পুরানা দিনের মমিনসিং শহরে
ছেলেবেলায় আমাগো শানবাঁধানো ইঁদারার চত্তরের পাশে
একটা অতিকায় নিম গাছ আছিলো।
সেইটার ডাল পাতা ফুল ফাল বাকল সব নাকি অতিশয় স্বর্গীয়, আহা
সে কি সিমানাহীন স্বর্গীয়, সেই দাঁতের মাজন
সেইটার ডাল, পাতা, ফুল ফল ইঁদারায় পানিতে পইচা যেন
বেহেস্ত নসীব  আবে জমজম।


সেইসব দিনে, আমাদের সর্দি-কাশি
জ্বরজার হইলে সেইটার পাতা সেদ্ধ পানি খাইতে হইতো
শরীরে 'হাম' কিংবা ঘামাচি উঠলে
সেই পানিতে নাইতে হইতো,
আমার মা'র স্পেসাল সিলেটি জাফলংগি শিলপাটাতে
সেইটার ফল বাকল বাটা খাইতে হইতো, নয়বা শরীরে মাখতে হইতো
অনেকটা গায়ে হলুদ দেবার মতো আর কি।
বলতে গেলে আমার মা'য়ের কাছে
অই নিম গাছটা একটা ভারসেটাইল গাছ আছিলো।
তাতে কোনো সন্দেহ আছিলোনা।


কিন্তু আমার সমস্যাটা সেইখানে নয়, সেটা অন্য কোনোখানে।
রাত দুপুরে আমার মনেহইতো
অই গাছটা একটা ভূতভাত প্রেত প্রেতিনীর আড্ডাখানা
শত হইলেও এক রাইতে আমার মায়ের মতে একটা লক্ষীপেঁচা
একটা বিড়াল ছানাকে অই গাছটার খোপরে তুলে নিয়েছিলো।
বিড়াল বাচ্চাটার মা সেটাকে গাছটা থেকে নামিয়ে এনেছিলো,
তবে সেটা বাঁচেনি।
আমি বলেছিলাম, "লক্ষীপেঁচা? নাকি ভূতেরা জিকির করে
অই গাছটাতে সারা রাইত?"


সেটা যাই হোক, আমার একটা অন্য সমস্যা ছিলো
আমার বিপদের কথা হল গিয়ে এই যে
রাইত দুপুরে আউট হাউজে যাইতে হইলে কুয়া থাইকা
এক বদনা পানি নিয়া ওই নিম গাছটার
তলা দিয়া যাইতে হইতো। এমন ডর পাইতাম যে
হিসি ছাড়তাম জানালা দিয়ে গেঁন্দা ঝোপে
আর তার চেয়ে বেশী কিছু চাপলে দাঁত মুখ খিঁচে
চেপে রাখার চেষ্টা করতে হতো সকাল তক।
তবে  দুই একবার যে অ্যাক্সিডেন্ট হয় নাই
সেইটা হলফ কইরা কওয়া যায় না, শরম পাই ...


এমুন করেতো আর আট নয় দশ বছর বয়সে
সারাটা জীবন কাটানো যায়না।
যায় কি? আপনারাই বলুন!
তাই আমাকে খুব সৃজনশীল হতে হয়েছিলো।
(এই 'সৃজনশীল' শব্দটা আমি অনেকদিন পর
আমেরিকায় আইসা শিখেছিলাম একজন কলিকাতার মানুষের কাছ থাইকা,
যে কিনা বাংলার ভিত্রে ইংরাজি সইতে পারত না);


ভাবলাম অই নিম গাছটার মতোই আমি এমুন একটা এক লাইনের
'সুরাহ' বানামু যেইটা শুধু ভূত না, সব জায়গায় কাজ করবো।
এক লাইন হইতেই হইবো, কেননা আরবি আমি মুখস্ত করতে পারতাম না।


