▪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সনেটঃ-


মধুসূদনের পরবর্তীকালে বাংলা সনেটের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) নাম উল্লেখ করতে হয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে খুব বেশি মনোযোগ প্রদান করেননি তবুও তার সনেট চর্চা নেহাৎ কম নয়। তিনি প্রায় ২৮৮ টি চতুর্দশপন্থী কবিতা রচনা করেছেন। এর মধ্যে ৭৬ টিতে সনেটপন্থী মিলবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।


সনেটের রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ত পরিবর্তনশীল এক শিল্পী। সনেটের মিলবিন্যাস, পঙক্তি দৈর্ঘ্য নিয়ে নানা সময় তিনি নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন। নানারকম পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে সনেটের রূপ নির্মাণে অভিনবত্ব সৃষ্টি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের একটি প্রধান বিশেষত্ব হল, সনেট কবিতায় সুরারোপ করে গানে পরিনত করা। পাশ্চাত্যে সনেট গান হিসেবে গাওয়া হতো। মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রবর্তন করলেও তাতে সুরারোপ করেন নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম এই দক্ষতা দেখান।
"কড়ি ও কোমল" কাব্যগ্রন্থের 'গান রচনা' ও 'হৃদয় আকাশ', "মানসী" কাব্যগ্রন্থের 'তবু' সনেটটির নাম উল্লেখ করা যায়।


রবীন্দ্রনাথ পেত্রাকীয় ও শেক্সপীরীয় দুই রীতিতেই সনেট রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার 'প্রাণ' কবিতায় শেক্সপিয়রীয় ঢঙ লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেত্রার্কীয় বা শেক্সপীরীয় কোন রীতিই তেমন গ্রহণ করেননি। তিনি সনেট রচনার ক্ষেত্রে স্বকীয়তা ও বৈচিত্রের পরিচয় রেখেছেন। তার সনেটের মূখ্য বিষয় 'প্রেম'।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সনেটের আদর্শ খ্যাত এই দুই রীতির বাহিরে এসে 'আধুনিক সনেট' রীতিতে বহু সনেট রচনা করেছেন। তার সনেট রচনার উদাহরণ আছে নৈবেদ্য, উৎসর্গ, গীতালি, প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে । রবীন্দ্র সমকালীন বাংলা সাহিত্যে দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, কামিনী রায়, প্রমথ চৌধুরী, প্রিয়ংবদাদেবী সনেট রচনায় সবিশেষ কৃতিত্বের অধেকারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্বে সনেট রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মোহিতলাল মজুমদার, জীবনান্দ দাস, সুধীনন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, অজিত দত্ত, বদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ খ্যাতিমান কবি।
রবীন্দ্রনাথ যেনো তার অন্যান্য শাখার মূল যে প্রাণস্পন্দন অর্থাৎ সংগীতময়তা তাই ফিরিয়ে এনেছিল তার সনেটে। রবীন্দ্রনাথের সনেটে বিভিন্ন রকম ঢঙ লক্ষ্য করা যায়। কখনো শেক্সপিরীয়ান, কখনো পেত্রার্কীয় বা কখনো আধুনিক ঢঙ লক্ষ্য করা যায়।


#রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ঢঙ ও মাত্রায় লেখা সনেট/চতুর্দশপদী কবিতা বিশ্লেষণঃ-


রবীন্দ্রনাথের প্রসিদ্ধ ৭৬ টি সনেটর মধ্যে ১০ টি বিশেষ প্রকৃতির কল্প চতুর্দশী।
বাকি ৬৬ টি নিম্নলিখিত ১১ টি পর্যায়ে বিভক্তঃ
১) খাঁটি শেক্সপিয়রীয়ঃ ১১ টি (তিনটিতে আবর্তনসন্ধি আছে)
২) অনিয়মিত শেক্সপিয়রীয়ঃ ৩ টি (দুটিতে আবর্তনসন্ধি আছে)
৩) শিথিল শেক্সপিয়রীয়ঃ ২৯ টি (দশটিতে আবর্তনসন্ধি আছে)
৪) খাঁটি পেত্রার্কীয়ঃ ২ টি
৫) অনিয়মিত পেত্রার্কীয়ঃ ২ টি
৬) শিথিল পেত্রার্কীয়ঃ ২ টি
৭) অনিয়মিত মিলটনিকঃ ৫ টি
৮) শিথিল মিলটনিকঃ ৪ টি
৯) বিশেষ প্রকৃতির রোমান্টিকঃ ২ টি
১০) শিথিল ফরাসিঃ ৬ টি (একটিতে আবর্তনসন্ধি আছে)


এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের আধুনিক ধাঁচের কিছু সনেট লক্ষ্য করা যায়।


#রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার মিলবিন্যাসঃ-


★ সাত মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাত মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার সংখ্যা ১৫টি।


• কখকখ | গঘগঘ | ঙচঙচ | ছছ
কড়ি ও কোমলঃ স্মৃতি, কেন, পবিত্র প্রেম, অক্ষমতা, জাগিবার চেষ্টা, কবির অহংকার, বিজনে, সত্য-১ ।
মানসীঃ তবু
সোনার তরীঃ দারিদ্রা
সেঁজুতিঃ প্রাণের দান


এ পর্যায়ের ১১টি কবিতা খাঁটি শেক্সপিয়রীয় রীতিতে রচিত।


• কখকখ | গগঘঘ | ঙচঙচ | ছছ
কড়ি ও কোমলঃ আত্মাভিমান, আত্মঅপমান


সনেট দুটি অনিয়মিত শেক্সপিয়রীয় রীতিতে রচিত।


• কখকখ | গঘগঘ | ঙঙচচ | ছছ
চৈতালিঃ পূণ্যের হিসাব


এটি অনিয়মিত শেক্সপিয়রীয় রীতিতে রচিত।


• কখকখ | গঘগঘ | ঙচঙ | ছচচ
কড়ি ও কোমলঃ নিদ্রিতার চিত্র


একে বিশেষ প্রকৃতির রোমান্টিক সনেট বলা যেতে পারে।


• কক,খখ,গগ,ঘঘ,ঙঙ,চচ,ছছ
চৈতালিঃ ইছামতী নদী, সামান্য লোক, শুশ্রূষা ইত্যাদি।


উপরের সনেট গুলিকে আধুনিক সনেট বলা যায়।


★ ছয় মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছয় মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার সংখ্যা ২৭টি। নিচে কয়েকটির উদাহরণ দেওয়া হলো:


• কখকখ | গঘগঘ | ঙখঙখ | চচ
কড়ি ও কোমলঃ প্রাণ
• কখখক | গখগখ | ঘঙঘঙ | চচ
কড়ি ও কোমলঃ মরীচিকা
• কখকখ | গঘগঘ | ঙচঙচ | গগ
কড়ি ও কোমলঃ অস্তাচলের পারে
• কখকখ | গখগখ | ঙচঙচ | ছছ
কড়ি ও কোমলঃ প্রত্যাশা, শেষ কথা


উপরের সনেট গুলিকে শিথিল শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেট বলা যায়।


★ পাঁচ মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচ মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার সংখ্যা ২০টি। নিচে কয়েকটির উদাহরণ দেওয়া হলো:


• কখকখ | কখকখ | গঘগঘ | ঙঙ
কড়ি ও কোমলঃ বন্দী
সোনার তরীঃ মুক্তি
• কখকখ | কখকখ | গঘগ | ঘঙঙ
সোনার তরীঃ মায়াবাদ


উপরের সনেট তিনটিকে অনিয়মিত মিলটনিক সনেট বলা যায়।


• কখখক | গকগক | ঘকঘক | ঙঙ
কড়ি ও কোমলঃ শ্রান্তি
• কখকখ | কগকগ | গঘগঘ | ঙঙ
কড়ি ও কোমলঃ সত্য-২
• ককখক | খগখগ | গঘগঘ | ঙঙ
কড়ি ও কোমলঃ প্রার্থনা


উপরের সনেট গুলিকে শিথিল শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেট বলা যায়।
• কখকখ | গকগক | ঘঘক | ঙকঙ
কড়ি ও কোমলঃ চরণ
• কখখক | গকঘগ | ঘঘগ | ঙঙগ
কড়ি ও কোমলঃ চিরদিন-৩


