক কিছু বলা;  খ
অনেক দিগন্তে আজ | হয় নাই শুরু পথ চলা!  খ
কে জানে সকল কথা? | কে পেয়েছে সংজ্ঞা সময়ের?  ক
শুধু নিমিষের রঙে | এই সব গান মুহূর্তের  ক
অতলান্ত দরিয়ার | এসব বুদ্বুদ গোত্রহীন    গ
কখনো উঠেছে কেঁদে, | কখনো বা হয়েছে রংগীন  গ
দু’দল- খেলার ছলে | স্পর্শ নিতে পূর্ণ জীবনের।    ক


লক্ষ যুগ-যুগান্তর | মিটে যায় যেখানে পলকে  ঘ
সেখানে এ বুদ্বুদের | কান্না-হাসি, সংশয়িত কাল  ঙ
কতটুকু, তবু তারে | রাখে ঘিরে প্রদোষ সকাল  ঙ
রঙের বৈচিত্র্য দিয়ে, | অন্ধকারে তারার ঝলকে  ঘ
দূরের ইশারা এনে। | (মুহূর্তের অনন্দ উত্তাল   ঙ
উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে | দিক দিগন্তে শাশ্বত আলোকে)।  ঘ


(মুহূর্তের কবিতা/শেষ কথা)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}
[অন্ত্যমিলঃ কখখককগগক ঘঙঙঘঙঘ]


------★★------


▪ আল মাহমুদের সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ-


কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে ‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক চৌদ্দটি সনেট রচনা করে সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশিত হবার পর উভয় বাংলায় তথা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে আল মাহমুদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আজও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কোন কবির পক্ষে সোনালি কাবিনকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি।
ভাবে, ভাষায়, ঐতিহ্যের লালনে, শিল্পগুণ বিচারে সোনালি কাবিন যেমন অপূর্ব তেমন অনন্য হয়েই থাকলো।
কবি আল মাহমুদ ‘সোনালি কাবিনের’ চৌদ্দটি সনেট ছাড়াও ‘বখতিয়ারের ঘোড়ায়’ চারটি, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ এ একটি, ‘আমি দূরগামী’র ‘চতুর্দশপদী’, ‘দোয়েল ও দয়িতার ‘খরা’ সনেটগুচ্ছের ছয়টি, উড়াল কাব্যের ‘চতুর্দশপদী’, ‘দ্বিতীয় ভাঙনে’ ‘খনার বর্ণনা-সনেট পঞ্চক’ ইত্যাদি সনেটগুচ্ছ রচনা করেছেন।


