সুখ-দুঃখ, প্রেম-অপ্রেম - এসব ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়াও অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে এই ‘সাক্ষাৎকারে’ । সাধারণের সাথে শিল্পীদের পার্থক্য কোথায়; সমাজ-শিল্প-সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা কেমন- এসবের প্রশ্নোত্তরে ‘একজন কবির’ স্বরূপ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছি । ‘ভবিষ্যৎ কবি’ কেমন হতে পারে সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন ‘কবি’ । কবির দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়ে একজন পাঠক নিজেকেই নতুন ভাবে আবিষ্কার করবেন বলেই আশা করছি ।
প্রশ্নোত্তরে ‘আত্মকথন’- এই ধারনাটি নতুন নয়; তবে সময় এবং বিষয়বস্তর বিচারে আধুনিকতম ।


*** কেমন আছেন ?
-- ভাল না খারাপ তা নিয়ে আমার কোন বোধ কখনো কাজ করে না । তবে উদ্দীপ্ত হওয়ার মত এমন কিছু ঘটছে না যা দেখে আশাবাদী হতে পারি - চারপাশে শুধু পুনরাবৃত্তিই চোখে পড়ে ।


*** কবি চরত্রটি সমাজের চোখে ‘রহস্যময়’ বলে বিবেচিত । এই রহস্যময়তাই কী কবির ধর্ম ?
-- কবির ধর্ম কবিত্ব । তবে রহস্যময় মনে হবার পিছনে যৌক্তিক কারণ আছে । কবির কাজ হচ্ছে নিজের ভিতরে প্রবেশ করা । এটি এমন এক কাজ যেখানে সাধারণের যাতায়াত নেই । সাধারণের দৃষ্টি থাকে সামাজের দিকে । যার জন্য মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য গড়ে উঠে । তাছাড়া আগেকার কবিদের সামাজিক অবস্থান ছিল । রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ পদে কবিদের নিয়োগ দেয়া হত । এখনকার কবিরা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় ভাবে কোথাও স্বীকৃত নন । নির্দিষ্ট অবস্থান না থাকলে রহস্যময় মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ।


*** কবির সামাজিক স্বীকৃতি কি দরকার বলে মনে করেন ?
-- অবশ্যই না । কবিরা রাজসভা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে মননের বিকাশ সম্ভব হত না । বেতনভোগী কবি কখনোই আজকের কবি হতে পারতো না ।


*** অন্যান্য শিল্পীর থেকে একজন কবির পার্থক্য মূলত কোথায় ?
-- কবিত্ব বোধটি সব শিল্পেরই সারকথা । তবে কবি সত্ত্বার মত এতটা ‘মনস্তাত্ত্বিক’ চর্চা অন্যকোন শিল্পে নেই, অন্য শিল্পগুলো কম-বেশি সমাজনির্ভর, একমাত্র কবিই অন্তর্দৃষ্টিনির্ভর । ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই আধুনিক শিল্পকলার জন্ম হয়েছে । শিল্পচর্চার নিরিখেই আমি কবিকে অনান্যদের চেয়ে উৎকৃষ্ট মনে করি ।


*** তার মানে কবিত্ববোধই সাধারণ আর শিল্পীর মাঝে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে…
--কবিত্ববোধ যে কারো থাকতে পারে । এই বোধটি যিনি শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন তিনই শিল্পী । কবিতা না লিখে কবি, কিংবা না নেচেই নৃত্যশিল্পী- এমনটা সম্ভব নয় । কবিত্বকে এক অর্থে বন্ধুত্বের সাথে তুলনা করা যায় । বন্ধুত্ব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আর কবিত্ব আত্মকেন্দ্রিক চিন্তায়- উভয়ের কোন স্বার্থ নেই, বরং স্বার্থ ভাঙার অভ্যাস করতে হয় । সকল ‘ভালকিছুর’ মূলেই রয়েছে এ-দুটো উপলদ্ধি ।