আমি ভূতের ভয়ের 'সুরাহ' খুঁজছিলাম,
মা একদিন বলেছিলেন আয়তুল কুরসী নাকি
সব পরিস্থিতিতে কাজ করে, তবে আমি তো
আয়াতুল কুরসি পুরাটা জানিনা, শুধু নামটা দিয়াই চলবো
ধইরা নিলাম।
এদিকে, আমার একমাত্র বন্ধু পঙ্কজ বলেছিল
ভয়ঙ্কর ভূত ও প্রেতাত্মার ভয় পাইলে
শিব, গনেশ বা বিষ্ণু ইত্যাদি মন্ত্র নাকি অব্যর্থ ।
আমি তখন কেন জানি ভাবতাম "শিব" শুধুমাত্র মেয়েদের পূজা নেন,
(কেন, সেইটা আপনারাই ভাইবা নেন,
আমি তখন বিজ্ঞান ক্লাশে ফুলের পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ এইগুলা শিখতাছি)
তাই ওনাকে বাদ দিলাম;
পুজার প্যান্ডেলে আর ক্লাসমেট হারাধনদের মিষ্টির ময়রা দোকানে
যেইখান থাইকা আমি প্রায়ই এক আনা পয়সা দিয়া
শাপলা পাতায় 'লাল হলুদ' বুন্দিয়া কিনতাম,
সেইখানে গণেশ দেবের মূর্তি দেইখা আমি তেমুনটা শিহরিত হই নাই  কখনো
তাই উনিও বাদ গেলেন।


তবে কিনা "বিষ্ণু" নামটাতেই আমি এমন মুগ্ধ ছিলাম যে বড় হলে আমি আমার
মা'য়ের দেওয়া মেয়েলি ডাক নামটা বদলাইয়া  বিষ্ণু রাখমু ভাইবা রাখছিলাম।
এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি, তখন থেকে ষোলো সতেরো বছর পর
আমার জীবনের একমাত্র প্রেয়সী যখন আমার ডাক নাম জানতে চেয়েছিলো
আমি থতমত খাইয়া তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলাম "বি...বি...ব্বি...বিষ্ণু"।
সে বলল, "বাঃ, তাহলে আমাকে তুমি বিষ্ণুপ্রিয়া বলে ডেকো, খুব রোমান্টিক। না?"
কিন্তু একটু পরেই সে বলল, "এই তুমি ঢপ্ দিচ্ছো, তুমি আমায় তোমার মা'য়ের লেখা
একটা চিঠি পড়তে দিয়েছিলে, এইমাত্র মনে হোলো, তোমার ডাকনাম টা
তোমার হাতের পাতার মতোই নরম আর বড্ড মেয়েলি,
--- ও মাগো, --- --- কি মেয়েলি কি মেয়েলি?",
"এই, এইটা কি একটা কমপ্লিমেন্ট, স্যরি প্রশংসা হইলো?"
"হি, হি, হি --, কি মেয়েলি --কি মেয়েলি!"
"আর তুমি যে তোমার সংস্কৃত কঠিন নামটা সহ একটা কমপ্লেক্স ফ্র্যাকসান, স্যরি জটিল ভগ্নাংশ?"
"ক্কী, কী বললে? ভালো হবেনা বলে দিলুম --- এই আমি চললুম --"
এই "জটিল ভগ্নাংশ" মেয়েটাকে নিয়ে পরে একদিন অনেক কিস্যা বলবো আপনাদের।
বরং এইসব কথা থাকুক এখন, আগে নিমগাছের কথায় ফিরা যাই।


পঙ্কজ পুরা বিষ্ণু মন্ত্রটা জানতো না, তাই আমি শুধু
"ওম ওহরজিতায়া নমহ্!" লিখে নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে।
আল্লাহ্‌ আর ভগবান ওনাদের ভেতর কোনজন বেশী প্রতাপশালী
সেইটা নিয়া আমার মনে অনেক সন্দেহ আছিল অই বয়সে,
পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকে জিগ্যাস কইরাও কোনো উত্তর পাই নাই।


