ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব । সন্ধ্যায় শিক্ষকদের আড্ডার প্রধান কেন্দ্রস্থল । একজন ছোট-খাট ঘরনার মানুশ নির্দিষ্ট কোণে প্রতিদিন দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে বসে থাকেন । কাউকে না পেলে চুপচাপ সময় কাটান । তুখোড় দাবাড়ুরা প্রায়ই খেলতে আসেন এখানে । তিনি হারতে পছন্দ করেন না । তবু চাল ফেরত দেয়া তার সহজাত অভ্যাস । খেলায় জেতার পর উচ্ছ্বাস বা উত্তেজনা অনুভব করেন না । আর কখনো হেরে গেলে তার মাঝে অনুতাপ বা বিষাদ বোধও কাজ করে না । দাবা তার জীবনের দ্বিতীয় নেশা ।
প্রথম নেশা ? জীবন যাপন ? তার কথায় - "জীবন যাপন করার মধ্যেই আছে ওই বই পড়াটা । বই ছাড়া জীবন অকল্পনীয় ।" সাহিত্য-শিল্পকলা-অর্থনীতি-রাষ্ট্রবিজ্ঞান-রাজনীতি-নৃতত্ত্ব-ইতিহাস - জ্ঞানের সকল শাখায় তার অশেষ আগ্রহ । শুধু ধর্ম বিষয়ে তার মন্তব্য - "পাঁচ-ছয়শ বছর আগে মানুশেরা সত্যি বিশ্বাস করতো এ-জীবন নশ্বর, আসল জীবন পড়ে আছে সামনে মৃত্যুর পরে । এখন ধর্ম বলতে যা বলা হয় তা আমি বুঝি না ।" তিনি কি বিশ্বাসী ? তার কথায় - "বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথাটা উঠে না; কারণ ধর্ম সম্পর্কে কথাবার্তা বলার আগ্রহ আমি কখনো বোধ করি না ।" যা কিছু মানব কেন্দ্রিক তাতে তার আগ্রহের পরিমাণ আকাশ ছোঁয়া ।
আর এই মানুষটি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জাতীয় অধ্যাপক কিংবদন্তী আব্দুর রাজ্জাক । বাঘা বাঘা শিক্ষকদের কাছেও তিনি 'শিক্ষকের শিক্ষক' হিসেবে পরিচিত । অথচ প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার বাজারে তাঁর অযোগ্যতা সব শিক্ষকের থেকে বেশি । তিনি ছিলেন শুধু এম এ পাশ । প্রায় ৩৫ বছর লেকচারার থেকে শেষে সহকারী অধ্যাপক হয়েছিলেন; তাও বয়েস কোটায় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে ! কখনো কোন বই লিখেন নি । তার নিজের বক্তব্য - "আলস্যবশত । হয়ত বা জেনেছি, তাও খুব অকিঞ্চিৎকর । তবে এটা প্রতারণাও হতে পারে ।" সুদর্শন বা ভালো বক্তা - এই দুটার একটাও যদি থাকতো ! বরং মুদ্রাদোষ ছিল অসংখ্য । এত উদাসীন ছিলেন নিজের ব্যাপারে যে বাসি ভাত প্রায়ই খেতেন । অবিবাহিত ছিলেন সারা জীবন । তার মানে মেয়েদের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না ? তাঁর কথায় - "অনেক সুন্দরী দেখেছি, মুগ্ধও হয়েছি । কাউকে কাউকে হয়ত এক-আধ মিনিট দেখেছি... মেয়ে দেখলে তো আবেগ জাগবে, মেয়েই তো দেখি নাই ।" কিন্ত বাঙ্গালী বা পশ্চিমা যেমন নারী-ই হোক না কেন সেটির মনন শুধু নয় - দেহসৌষ্ঠব সম্পর্কেও তাঁর স্বচ্ছ ধারণা ছিল । তবে নেশা বলতে যা বুঝায় তাতে তাঁর কথা - "তামাক খাই, দাবা খেলি, রান্নাবান্না করি ।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০বছরেরও অধিক কাল শিক্ষকতা করেছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক । ছাত্রও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই । ইচ্ছে ছিল সাহিত্যে পড়ার - কিন্ত পঠিত বিষয় ছিল - রাজনৈতিক অর্থনীতি । লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স - এ বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কীর অধীনে গবেষণা কাজে সুদূর বিলেত গিয়েছিলেন ১৯৪৫সালে । শেষ সময়ের মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্নকর্তা পাদটীকায় রেফারেন্স নেই কেন জানতে চাইলে তিনি ইতস্তত হয়ে বললেন - "ভুলে টাইপ করা হয় নাই, তবে রেফারেন্সগুলো আমার মনে আছে । কোনটা আপনি জানতে চান ?" এতটাই উদাসীন ছিলেন তিনি । অধ্যাপক লাস্কী মারা যাওয়ায় তিনি আর কাউকে যোগ্য মনে করেন নি । ফলাফল গবেষণায় ইস্তফা দিয়ে এসে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান ।
সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে ১৭জন উপাচার্যের মধ্যে মাত্র দুজনকে তাঁর পণ্ডিত মনে হয়েছে; বাকিরা - "তারা চাকরি করেছেন ।" তাঁর সাবলীল স্বীকারোক্তি । শুধু কী উপাচার্য - তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান সম্পর্কে বলেছেন - "আমি এ-দেশের জাতীয় অধ্যাপক, বিদেশে গিয়ে যদি সহকারী অধ্যাপকও হতে না পারি - তবে মহিমা থাকে কোথায় ? শিল্পী-কবি-শিক্ষক-সেনাবাহিনী-আমলা সবকিছু মাপার জন্যই দরকার আন্তর্জাতিক সাম্যের মাপকাঠি ।" এমন কি তাঁর ক্লাশ নেয়ার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেছেন - "ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হত । মনে হতো আহা, ওদের কোনকিছুতেই কোন আগ্রহ নাই । আমার কথায় তো নয়-ই ।... পুরনো কলাভবনে আমার ক্লাসের পাশেই ছিল একটা পুকুর । সেই পুকুরে হাঁস ভাসতো অনেকগুলো । আমি জানলার বাইরে পুকুরের হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘণ্টা শেষ করতাম ।"
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক নিজেকে প্রথাগত বা প্রথাবিরোধী কোনটাই মনে করতেন না । তিনি মানবতাবাদী না বুর্জোয়া এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁর হাসিই বুঝিয়ে দিত তিনি একটিরও না । তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে । আর অভিজ্ঞতায় ? তাঁর অভিজ্ঞতায় - "একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম । সেখানে দোকানে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই কম্যুনিজম সম্পরকে, শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে । সুতরাং ওই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বুঝার জন্য হাফেয হওয়ার দরকার নাই ।" বাংলাদেশর সামগ্রিক অধঃপতন কি তবে তাঁকে নিঃস্পৃহ করে তুলেছিল ? জবাবে তাঁর বক্তব্য - "আমি এর সঙ্গে একেবারেই এক মত নই । বরং আমার কাছে এই এলাকাটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এলাকা বলে মনে হয় । বাংলাদেশে ছোট থেকে বড় হওয়া - তুচ্ছ অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার যে সুযোগ রয়েছে, তা এই উপমহাদেশের আর কোথাও নাই । শুধু উপমহাদেশ কেন সারা পৃথিবীতেও নাই ।...আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝি সেখানকার কৃষ্ণকায়দের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কোন সুযোগ নাই, কিন্ত বাংলাদেশের অধিবাসীদের সে সুযোগ আছে ।" তিনি আরও বলেন - "আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই যে আমাদের বিপুল সংখ্যক তরুণ পৃথিবীর প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের সমতুল্য বা প্রায় সমতুল্য ।" তবে তিনি আশাবাদী ? তাঁর কথায় - "আমি জানি না । আমি তথ্য নিই, আর তথ্য ভিত্তি করেই সিদ্ধান্তে পৌছি ।" বিজ্ঞান বিষয়েও তাঁর আগ্রহ দেখেও বুঝা যায় তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করতে ভালবাসতেন । আর শিল্পবোধ ? তাঁর মতে - "গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীল মানুশ, তবে মানুশ হিসেবে তারা এমন যে তাদের সাথে বাস করা কঠিন । আমরা শিক্ষকেরা তো পাণিনিও না - পাণিনির টীকাকার মাত্র ।"