উপরের সনেট গুলিকে শিথিল ফরাসী সনেট বলা যায়।


• কখকখ | কগঘগঘগঘ | ঙচঙ
কড়ি ও কোমলঃ গান রচনা
• ককখগ | খগঘগ | ঘখঙ চঙচ
কড়ি ও কোমলঃ গীতোচ্ছাস
• কখকখ | খকখগ ঘগঘঙ ঙঘ
কড়ি ও কোমলঃ যৌবন স্বপ্ন


উপরের সনেট গুলি গঠনগত দিক দিয়ে কোনো রীতিই অনুসরণ করেনা। সুতরাং এগুলোকে বিশেষ প্রকৃতির কলপ চতুর্দশপদী বলা যায়।


• কখকখ | গঘগঘ | ঙচঙচঙচ
উৎসর্গঃ সংযোজন-১৩


সামগ্রিক ভাবে এই সনেট বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করায় একে বিশেষ প্রকৃতির রোমান্টিক সনেট বলা যায়।


★ চার মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার সংখ্যা ৯টি। নিচে কয়েকটির উদাহরণ দেওয়া হলো:


• কখখক | খকখক | গঘগ | ঘগঘ
কড়ি ও কোমলঃ ছোটফুল
• ককখক | খকখক | গঘগ | ঘঘগ
কড়ি ও কোমলঃ চিরদিন-৪


উপরের সনেট গুলিকে অনিয়মিত পেত্রার্কীয় রীতির সনেট বলা যায়।


• কখকখ | কখকখ | গকগক | ঘঘ
কড়ি ও কোমলঃ কল্পনামধুপ


উপরের সনেটটিকে শিথিল পেত্রার্কীয় সনেট বলা যায়।


★  তিন মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিন মিলের রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার সংখ্যা ৪টি। নিচে কয়েকটির উদাহরণ দেওয়া হলো:


• ককখক | খখকখ | কখখ | গখগ
কড়ি ও কোমলঃ অঞ্চলের বাতাস
• কখকক | খককখ | কখকখ | গগ
কড়ি ও কোমলঃ দেহের মিলন
• কখকখকখকখ কখকখ | গগ
চিত্রাঃ ধুলি


উপরের সনেট তিনটিকে শিথিল মিলটনিক সনেট বলা যায়।


• কখকখ | কগকগ | কগকগ | কক
মানসীঃ নিভূত আশ্রম


• গঠনগত দিক বিবেচনায় একে শিথিল শেক্সপীয়রীয় সনেট ধরা যায়।


#রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন মাত্রায় রচিত সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ-


★ রবীন্দ্রনাথের ১৪ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বেশিরভাগ সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাই ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখেছেন। নিচে রবীন্দ্রনাথের "কড়ি ও কোমল" কাব্যগ্রন্থের 'ছোট ফুল' কবিতাটি উল্লেখ করা হলোঃ


আমি শুধু মালা গাঁথি | ছোটো ছোটো ফুলে,  ক
সে ফুল শুকায়ে যায় | কথায় কথায়!   খ
তাই যদি , তাই হোক, | দুঃখ নাহি তায়—   খ
তুলিব কুসুম আমি | অনন্তের কূলে।  ক
যারা থাকে অন্ধকারে, | পাষাণকারায়,  খ
আমার এ মালা যদি | লহে গলে তুলে,  ক
নিমেষের তরে তারা | যদি সুখ পায়,  খ
নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা | যদি যায় ভুলে!   ক
ক্ষুদ্র ফুল, আপনার | সৌরভের সনে   গ
নিয়ে আসে স্বাধীনতা, | গভীর আশ্বাস—   ঘ
মনে আনে রবিকর | নিমেষস্বপনে,   গ
মনে আনে সমুদ্রের | উদার বাতাস।  ঘ
ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি | কারো পড়ে মনে  গ
বৃহৎ জগৎ, আর | বৃহৎ আকাশ!  ঘ


কড়ি ও কোমল: ছোট ফুল/রবীন্দ্রনাথ)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৪}
[অন্ত্যমিলঃ কখখক | খকখক | গঘগ | ঘগঘ]


• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন সনেটে আধুনিক রীতির (কক,খখ,গগ,ঘঘ,ঙঙ,চচ,ছছ) প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এমন রীতিতে লেখা ১৪ মাত্রার দুইটি সনেট উল্লেখ করা যাকঃ


১.
অয়ি তন্বী ইছামতী, | তব তীরে তীরে   ক
শান্তি চিরকাল থাক | কুটিরে কুটিরে— ক
শস্যে পূর্ণ হোক ক্ষেত্র | তব তটদেশে।  খ
বর্ষে বর্ষে বরষায় | আনন্দিত বেশে   খ
ঘনঘোরঘটা-সাথে | বজ্রবাদ্যরবে  গ
পূর্ববায়ুকল্লোলিত | তরঙ্গ-উৎসবে  গ
তুলিয়া আনন্দধ্বনি | দক্ষিণে ও বামে  ঘ
আশ্রিত পালিত তব | দুই-তট-গ্রামে  ঘ
সমারোহে চলে এসো | শৈলগৃহ হতে  ঙ
সৌভাগ্যে শোভায় গর্বে | উল্লসিত স্রোতে।  ঙ
যখন রব না আমি, | রবে না এ গান,  চ
তখনো ধরার বক্ষে | সঞ্চরিয়া প্রাণ,   চ
তোমার আনন্দগাথা | এ বঙ্গে, পার্বতী,  ছ
বর্ষে বর্ষে বাজিবেক | অয়ি ইছামতী!  ছ


(চৈতালি: ইছামতী নদী/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৪}
[অন্ত্যমিলঃ কক,খখ,গগ,ঘঘ,ঙঙ,চচ,ছছ]


২.
সন্ধ্যাবেলা লাঠি কাঁখে | বোঝা বহি শিরে  ক
নদীতীরে পল্লীবাসী | ঘরে যায় ফিরে।  ক
শত শতাব্দীর পরে | যদি কোনোমতে  খ
মন্ত্রবলে অতীতের | মৃত্যুরাজ্য হতে  খ
এই চাষী দেখা দেয় | হয়ে মূর্তিমান,  গ
এই লাঠি কাঁখে লয়ে, | বিস্মিত নয়ান,  গ
চারি দিকে ঘিরি তারে | অসীম জনতা  ঘ
কাড়াকাড়ি করি লবে | তার প্রতি কথা।  ঘ
তার সুখদুঃখ যত, | তার প্রেম স্নেহ,  ঙ
তার পাড়াপ্রতিবেশী, | তার নিজ গেহ,  ঙ
তার খেত, তার গোরু, | তার চাষ-বাস,  চ
শুনে শুনে কিছুতেই | মিটিবে না আশ।  চ
আজি যার জীবনের | কথা তুচ্ছতম  ছ
সেদিন শুনাবে তাহা  |কবিত্বের সম।  ছ


(চৈতালি: সামান্য লোক/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৪}
[অন্ত্যমিলঃ কক,খখ,গগ,ঘঘ,ঙঙ,চচ,ছছ]


★ রবীন্দ্রনাথের ১৬ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ


• রবীন্দ্রনাথের "কড়ি ও কোমল" কাব্যগ্রন্থের 'গান রচনা' কবিতায় ১৬ মাত্রা লক্ষ্য করা যায়।
সনেটটি উল্লেখ করা হলোঃ


এ শুধু অলস মায়া, | এ শুধু মেঘের খেলা!  ক
এ শুধু মনের সাধ | বাতাসেতে বিসর্জ্জন;  খ
এ শুধু আপন মনে | মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা,  ক
নিমেষের হাসিকান্না | গান গেয়ে সমাপন।  খ
শ্যামল পল্লব পাতে | রবিকরে সারাবেলা  ক
আপনার ছায়া লয়ে | খেলা করে ফুলগুলি,  গ
এও সেই ছায়া-খেলা | বসন্তের সমীরণে!  ঘ
কুহকের দেশে যেন | সাধ ক'রে পথ ভুলি  গ
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি | সারাদিন আনমনে!  ঘ
কারে যেন দেব' ব’লে | কোথা যেন ফুল তুলি,  গ
সন্ধ্যায় মলিন ফুল | উড়ে যায় বনে বনে!  ঘ
এ খেলা খেলিবে হায় | খেলার সাথী কে আছে?  ঙ
ভুলে ভুলে গান গাই— | কে শোনে, কে নাই শো  চ
যদি কিছু মনে পড়ে, | যদি কেহ আসে কাছে!  ঙ