সোনালি কাবিনের পর আরও ১৮টিসহ সর্বমোট ৩২টি সনেট পাওয়া যায়। লক্ষ্য করা যায় যে, বাংলা সনেটের প্রকরণগত এবং ভাবগত বিচারে সনেটেগুলোতে ভাবের ঐক্য, মেলবন্ধন এবং রূপকল্পের কোথাও শৈথিল্য নেই।
আল মাহমুদ মাটির সোঁদাগন্ধ ছড়ানো কবি। লোক-লোকান্তরে ভ্রম্যমান কৌম সমাজের আধুনিক বাসিন্দা। শিল্পের নন্দিত যাত্রায় উজ্জ্বল মশালবাহি কীর্তি ক্রিড়াবিদ। এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাসে নানা ফোঁড় ফোঁড়ন খেয়ে বাংলা কাব্যে অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময় আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তিনি সাহিত্যের মূলধারা থেকে বিচ্যুত। নাস্তিক থেকে আস্তিকে পরিবর্তিত। তথাকথিত সেকুলার না থেকে হয়েছেন ধার্মিক।
বাংলা সাহিত্য ও বাংলা কাব্যের মূলধারা কি? বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঐতিহ্য আমাদের যতটুকু জানা আছে তাতে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই বাংলা কাব্যে মূলধারার যাত্রা বিশ্বাস কেন্দ্রিক, ধর্ম কেন্দ্রিক। সেখানে সেকুলারিজমের কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘চর্যাপদ’ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব কেন্দ্রিক কবিতা। ‘বৈষ্ণবপদাবলী’ চৈতন্যধর্ম ও সনাতন ধর্মকেন্দ্রিক। ‘মঙ্গলকাব্য’ সমূহ লোকিক দেবদেবীর প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ও আস্তিকতায় ভরা। আল মাহমুদের বিশ্বাসের শিকড় রবীন্দ্রনাথের চেয়েও শক্ত। অন্ততঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। বিশ্বাসের ধারাটাই বাংলা সাহিত্যের মূলধারা। অবিশ্বাসী রাজনৈতিক ভেল্কিবাজির সাহিত্য চর্চার ধারাটি একটি ভন্ডামীর ধারা। রাজনৈতিকভাবে কিংবা ঘরনা কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা সার্বজনীন হয় না। বিশ্বাসের জায়গা যার যেমনই হোক রচিত সাহিত্য যদি নন্দনতত্ত্বের বিচারে সফল হয় তার সাহিত্য দেশকাল পরিবেশকে ছাড়িয়ে সর্বকালে সর্বজনের হয়ে ওঠে। আল মাহমুদের সনেটের ভাব সার্বজনীন, শাশ্বত ও চিরন্তন। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল নর-নারীর জৈবিক স্বভাব ও ধর্মকে শিল্পসম্মতভাবে ধারণ করেছে সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছ। সোনালি কাবিনের অখন্ড ভাব কল্পনা একান্ত কবির হলেও তার শিল্পরূপ ও আবেগের সার্বজনীনতা সকলকে ছুঁয়ে যায়। সনেট তো বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন থেকে শুরু করে অনেকেই রচনা করেছেন। কবিদের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি কখনো কখনো কারো কারো কাছে ভালো লাগলেও তার ভাব আ’ম পাঠকের সার্বজনীন বিষয় হয়নি। শিল্পগুণ ও প্রকরণের কারণে হয়তো কবিতার পাঠকের কোন কোন সনেট অসাধারণ মনে হয়। অথচ সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছ জৈবিক সত্যের শিল্পরূপ হওয়ায় সব পাঠকের কাছে সমান গুরুত্ববহ। সামগ্রীক বিচারে বাংলা সনেটে আল মাহমুদ যেভাবে পাঠক সমাজকে নাড়া দিয়েছেন সে বিচারে বলা যায় বাংলা সনেটে তিনি ভাবের দিক থেকে এক এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প র্কীতি নিয়েই দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলা সনেটের ধারায় সফল শিল্পীর মধ্যমণি আল মাহমুদ জনপ্রিয়তায় তাকে এখনো এক্ষেত্রে কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।


#কবি আল মাহমুদের সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্যঃ


★ বাংলা সনেটের মেলবন্ধনে আল মাহমুদ ইতালিয়ান সনেট ও শেক্সপিরিয়ান সনেট উভয় রীতিকে অনুসরণ না করে নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন।


★ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আঠার মাত্রার পংক্তি রচনা করেছেন তিনি। মধুসূদনের মতো ১৪ মাত্রার সনেট সোনালি কাবিনে নেই।
পর্ব ভাগ ৮+১০ কিংবা ১০+৮ মাত্রায় বিন্যস্ত।


★ মিলবন্ধনঃ কখ, কখ, গক, গক, ঘচ, ঘচ, ছছ।
আবার কখ, কখ, গঘ, গঘ, ঙচ, ঙচ, ঙচ, মিলবন্ধনও দিয়েছেন।
তাই বলে সনেটের বৈশিষ্ট্য ও ভাবের সংহতি কোথাও বিঘ্নিত হয়নি।
★ আল মাহমুদের তার কাব্যে ব্যক্তি বাঙালি কবি, আবহমান মানুষ, ইতিহাসের মধ্যে হৃদয়ের ইতিহাস গেঁথে দিয়েছেন। জনপদ, শস্য, হৃদয়-সবই  তার কাব্যের এক মহাসত্যের বিভিন্ন দিক। আর তার শব্দ আবহমান, চিরকালীন গ্রামঢু এবং লোকজ। গ্রামঢু লোকজ শব্দকে তিনি ওজস্বী ও অভিজাত করে উভয় বাংলায় চমক দেখিয়েছেন।


#কবি আল মাহমুদের সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ


★ ১.


