(পটভূমিঃ অনেক যুগ আগে, উত্তর আমেরিকার একটা ছোটো ক্যাম্পাস শহরের আশেপাশে
কিছু কলকাতার বাঙালি, একজন বাংলাদেশী আর  বেশ কিছু ভারতীয়দের পিকনিক; একটা হ্রদের পাশে, শেষ বিকেলে)

-  এই, লেকের ডকে বসে তুমি একা একা কি করছো? সব্বাই ওখানে গাছের তলায় বীয়ার খাচ্ছে, ডলার দিয়ে পোকার খেলছে, আর তুমি কিনা একা একা ডকে বসে আছো?
-আমি ড্রিংক ফ্রিঙ্ক অতোটা করিনা, ডলার নেই, তাই জুয়োও খেলিনা, আমি জানি সেসব কথা আপনি জানেন, তো আপনার 'উনি' কোথায়?
- ওর কথা বাদ দাও, ড্রিংক করে ঘোলা চোখে  ডলার হারছে জুয়ো খেলতে খেলতে --- তো তুমিই বা কী করছো?
- ভাবছি! আমি একটা স্টাইলের কথা ভাবছি?
- ওঃ, দেখেছো তাহলে?
- কী দেখেছি?
- আমার নতুন স্টাইলের পুজোর ব্লাউজ? ব্রোকেডে জরির বুটি, হাই নেক, লং স্লিভ, শিকাগো ডেভন স্ট্রিটে পেয়ে গেলুম, অষ্টমীর দিন পরবো ভেবেছিলুম, তা আর হলনা!
- দেখি, যাঃ বাব্বা, আপনাকে তো হুজুরের, না না হুজুরানির মতো লাগছে, এটা আপনাদের দুর্গা মা র ভালো না ও লাগতে পারে, বরং বোরকা পরে ওয়াজের মাঠে যান, যাবেন?
- কি বললে? ওয়াজ না কি যেন একটা বললে? সেটা কি?
- সেটা আপনার না বুঝলেও চলবে । এমন পাঞ্জাবীর মতো হাতা,  টাইট গোল গলা, দম বন্ধ হয়ে যায়না? এটা একটা স্টাইল হল? যা কিছু সুন্দর সব ঢেকে আছে, আর, লেকে’র পানি থেকে পা ওঠান, আপনার শাড়ির পাড় পানিতে ভিজে যাচ্ছে!
- যা কিছু সুন্দর সব ঢেকে আছে? এই, তুমি আমাকে সিডিউস করছো? সেটা পারো তুমি? জেনে খুশি হলুম! তো, নাও জল থেকে পা তুললুম, শাড়ি ছড়িয়ে বসলুম!
- স্যরি, আমি কাউকে সিডিউস করছি না, একি, আপনার শাড়িতে এতো চোরকাঁটা বিধে আছে? বেছে দেই?
- নাঃ, তুমি আমার শাড়িতে হাত দেবে না, ভালো হবেনা বলছি!
- "দ্রোণ ফুল লেগে আছে মেরুন শাড়িতে তার –", দ্রোণ ফুল এখানে নেই, সেটা কি জিনিস আমি জানিনা, তাই চোরকাঁটার কথাটা উঠলো
- জার্নাল ১৩৪৬, আমি জানি এই কবিতা -- চাইলে সমস্ত কবিতা টাই বলে দোবো , তুমি আমার সাথে পাল্লা দিতে চাও? তা ও আবার জীবনানন্দ দাশের কবিতায়? পাগল?
- (মনে মনেঃ পাগলতো হয়েই আছি কতোদিন ধরে, সেটা আপনি বুঝলেন না) ঠিক আছে, এবার একটা অন্য কিছু বলি তাহলে
- বলো
- এই যে আপনার সুন্দর পায়ের পাতা, 'কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা, পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা'
- আবার সিডাকশান? তবে বলছি, ভারতচন্দ্র
- দুটোই ভুল বললেন, প্রথমে, আমি কোনো সিডাকশান করছিনা, একটা কবিতার নতূন স্টাইল খুঁজছিলাম মনে মনে, আপনাকে দেখে সেটা ভুলে গেলাম, আর তারপর, ওটা ভারতচন্দ্র নয়, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়!
-না আমি ভুল বলিনি! তুমি অতো ডিটেলস খোঁজো কেন? যা কিছু সুন্দর তা কিছুটা ঢেকে রাখা যায় না? যা কিছু ভাবো তার সবকিছু দিতে চাও কেন? যে পড়বে তাকে কিছুটা ভাবতে দাও, আর বড় গলা হলেই, হাতা কাটা খোলা পিঠ হলেই সে জামাটা সুন্দর? তুমি ফুল হাতার ভেতর   ' নগ্ন নির্জন হাত ' ভেবে নিতে পারো আমি সেটা জানি। হলো? আরো বলবো?
- আপনি বললে না শুনে পারি? এই যাঃ, আপনি হয়তো আবার ভাব্বেন সিডাকশান হচ্ছে!
- হ্যাঁ সেটা হচ্ছে, সিডাকশান হচ্ছে! তুমি ভেবেছো আমি সেটা বুঝিনা? তবে এই সিডাকশান থেকে যদি তোমার কবিতা আরেকটু ভালো হয়, আপত্তি কি? তোমার ভাবনা গুলোকে আমি চিনি, বড় বেশী উত্তাল আর এলোমেলো। ওগুলো গুঁছিয়ে, সীমিত ব্রোকেডে জরির বুটি দিয়ে সাজিয়ে নাও, বেশী জরি বুটি দিও না, তারপর হাই নেক, লং স্লিভ পরাও, দেখবে তোমার কবিতার কোনো স্টাইল লাগবে না, এমনিতেই সুন্দর হবে ---
- ঠিক আপনার মতো! না?
- আমি তোমার কবিতা?


দু পক্ষ ই নিঃসীম নীরব! সন্ধ্যা নেমেছে তখন নিঃশব্দে। ঝিলমিল! নির্জন লেকের জলের ছল ছল শব্দ যেন একটা ঝির ঝির ঢেউ তোলবার নতুন স্টাইল পেলো! ঢেউ গুলো ঘুরে ঘুরে কথা কয় “এই ‘আপনিটা’ যেন চিরদিন আপনিই থাকে”
লেকের জলে নিক্ষিপ্ত মার্কারি ল্যাম্পের বিচূর্ণিত রশ্মি রেখাংশর কণাগুলো হীরে পান্না হয়ে বলে ,"নইলে তোমাদের দু'জনার অনেক কান্না, অনেক কান্না, অনেক --- ---"! বলতেই থাকে, বলতেই থাকে, কেবল বলতেই থাকে ---