*** আপনার দৃষ্টিতে কবিই কি সবচেয়ে মহৎ বলে বিবেচিত?
-- কবিত্ববোধ পরিমাপের মানদণ্ড নেই । একজন কবির চেয়ে একজন সাধারণও বেশি মাত্রায় কবিত্ব ধারণ করতে পারেন । তাছাড়া কোন কবি সবসময়ই গভীর বোধের মাঝে থাকবেন তাও সম্ভব নয় । কোন বিশেষ মুহূর্তেই শৈল্পিক প্রকাশ ঘটে, আর তাই হল কবিতা । তবে মহৎ মানুষের অধিকাংশ শিল্পীরাই, সেটা তাদের চর্চার কারণে । অন্য একটি বিষয় সবারই বুঝা উচিত বলে মনে করি । ইদানিং ‘কবি’ শব্দটি সমাজের চোখে নেতিবাচক হয়ে উঠেছে, যা আগে ছিল না । একজন কপট বন্ধু যেমন সবথেকে বেশি ক্ষতি করতে পারে, একজন কপট কবিও সবথেকে বেশি মননের সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারে । সেই তথাকতিত কবিরাই প্রেম, ভালবাসা, স্বপ্নসহ সমস্ত বিমূর্ত সৌন্দর্যকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নষ্ট করেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে মুখোশী কবিত্বে স্বার্থরক্ষায় মেতে উঠেছে । সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাই কবি-কবিতার চেয়েও সত্যিকার কবিত্ববোধ সম্পন্ন মানুষের বেশি প্রয়োজন ।


*** আমাদের শিল্পকলা প্রধানত প্রেম নির্ভর – সেটিকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
-- আধুনিক শিল্পকলার প্রধান বৈশিষ্টই হল প্রেম । এটি শুধু এখানে না, পুরো পৃথিবী জুড়েই । শিল্পকলার শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে । আদিম সমাজে যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোই ছিল মুখ্য । পুরুষেরা অলংকার পরিধান করে, গায়ে রঙ মেখে নারীদের আকৃষ্ট করত । সেই আদি আনন্দ থেকেই পরে জন্ম নেয় সুন্দরের ধারণা । অন্যদিকে দাসপ্রথার মধ্য দিয়ে উৎপত্তি হয় প্রেমের । বঞ্চিতদের অপূর্ণতাবোধ থেকেই প্রেমর সৃষ্টি হয়। চিন্তার বিকাশে এই অপূর্ণতাকেই আমরা শিল্পকলায় পরিণত করেছি ।


*** একটি জাতি কতটা উন্নত বা অনুন্নত তা বুঝা যায় সে দেশের শিল্পকলার স্বরূপ কেমন তা দেখে । এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান এখন কেমন ?
-- শিল্পকলার স্বরূপ কেমন সেটা নির্ভর করে কে দেখছে তার উপর । মধ্যযুগীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমাদের শিল্পকলা বেশ উন্নত হয়েছে, আর আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তা এখনো প্রায় মধ্যযুগীয় । বিয়ে ছাড়া সন্তান পালন থেকে সন্তান ছাড়া নারী-পুরুষের সহাবস্থান – এইটুকু ছাড়া আসলে তেমন কোন পার্থক্য তৈরি হয় নি । প্রেমকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা প্রতারণার সামিল, সেটাই এযুগের শিল্পচর্চার প্রধান বাধা । যৌনতা প্রয়োজনের, এতে ভাল-মন্দের কিছু নেই । অপূর্ণতা শিল্পীসত্ত্বার জন্য দরকার । রবীন্দ্রনাথ কামুক ছিলেন, কিন্ত কাম চরিতার্থের চেষ্টা করেন নি বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ । এ যুগের কথাসাহিত্যিক-কবি সবাই যৌনক্ষুধায় ভোগেন, কিন্ত স্বীকার করেন না । অনেকে উল্টো নিজেদের নারীবাদী বলে দাবি করেন । এই দূষিত নারীবাদের চর্চা চলে কামকে কেন্দ্র করে । হত্যার চেয়ে লাম্পট্য তাই ভোগবাদীদের কাছে প্রধান অপরাধ বলে স্বীকৃত । সার্বিক ভাবে নারীকে বুঝার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, শরীরসর্বস্ব করার পিছনে এই লম্পটেরা সফল, স্বার্থের শিল্পকলাও তাই প্রতিষ্ঠিত। একটি সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নির্ধারণ সত্যিকার অর্থে করতে না পারলে চিন্তার বিকাশ ঘটবে না, শিল্প চর্চাও সম্ভব নয় । মহৎ সাহিত্য সে কারণেই রচিত হচ্ছে না ।


