মোহনা এসেছে! জীবনের শেষ প্রান্তে!
এবার আমাকে এমন একটা তিন তলা জাহাজে উঠতে হবে
যে জাহাজে কোনো মাস্তুল নেই, যে জাহাজ চালকের একটা চোখে কাশ্মীরী কালো কাপড়ের ফিতে বাঁধা! সে সমুদ্রের নিঃসীম নীল আর লোনা গন্ধ ভালোবাসে। তাঁর হাতে, কব্জিতে রোদে পোড়া শুকনো লবণ, সেগুলো সে মাঝে মাঝে চেটেপুটে খায় ক্ষুধার্ত সিংহের মতো। সে আকাশের তারকারাজীর জ্যামিতি জানেনা, জানতেও চায় না; তাঁর কম্পাসও নেই।
এগুলো অবশ্য আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আমি তাঁকে এখনো দেখিনি। তবে এমন একটা বর্ণনা আমি মুক্তমঞ্চ নামে একটা কবিতার আসরে  "ভন্ড" নামের একজনের কবিতায় পড়েছিলাম।


তবে জানি এই তিনতলা পুরোনো জাহাজটায় আছে  একটা শ্মশান, একটা গোরস্থান,
আর একটা অতিকায় ইলেকট্রিক চুল্লি -- এই  তিনটির যে কোনো একটাকে বেছে নিতে হবে
যখন সময় হবে। কখন কার সময় হবে? আপনার সিকোয়েন্স নাম্বার যদি তিন হয়, তো জাহাজ টা
কোনো গভীর রাতে তিনবার "ভোঁ" বাজাবে, আমার সিকোয়েন্স নাম্বার হল গিয়ে ১৩।
অর্থাৎ আমাকে তেরোবার ওই গম্ভীর শব্দটা শুনতে হবে যখন আমার পালা আসবে।


এই তেরো নাম্বারটা আমাকে খুব জ্বালিয়েছে সারাটা জীবন। এই ব্যাপারে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, তবে এখন শুধু একটা উদাহরণ দেবো।  গভীর রাতে যখন আমার একমাত্র প্রেয়সী তার "ও'কে" লুকিয়ে আমাকে ফিসফিস করে টেলিফোন করতো ওপর তলা থেকে কিচেনে নেমে এসে,
তখন আপনারা বিশ্বাস করবেন না জানি, ওই টেলিফোন লাইনটাতে কোনো নিরুদ্দেশ থেকে পর পর ১৩ বার একটা খুব গম্ভীর ঘণ্টা বাজতো, ধীর লয়ে, ঢং,--- ঢং --- ঢং -- তেরোবার।
আশেপাশে কোনো চার্চ ছিলোনা ছিলোনা, না আমার দিকে, না ওর দিকে, না মধ্যখানে। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস যে ঘণ্টাটা বস্তুতঃ টেলিফোনের তারের ভেতরই জন্ম নিতো নিজে
থেকে, এবং সেটা সেটার জন্মস্থানে দুভাগ হয়ে টেলিফোনের তার বেয়ে বেয়ে আমাদের দুজনের কানের দিকে ভেসে আসতো। অত্যন্ত বিলম্বিত লয়ে! প্রায়ই!


-- "এই নীরু, তুমি শুনছো?"
--"হ্যাঁ শুনছি, আগেও শুনেছি"
--"তো? তোমার ভয় করেনা? এই শব্দটা কোথাথেকে আসছে? তেরো
    বার, আমি গুনেছি"।
-- "তুমি আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘণ্টা গুনছো? ভালো হবেনা
     বলে দিলুম, আমি কিনা কতো কষ্টে না ঘুমিয়ে জেগে আছি সারা
     রাত?"
-- "তোমার না ঘুমানোর অন্য কারণ আছে, সরাসরি বলে দিলেই
     পারো, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা"
--  "এই তর্ক করবে না বলে দিচ্ছি, আমি তাহলে টেলিফোনটা রেখে
      দোবো"
--  "না, না, স্যরি স্যরি টেলিফোনটা রাইখো না প্লিজ --"
--  "ক্কী, কি বললে? রাইখো না? আর স্যরি স্যরি বাংলিশ? তুমি
    জানোনা এমন সব উচ্চারণ আর বাংলিশ শুনলে আমার শরীরটা
    জ্বালা করে?"
--" (জনান্তিকেঃ আর আমার পিত্তিডা জইলা যায়গা তোমার এই
    পিতলা কথার বাতচিত শুইনা, -- হায় আল্লারে, তুমি আমারে রেহাই
    দেও, এই কলিকাতার বেগুনী বোগেনভিলা ভালবাসার মেয়েটার
    কাছ থেকে আমাকে রেহাই দাও),
    দুঃখিত, টেলিফোন রেখোনা  অনুরোধ করছি!"
-- "উম্"
-- "আমি ঘণ্টার ঘণ্টা গুনছি - নয় -- দশ -- এগারো -- বারো ---"
-- "হ্যালো, হানি বেবি হানি ডলি  সুইটি তুমি কিচেনে এতো রাতে
     কি করছো?" ওর "ওনার" কণ্ঠস্বর!
-- "জ্জ জ্জ জল আনতে নেমেছিলুম -- তো তুমি নেমে এলে কেন --
     ডাকলেই পারতে -- কি চাই এখন আবার?"
-- "সেটাতো তুমি জানো সুইটি হানি --  ট্র্যান্সপারেন্ট ম্যাক্সিতে ----"