(কড়ি ও কোমল: গান রচনা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৮; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৬}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখকখ | কগঘগঘগঘ | ঙচঙ]


★ রবীন্দ্রনাথের ১৮ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ


• রবীন্দ্রনাথের "কড়ি ও কোমল" কাব্যগ্রন্থের 'চিরদিন-২'  কবিতায় ১৮ মাত্রা লক্ষ্য করা যায়। সনেটটি উল্লেখ করা হলোঃ


কী লাগিয়া বসে আছ, | চাহিয়া রয়েছ কার লাগি,  ক
প্রলয়ের পরপারে | নেহারিছ কার আগমন,  খ
কার দূর পদধ্বনি | চিরদিন করিছ শ্রবণ,  খ
চিরবিরহীর মতো | চিররাত্রি রহিয়াছ জাগি!  ক
অসীম অতৃপ্তি লয়ে | মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস,  গ
আকাশপ্রান্তরে তাই | কেঁদে উঠে প্রলয়বাতাস,   গ
জগতের ঊর্ণাজাল | ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি,  ক
অনন্ত আঁধার - মাঝে | কেহ তব নাহিক দোসর,  ঘ
পশে না তোমার প্রাণে | আমাদের হৃদয়ের আশ,  গ
পশে না তোমার কানে | আমাদের পাখিদের স্বর,   ঘ
সহস্র জগতে মিলি | রচে তব বিজন প্রবাস,   গ
সহস্র শবদে মিলি | বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর—  ঘ
হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি, | নাই তব হাসি কান্না মায়া—  ঙ
আসি, থাকি, চলে যাই | কত ছায়া কত উপছায়া!  ঙ


(কড়ি ও কোমল: চিরদিন-২/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৮}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক | গগকঘ | গঘগঘ | ঙঙ]

★ রবীন্দ্রনাথের ২০ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতাঃ-


• রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যার বিদায়, ক্ষনিক মিলন, যৌবন স্বপ্ন কবিতাগুলিতে ২০ মাত্রা লক্ষ্য করা যায়।
সনেটটি উল্লেখ করা হলোঃ


আকাশের দুই দিক হতে | দুইখানি মেঘ এল ভেসে,  ক
দুইখানি দিশাহারা মেঘ— | কে জানে এসেছে কোথা হতে!  খ
সহসা থামিল থমকিয়া | আকাশের মাঝখানে এসে।  ক
দোঁহাপানে চাহিল দুজনে | চতুর্থীর চাঁদের আলোতে।  খ
ক্ষীণালোকে বুঝি মনে | পড়ে দুই অচেনার চেনাশোনা,  গ
মনে পড়ে কোন্‌ ছায়া দ্বীপে, | কোন্‌ কুহেলিকা- ঘের দেশে,  ক
কোন্‌ সন্ধ্যাসাগরের কূলে | দুজনের ছিল আনাগোনা!  গ
মেলে দোঁহে তবুও মেলে না,|  তিলেক বিরহ রহে মাঝে—  ঘ
চেনা বলে মিলিবারে চায়,| অচেনা বলিয়া মরে লাজে।  ঘ
মিলনের বাসনার মাঝে | আধখানি চাঁদের বিকাশ—  ঙ
দুটি চুম্বনের ছোঁয়াছুয়ি, | মাঝে যেন শরমের হাস!  ঙ
দুখানি অলস আঁখিপাতা, | মাঝে সুখস্বপন- আভাস!  ঙ
দোঁহার পরশ লয়ে দোঁহে | ভেসে গেল, কহিল না কথা— চ
বলে গেল সন্ধ্যার কাহিনী, | লয়ে গেল উষার বারতা।   চ


(কড়ি ও কোমল: ক্ষনিক মিলন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
{পর্ব বিন্যাসঃ ১০+১০; মাত্রা সংখ্যাঃ ২০}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক | গকগঘ | ঘঙঙঙ | চচ]


------★★★------


→চলবে...