*** এর পিছনে মূল কারণ কী ?
-- এই অবস্থা একদিনে হয় নি, কোন একক গোষ্ঠীও এর জন্য দায়ী নয় । তবে প্রধান কারণ যে শিল্পবোধের অভাব সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায় । রাজনীতিবিদ-দের কাছ থেকে শিল্পবোধ আশা করাই বোকামি । শিল্পের বানিজ্যিকীকরণ কয়েক যুগ ধরে চলে আসছে এবং আগামীতেও সেটা হবে । শিল্প সংগঠনগুলো শিল্প স্বার্থের থেকে স্বার্থের শিল্পে পরিণত হওয়াতেই এই সংকট তৈরি হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ-সুধীন্দ্রনাথরা একসময় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । ব্যবসায়ীদের কাছে এখন যে শিল্পচর্চার চেয়ে শিল্পের নামে ব্যবসা হবে সেটাই স্বাভাবিক । আলু-পটলের মত শিল্প সার্টিফিকেটও তাই বাজারে বিক্রি হচ্ছে , টাকাওয়ালাদের হাতেই এখন সবকিছু কুক্ষিগত । ইদানিং আরেকটি কপটতা মাত্রা অতিক্রম করেছে – ভুলকে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র । এই ভুলকে প্রতীক মনে করে তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে – এটাই সবথেকে ভয়ংকর ব্যাপার ।


*** এমন পরিস্থিতিতে কবিদের দায়িত্ব কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন ?
-- অবশ্যই সংঘবদ্ধ হওয়া । তার আগে উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকাটা জরুরী । এখন কবিরা সংঘবদ্ধ হয়ে উদ্দেশ্য খুঁজেন, কবিতা চর্চা করেন । ইদানিং কবিরা মঞ্চে উঠার জন্য উম্মুখ, আর নাট্যশিল্পী মঞ্চ ছেড়ে পর্দায় যেতে চান । কবিসত্ত্বায় সামগ্রিক বোধ অসম্ভব ; সামাজিক কবি বলতে কোন শব্দ নেই । সংঘ দরকার নেই সেকথা আমি বলছি না । যেসব প্রবীণ কবি নতুন কিছু দিতে পারছেন না, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসা উচিত । সমস্যা হল ষাটোর্ধ বয়সীরা থাকেন নির্বাসনে, আর বিশ-ত্রিশ বয়সী তরুণরা চালায় সংগঠন ।


*** তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন প্রবীণ কবিদের অবসরে যাওয়া উচিত ...
-- আমি সেটা বলি নি । প্রবীণ কবিদের কবিতা লিখার ক্ষেত্রে মননের ঐ বিশেষ অবস্থাটা বার্ধক্যে থাকে না । দু-এক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হতে পারে ।


*** বিচ্ছিন্নতা কি একজন কবির জন্য অপরিহার্য ?
-- সেটা সমাজ, সংঘ থেকে; জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয় । একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও বিচ্ছিন্ন থাকাটা আবশ্যক । সেটা যত দীর্ঘ হবে ততোই ভাল । তবে কে কিভাবে নিচ্ছেন সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয় । রুদ্র বা নির্মলেন্দু গুন জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই কবি হয়ে উঠেছেন । অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশ বা হুমায়ূন আজাদের কবিতার পিছনে রয়েছে বিচ্ছিন্নতা ।


*** সমসাময়িক কবিদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন ?
-- সমসাময়িকরা এখনো আধুনিক হয়ে উঠতে পারেন নি । দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যই মানুষকে কবি করে তোলে । যে জীবনের মধ্যদিয়ে যাওয়া দরকার সেই চেষ্টা তারা করছেন না । তরুণ-তরুণীকে মুগ্ধ করা আর হাততালি জোটানোর জন্য কবিতা লিখে আধুনিকতা আশা করাও ভুল । যারা বর্তমানে বিশেষ বলে পরিচিত তারাও পাশ্চাত্য থেকে চুরি বা ধারের সংকীর্ণতায় আটকে আছেন । যে যত প্রতিষ্ঠিত সেই তত বড় চোর ।