তখন উপেন্দ্রকুমার বিদ্যাপিঠে ব্যাকরণ ক্লাশে "সন্ধি" পড়াইতেছিলো
তাই আমি ভাবলাম একটা সন্ধি বানাইলে কেমুন হয়।
শেষে আল্লা এবং ভগবানের কাছে ডাবল প্রটেকশানের জন্যে আমি আমার
এক লাইন "সুরা+মন্ত্রটা" বানিয়েছিলাম আমার অঙ্ক খাতায়
"আয়তুল কুরসী কুরসি যোগ বিষ্ণু ওম অপরাজিতা নমহ্ "
কুরসী বানানটা সঠিক জানতাম না বইলা অইটার দুইটা ভারসান,
'ওহরজিতায়া' ভুইলা যাইতে পারি এই ভাইবা এই শব্দটাকে
আমি বদলাইয়া অপরাজিতা বানাইছিলাম। না হয় থাকলোই একটু বাংলা।
মমিনসিঙ্গা ভূতেরা নিশ্চয় বাংলা বুঝবার পারবো। আর অই
'অপরাজিতা' শব্দটায় অই ফুলটার মতই একটুখানি যাদু মত ঘোর ঘোর আছে, নাকি?
তাই সেই শব্দটা যোগ করা হইলো।


নিমগাছের ভূত তাড়াতে আমার এই সুরামন্ত্রটা কাজ করেছিলো কিনা জানিনা,
অবশ্য জানালার ধারে গেন্দা গাছগুলা বেশিদিন বাঁচে নাই।
তবে এই আরবি-সংস্কৃত-বাংলা সংমিশ্রণ আবার এলো একদিন আমার জীবনে
যেদিন দেখলাম আমার সেইজনা একদিন টেক্সাস-মেক্সিকো সীমান্তে
লারেডো শহরের পাইন ওক্ ক্যাকটাস গাছের জংগলে
একটা শীর্ণ ঝর্ণার জলে হাটু তক নেমে সাত সকালে
গলায় আঁচল জড়িয়ে জবা ফুলের বদলে অন্যকোনো জংলি লাল ফুল দিয়ে
সূর্যের দিকে তাকিয়ে নমস্কার ভঙ্গিতে
"জবা কুসুম সংকাশ" পূজা করছে।


আচ্ছা? আপনারাই বলুন? সূর্য দেব কি নারীদের কাছ থেকে এই পূজা গ্রহণ করেন?
তাও আবার জংগলে জবা ফুল রিপ্লেস করে?
সেটা যাই হোক না কেন,আমি চুপি চুপি
ওর পেছনে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম
"আয়তুল কুরসী কুরসি যোগ বিষ্ণু ওম নমহ্ যোগ অপরাজিতা"  
কেন জানিনা সে বিন্দুমাত্র কুপিতা না হয়ে বরং
তার ট্রেডমার্ক লিওনার্দো দ্য ভিনচি মহিলার
শান্ত স্নিগ্ধ অথচ রহস্যময় মুচকি হাসিটা দিয়ে
আমার কপালে আর বুকে একটা জংলি লালফুলের পাপড়ি ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
"এই বিষ্ণু, তুমি জানো? বিশ্বাসে মিলায় ----" ইত্যাদি ইত্যাদি।
(আমি কিন্তু ওসব তেমনটা বিশ্বাস করিনি কখনো,
তবে আমি যে তাঁকে বিশ্বাস করতাম, তাই তার গভীর কালো দুটো
চোখের প্রত্যাশা মেটাবার জন্য বললাম ......"জানি"।)
--- --- ---
এবার আপনারাই বলুন, আমার আট-নয় বছর বয়সে কম্পোজ করা
সুরামন্ত্রটা কি আমার মা'য়ের নিম গাছটার মতো ভারসেটাইল ছিলো না?