-- "ঢং -ঙ ঙ ঙ-- তেরো"


--- ---
--- ---
আমি আপনাদের বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, Google সাহেব বলেছেন, আমি নাকি কর্কট রাশি, যাদের নাকি কোনোদিন বিশুদ্ধ প্রেম হয়না, তবে কর্কট কারো পক্ষে একবার দাড়াঁলে জীবন দিতে হলেও সেখান থেকে সরে যায় না। অর্থাৎ কাউকে ভালবাসলে বা মন দিয়ে ফেললে তার জন্য সব করতে প্রস্তুত তিনি। আর ১৩ নাম্বার টা নাকি তাদের জন্মে বৃহস্পতি রাহু কেতু।


যাই দেখি গিয়ে, ডেকে (deck এ)  দাঁড়িয়ে জাহাজটার মাঝি'সাব কি করছেন। যথারীতি ওনার দেখা পেলাম না, ভেবেছিলাম ওনার পায়ে পড়বো, সেটা হলোনা। আমার মনেহলো উনি আশেপাশে নেই নেই হয়েও কোথাও না কোথাও কাছেই আছেন, অন্ধকার আকাশে ওনার প্রতিবিম্বটা ক্রমশ ছায়া ছায়া হয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম হতে হতে একটা অতিকায় নিরাকার দৈত্য হয়ে গেলেন আকাশ ভেদ করে -- আমি ভাবলাম আমি এখন ওনার কাছে সমর্পণ করি -- কিন্তু পারলাম না আমি,  পারলাম না। কেবল দেখলাম  গভীর অন্ধকারে উত্তাল সমুদ্র।


বরং জাহাজটা দুলতে দুলতে গম্ভীর শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বললো
" ভোঁ --ও--ও " --
আমি গুনলাম "এ---ক"; এই শব্দটা ১৩ হবার আগে
আমাকে ঠিক করতে হবে আমি ঠিক কোথায় যেতে চাই,


( নিম্নের বাধ্যতামুলক সর্বাধিক একটা চেক বক্স পূরণ করো )


ক) শ্মশানটার চন্দন-না-পাওয়া কাঁঠাল তক্তার চিতাটাতে,
খ) নয়বা গোরস্থানটাতে -- কফিন হীন সরাসরি মাটির তলায়, ওদের
    কাফনের শাদা কাপড় নেই, তার বদলে আমাকে আমার ইচ্ছে মতো
    "ওর" একটা ব্যবহৃত লাল পাড় শাদা শাড়ি বেছে নিতে এলাউ
    করেছেন ওনারা, আহারে -- কাঠ গোলাপ, কাঠ গোলাপ --
গ) নয়বা, ইলেকট্রিক চুল্লিটাতে - ওদের বিদ্যুৎে ভোল্টেজ শর্টেজ - তাই
    আবার সেই কাঁঠাল তক্তা এখানেও।


বাই দ্য ওয়ে, আপনারা কি জানেন, কাঁঠাল তক্তার রং উজ্জল কমলা রং?


--- ভোঁ -ও-ও!  আমি গুনলাম "দু--ই" --- ।


আমি তখন অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরুর কথা ভাবছি, আমি জানি তুমি
বাঙ্গাল ভাষা আর বাংলিশ শুনলে  ক্ষুণ্ণা হও, তবু বলছি,
"প্লিজ, প্লিজ, না -- না, অনুরোধ অনুরোধ করছি, নিরুপমা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, এই জাহাজটাতে তোমার সাধের বেগুনী বোগেনভিলার গুচ্ছটা আনা হল না বলে, ওদের সিকিউরিটি এলাউ করলো না যে"


--- ভোঁ -ও--ও ---


আমি গুনলাম --- তি---ন!
-------------------------------------------------