*** আপনি তবে প্রতিষ্ঠিত কবিদের বাতিল বলতে চাচ্ছেন...
-- আমি বাতিল করার কেউ না; তাদের কবিতাই তাদের বাতিল করছে । কোন কবি জীবদ্দশায় বিখ্যাত হলে বুঝতে হবে যে তিনি তার সময়কে অতিক্রম করতে পারেন নি । সকল বিশিষ্ট কবিই তার সময়ে নিগৃহীত ছিলেন এবং পরে জনপ্রিয় হয়েছেন ।


*** বর্তমানে তবে কে সবথেকে ভাল লিখছেন সেটা বুঝার উপায় কী ?
-- তা নিয়ে আমি ভাবি না । পদক বা জনপ্রিয়তা সে ক্ষেত্রে মাপকাঠি হতে পারে, তবে সেটা জানতে হলে আগামী প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করতে হবে । কিন্ত কে খারাপ লিখছে কিংবা কে কবি নন – সেটা মিডিয়ার প্রচার দেখলেই বুঝা যায় । এই উত্তর আধুনিক কালে আধুনিক হতে না পারলে আমি তাদেরকে কবি বলে মনে করি না ।


*** আপনার দৃষ্টিতে কবি হতে হলে উত্তর আধুনিকতার দিকে যেতে হবেই । এটাই কী ?
-- প্রাচীন পুরোহিতরা যারা মন্ত্র-শ্লোক পড়তেন তারাই পরবর্তীতে রাজসভার কবি হয়ে ওঠেন । চিন্তা চেতনায় তারাই ছিলেন তখনকার সময়ের আধুনিকতম । আমি তাদেরকে কবি হিসেবেই বিবেচনা করি । বর্তমানে বদলেয়ার-শেলী-ফ্রস্টদের মানের তো কেউ নেই-ই, সেই চেষ্টাও কেউ করছে না । উল্টো অনেকেই তাঁদের কবিতাকে ধর্মগ্রন্থ করে তুলেছেন । কবিতা মানেই এখন উত্তর আধুনিকতার চর্চা- সেটা এই সময় দ্বারাই নির্ধারিত । উত্তর আধুনিক বলতে আধুনিকতার পরবর্তী পর্যায়কে বুঝায় । পাশ্চাত্য সেটাতেও অনেকদূর এগিয়ে গেছে । আমাদের উত্তর আধুনিকটা আর পাশ্চাত্যের ‘পোস্টমর্ডানিজম’ এক নয় । সে পথেই সবাইকে থাকতে হবে ।


*** আপনার কবিতা মূলত ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখই প্রধান হয়ে উঠেছে । এই সময়ের সাহিত্যের বিচারে সেগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন ?
-- আমার কবিতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভেবে অনেকেই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেন; ব্যক্তিসত্তাকে ছাপিয়ে যাবার দিকটি তাদের চোখে পরে না। অথচ যেসব কবিতা বাতিলযোগ্য তাই তাদের কাছে অনবদ্য কবিতা বলে মনে হয় । আমার প্রথমদিকের কবিতায় ‘উত্তরণের’ একটা ব্যাপার ছিল, সেগুলোও ব্যক্তিগত সুখ-দুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । উত্তরণের চেষ্টাটা ছিল বলেই আমি সচেতন ভাবে প্রকৃতিপ্রেমী বা বিপ্লবীসত্ত্বাকে উপেক্ষা করেছি । যেগুলো বিশিষ্টজনেরা এখনো চর্চা করে চলেছেন । আমার ‘কবি’ উপন্যাসটির কবি চরিত্র দেখলেও বুঝা যায় একজন রোম্যান্টিক কবি পরবর্তীতে কিভাবে উত্তরাধুনিকতা ধারণ করেছে । আপনি একটি দশ তলা ঘর নির্মাণ করতে পারবেন না যদি এর প্রথম নয় তলা না থাকে । আধুনিকতার ভেতর দিয়েই উত্তর আধুনিকতা আসে ।


*** চিন্তার উত্তরণ ছাড়া তবে মৌলিক কবিতা আসবে না...
-- কবিতা মানেই মৌলিক কবিতা লিখতে হবে – সেটা নয় । শৈল্পিক চুরি যেমন শিল্পের ক্ষুদ্রাংশ হিসেবে বিবেচিত, তেমনি ভিন্ন দুটি কবিসত্ত্বায় আগে-পরে একই বোধের জন্ম হতেই পারে । মৌলিকতার নামে এত বেশি নির্বুদ্ধিতার চর্চা হয়েছে যে – নির্বুদ্ধিতাও এখন আর মৌলিক না ।