সোনার দিনার নেই, | দেনেমাহর চেয়ো না হরিণী  ক
যদি নাও, দিতে পারি | কাবিনবিহীন হাত দু’টি,  খ
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ | কোনোকালে সঞ্চয় করিনি  ক
আহত বিক্ষত করে | চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;  খ
ভালোবাসা দাও যদি | আমি দেব আমার চুম্বন,  গ
ছলনা জানি না বলে | আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;  খ
দেহ দিলে দেহ পাবে, | দেহের অধিক মূলধন  গ
আমার তো নেই সখী, | যেই পণ্যে অলংকার কিনি।   খ
বিবসন হও যদি | দেখতে পাবে আমাকে সরল   ঘ
পৌরুষ আবৃত করে | জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না;  ঙ
তুমি যদি খাও তবে | আমাকেও দিয়ো সেই ফল   ঘ
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে | পরস্পর হব চিরচেনা   ঙ
পরাজিত নই নারী, | পরাজিত হয় না কবিরা;  চ
দারুণ আহত বটে | আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।  চ


(সোনালি কাবিন-১)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গখগখ : ঘঙঘঙ :: চচ]


★ ২.


পান খাও হে পন্ডিত | কথা কও রসভরা ঠারে  ক
না জানো ভেষজবিদ্যা | সার কর শাস্ত্রের বচন;  খ
পানের মহিমা বলি | শোনো স্বামী, খনার বিচারে  ক
শাওন পানের মাস। | এই লতা রাবণের ধন।  ক


এই পান মুখে দিয়ে | চার্বাকের বেদের বিরোধী  গ
গুয়ার সোয়াদ চেখে | পঞ্চমুখে ভজে ইহকাল;  ঘ
তির্যক যুক্তিতে কাটে | চতুর্বেদ, ব্রাহ্মণের বোধি;  গ
বলে এ জগৎ সত্য | অন্য সবি শূন্যের মাকাল।  ঘ


খান তো অনার্য কন্যা | প্রকৃতির ঠোঁটকাটা কবি  ঙ
জমিনের গন্ধ শুঁকে | ফলনের ভবিষ্য বাখানে;  চ
পানের মর্তবা বলি, | পানপাতা হৃদয়ের ছবি  ঙ
দানবের শস্য পান। | খনা জানে, পানের কি মানে!  চ


পান খান পন্ডিতেরা | কথা কন রসভরা ঠারে  ছ
না জেনে পানের মর্ম | পান সেবে সব অবতারে।  ছ


(খনার বর্ণনা: সনেট পঞ্চক-৪/আল মাহমুদ)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০; স্তবক বিন্যাসঃ ৩+৩+৩+২}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গঘগঘ : ঙচঙচ : ছছ]


★৩.


নদীর সিকস্তি কোনো | গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ-ক
যেমন শুনতে পেলে | অকস্মাৎ জলের জোয়ার-খ
হাতড়ে তালাশ করে | সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও-ক
সে নারী উন্মুক্ত করে | তার ধন-ধান্যের দুয়ার খ
অন্ধ আতঙ্কের রাতে | ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত-গ
তোমার শরীরে যদি | থেকে থাকে শস্যের সুবাস-ঘ
খোরাকির শত্রু আনে | যত হিংস্র লোভের আঘাত-গ
আমরা ফিরাবো সেই | খাদ্যলোভী রাহুর তরাস-ঘ
নদীর চরের প্রতি | জলে খাওয়া ডাঙার কিষঠু-ঙ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে | বাজখাঁই অধিকার তার-চ
তোমার মস্তকে তেমনি | তুলে আছি ন্যায়ের নিশান-ঙ
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় | দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার-চ
ফাটানো বিদ্যুতে আজ | দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান-ঙ
ঝড়ের কসম খেয়ে, | বলো নারী, বলো তুমি কার?-চ


(সোনালি কাবিন-১২)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০}
[অন্ত্যমিলঃ কখ,কখ,গঘ,গঘ,ঙচ,ঙচ,ঙচ]


____★★____


→চলবে...