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্বসূচক কিছু অভিজ্ঞতা মানুশের কাছে মুখরোচক গল্প হয়ে উঠলেও তাঁর জীবন ও কর্ম বিষয়ে অজ্ঞতা অনেকাংশে স্পষ্ট । প্রদীপের ঠিক নিচেই যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি তাঁর উত্তরসূরিদের অনেকেই অপব্যাখ্যা প্রচার করেছেন বোধের অজ্ঞানতায় বা স্বার্থে । তবু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সমালোচনার দোষ মুক্ত নন । লিখার উদ্দেশ্য ব্যহত হবে বলে সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক । তাছাড়া তাঁর বক্তব্য বা জীবনাচরনের ইতিবাচক দিকগুলো অনুধাবন করা আশু বিবেচ্য বিষয় । জ্ঞান আহরণ অন্ধের হাতি দেখার মত । শুধু লেজ,পা বা মাথা ধরে হাতির আকৃতি সম্পর্কে ধারণা নিলে তা জ্ঞানের বিকৃতির সমতুল্য । তাই সর্ববিষয়ে আগ্রহ এবং অধ্যবসায় আবশ্যক । তবে সে জন্য পার্থিব সাফল্যকে পরিহার করার মত মানসিকতা অর্জন করতে হবে যা আসবে জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই । জীবন যাপনের অবশ্যম্ভাবী অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে মানুশকে যেতে হয়-ই; তাই জীবনচর্চার চেয়ে আবশ্যক জ্ঞানচর্চা অর্থাৎ বই, বই এবং বই । জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত নিঃস্পৃহতার বিন্দু-বিসর্গ ও - যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখের চেয়ে বেশি অনুভূতিশীল ; সেটা আব্দুর রাজ্জাক প্রমাণ করে গিয়েছেন ।
শুরুর দাবা প্রসঙ্গে আবার আসি । অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক দাবা খেলায় হারতে পছন্দ করতেন না ; অথচ প্রতিপক্ষকে চাল ফেরত দিতেন নির্দ্বিধায় । এই না হারার মনোভাবটা অহম নয় বরং তাঁর সুতীব্র ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ । চাল ফেরতের মাঝে বীরত্ব দেখানোর কিছু নয় - ইচ্ছার ক্ষমতাকে যাচাই করার সত্য অভিপ্রায় । অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক জেতার পর উল্লসিত হতেন না । তিনি সুখকে সুখী ভাবে অনুভব করতেন - উত্তেজনা দিয়ে সুখ বিনাশের আত্মঘাতী ভুল সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন । অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক খেলায় হারলে বিষাদগ্রস্ত হতেন না । দুঃখের হাহাকারের দৈনতা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন । তাঁর কাছে চাল ফেরত দেয়ার আনন্দ কিংবা হারার পর তা অতিক্রম করার আগ্রহটাই মুখ্য ছিল । অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর বাস্তবিক জীবনে এসব মৌল অনুভুতি খুঁজে গেছেন বই- এর মাঝে; যা সত্য । দাবার বোর্ডে অনুপ্রাণিত হওয়ার মত অসাধারণ চাল তিনি অনেক দিয়েছেন । জীবন দাবার ঘুঁটি চালনার মতই । পর্যবেক্ষণ,অন্তরলোকে অনুধাবন,বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ - এসবের সম্মিলিত ঘুঁটির ভারসাম্যের নাম-ই জ্ঞান । এই কিংবদন্তী অধ্যাপক জীবনভর বাস্তবিকই দাবা খেলে গেছেন - যা প্রতিটি মুক্তিকামী মানুশের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত । "জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত হলেই জন্ম নেন একজন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ।
                                                             মাহবুব শাকী


তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া;
হুমায়ূন আজাদ এর নেয়া সাক্ষাৎকার ইত্যাদি