*** আধুনিক কবিতা বলতে মূলত গদ্য কবিতাকে বুঝায় । জটিল ভাব প্রকাশের জন্যই কী এর উৎপত্তি ? নাকি অন্য কারণ আছে ?
-- ছন্দ-অন্ত্যমিল থাকলেই তা বাতিলযোগ্য, আর গদ্যে লিখলেই তা আধুনিক হবে বিষয়টা তা না । গদ্য কবিতার নামে নিম্নমানের কথা সাহিত্য এখন প্রচুর হচ্ছে । কবিতা আর কথাসাহিত্যের যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে সেটা অনেকেই জানেন না । ছন্দময় কবিতায় জটিল ভাবের অবতারণাও সম্ভব । সে জটিল ভাবটা অবশ্যই সময়ের দাবি, তবে ছন্দ বাতিল করা হয় নি । আজকাল অনেকেই শব্দচয়নের জটিলতা তৈরি করে আধুনিক হতে চাচ্ছেন । মন্ত্র সবাই জানে কিন্ত মন্ত্র সিদ্ধির জন্য নিজেকে ভাঙ্গা দরকার । সামাজিক আপেক্ষিক সুখবোধে কবিসত্ত্বায় মুক্তি আসবে না । নিজস্ব চিন্তায় স্পষ্ট না হলে আধুনিক কবিতা সম্ভব নয়, মৌলিক কিছু তো অসম্ভব ব্যাপার । পাঠকের মাঝে অস্পষ্ট বোধের জন্ম হতেই পারে, তাই স্বাভাবিক । যদি সেটা কবির চিন্তায় অস্পষ্ট হয় তবে সে সৃষ্টিকর্ম যে কবিতা নয় এটুকু বলা যায় । শিল্পের সর্বস্তরে এখন এই ‘স্পষ্ট চিন্তার’ বড় অভাব । আধুনিক প্রেমকে মধ্যযুগীয় কামতৃষ্ণায় দেখলে নীচু মানের শিল্পই তৈরি হবে । প্রেম যে পাওয়ার জন্য নয় সেটা এখনকার কেউই বুঝেন না । পুঁজিবাদী সমাজে শিল্পীদের প্রেমও তাই ভোগবাদীপ্রেম হয়ে উঠেছে । মধ্যযুগীয় মানসিকতার জন্যই যৌনাবেদনময় শিল্পে চারপাশ ছেয়ে গেছে । চিন্তার বিকলাঙ্গটা দিয়ে মুক্তি সম্ভব না ।


*** এবার কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি । আপনার প্রিয় কবি কে ? খুব বিশেষ কেউ কি আছেন যার প্রভাব কবিতায় পড়েছে ?
-- প্রিয়দের তালিকায় অনেক আছেন । দুজনের নাম বলা মানে অন্য দুজনকে অস্বীকার করা নয়- সেটা কেউ বুঝবে না । জীবনের মধ্যদিয়েই সবাইকে যেতে হয় – প্রভাব তো পড়বেই । আমার চিন্তায় তাই অনেকেরই প্রভাব রয়েছে- সাহ্যিত্যিক-শিল্পী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই রয়েছেন । সে তালিকায় হাজার বছর আগের মৃতরাও আছেন । যাদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে তাদের প্রতি অসম্ভব কৃতজ্ঞতা বোধ করি । । তবে কবিতায় কারো প্রভাব নেই । অবচেতনে কারো প্রভাব পড়লে সেটি আমার চিন্তারই অংশ ।


*** স্বপ্ন অনুযায়ী আপনি কতটুকু ‘আদর্শ কবি হতে পেরেছেন ?
-- আদর্শ কবি বলতে কিছু নেই । আদর্শ ভাঙতে পারলেই তো কবি । নিজেকে মূল্যায়ন করা যায় না, আমি শুধু কিছু দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে পারি, আগেও সেটা বলেছি । জ্ঞানচর্চার মধ্যদিয়েই মননের বিকাশ ঘটে । যে যত জ্ঞানী সে-ই তত বড় শৈল্পিকতা ধারণ করে । নুন্যতম সামাজিকতা আর সর্বচ্চ জ্ঞানচর্চাই- উত্তর আধুনিক মননের বৈশিষ্ট্য । জীবনযাপন থেকে বোধ কুড়িয়ে কবি হওয়ার দিন তাই বাতিল হয়ে গেছে । আদর্শগত-প্রথাগত উভয় চিন্তারই এখন কোন স্থান নেই । এমনকি স্বপ্ন দেখাও কবির জন্য নয় । স্বপ্ন পরিবর্তনশীল বিষয়, মননের উৎকর্ষে স্বপ্ন পরিবর্তিত হয় । স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা- ব্যক্তিগত সুখ-দুখের সাথে জড়িত – সে জন্যই তা এখন বাতিল বলে গণ্য । কবির জন্য শুধুই শৈল্পিক পথে যাত্রা, সার্বিক জ্ঞানচর্চাই সে পথের করণীয় ঠিক করে দিবে । শুধু কবিতাকেন্দ্রিক জ্ঞান আহরণও তাই কবিত্ববিরোধী ।


*** আপনার পথের করণীয় কী সেক্ষেত্রে অনেকটাই এখন নির্ধারিত ?
-- আমি শুধু এই সময়ের করনীয় কী- সেটাই জানি । আগামীর করণীয় জ্ঞানচর্চার মধ্যদিয়েই ঠিক হবে । যা কিছু মননের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোর বিরোধিতা করা আর সমাজে শিল্পবোধ জাগানোর চেষ্টা করা- এইটুকুই আমার দায়িত্ব বলে বোধ করি । মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা আমার উদ্দেশ্য নয় । এজন্য আমি কথাসাহিত্য-প্রবন্ধে সেসব চিন্তা প্রকাশ করছি । আমি কারো মুখে ‘কবি’ শব্দটি শুনতে অপ্রস্তত । কবিত্ব আমার কাছে প্রেমের মত, প্রকৃতির মত । আমার কবিতা তাই কারো জন্য নয় । প্রতিটি সুন্দর শব্দের গভীরে আমার একান্ত ‘সৌন্দর্যবোধ’ রয়েছে, যা মৌলিকতায় শুদ্ধতম । সামাজিক শব্দের ভিড়ে সেসব বোধকে আমি ছোট করতে চাই না । তাই সমাজের জন্য লিখছি কথাসাহিত্য-প্রবন্ধ । সামাজিক ভাবে আমি “কাব্যিক দার্শনিক” । যদিও আমি সত্যিকার অর্থে কবি । ।


*** সুদূর ভবিষ্যতের কবি কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন ?
-- প্রশ্নটি উন্নতমানের । আমাদের ভবিষ্যতের দিকেই দৃষ্টি রাখতে হবে । সুদূর ভবিষ্যতে কবিদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা কেমন হবে সেটা এখন বলা অসম্ভব । তবে তাদের সমাজ ব্যবস্থা কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে অনুমান করাই যায় । কালের বিবর্তনে বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়েছে সে তুলনায় সাহিত্য-দর্শন অনেক পিছনে । প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে বাড়তে একসময় মানুষকে প্রযুক্তি থেকে আলাদা করা যাবে না । প্রযুক্তি শরীরের অঙ্গ হয়ে উঠবে । ক্ষুধা আর যৌনতার প্রতিকার আবিষ্কৃত হলে অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটবে । আমূল পরিবর্তন আসবে তখন, যা ‘মোবাইল বা ইন্টারনেটের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি । প্রযুক্তির উপর যাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে তারাই হবে সেই সমাজের নীতিনির্ধারক । মানুষের জীবন সহজ হয়ে আসবে । শ্রেণীবিভাজন হবে চিন্তার উৎকৃষ্টতা অনুযায়ী । তবে - মহাবিশ্বে অজস্র স্বর্গের উৎপত্তি হলে- সেখানেও স্বর্গ দখলের রাজনীতি থাকবে । স্বর্গীয় অসুন্দরকে সেসময় যে ‘সুন্দর’ করার স্বপ্ন দেখবে- সে-ই হবে ‘ভবিষ্যৎ কবি’ ।


মাহবুব শাকী
পল্লবী, ঢাকা