হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছিলেন- ‘একজন গদ্যকার কবির পদধূলিরও নিচে থাকেন’ । এ প্রসঙ্গে তিনি সমারসেটের উদৃতি উল্লেখ করেন বইটিতে-“একজন কবি যখন যাবেন, তখন একজন গদ্যকার পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াবেন” । কবি কি এতই সম্মানিত ? হুমায়ূন আহমেদের উক্তি বাইবেল না, তবে হ্যাঁ- কবি মাত্রই শ্রেষ্ঠতম । এখন প্রশ্ন হল কবি কে ? প্লেটোর মতে “প্রেমে পড়লে সবাই কবি হয়ে উঠে”- এ-কথাটি সম্পূর্ণ বাজে কথা । ‘কবি’ বিষয়ে জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন- ‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি” । তাঁর উক্তিটি ‘যথার্থ’ হলেও- ‘কবি কে’ সেটি বুঝার জন্য এই বাক্যটি ‘যথেষ্ট’ নয় । তাছাড়া তাঁর উক্তিকে এক শব্দে ‘যথার্থ’ বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়েও আমি সন্দিহান ! ‘সবাই কবি নয়, হাতেগুণা কয়েকজন কবি’- এভাবে বললেই হয়ত সত্যিকার যথার্থ হত । তবে আমি, অহংকারী কাব্যিক দার্শনিক, জীবনানন্দের ‘বিনয়’কে ছোট করে দেখছি না- এটা সত্য । তবে আমি যে অহংকারী সে কথাটিকে মিথ্যে ভাবলে ভুল হবে । ‘কবি কে’?- সেটির ব্যাখ্যা বুঝার মাঝেই পাঠকেরা এর সত্যতা যাচাই করুন । কবি-কবিতা-কবিত্ব প্রসঙ্গে আমার লেখাগুলোও সেক্ষেত্রে সহায়ক হবে । আমার যেসব দৃষ্টিভঙ্গি অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিরাও বাতিল করেন বা করবেন, বা মতবিরোধ রয়েছে, সেসবের নিরিখেই ব্যক্তিগত অভিমত তুলে দিলাম-


নিঃসন্দেহে একজন কবিকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে কবিতাই একমাত্র মাপকাঠি । কবির মাপকাঠির চেয়ে কবিতা সৃষ্টির প্রতি আমার আবেগ আনুপাতিক হারে ০ আর ১০০ ! যেকোন কবিতার মূলে আছে কবিত্ব; কবি তাঁর বোধের মহুরী মাত্র ! একজন কবি তাই সবসময়ের জন্য কবি নয়, কিছু বিশেষ মুহূর্তেই কেবল কবি হয়ে উঠেন । এই ‘বিশেষ মুহূর্ত’কে আমি এতটাই বিশেষ কাঙ্ক্ষিত মনে করি যে আত্মশ্লাঘার মাঝে সেটি কবি-কবিতার সংজ্ঞাই বদলে দেয় । ‘দুজন কবি’ কবিতাটির কথোপকথনের শেষাংশে তাই ‘কবি’ চরিত্রের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যে বলেছি-
“কবি কি শুধু কাব্য লিখে ? মুখের কথা নয় কবিতা ?
পারবে যে কেউ কবি হতে- না লিখেও একটি কথা !
যুদ্ধে যে যায় দেশের তরে- বিদ্রোহ কি নয় কবিতা ?
শুদ্ধ প্রেমিক কবিই তো সে- প্রেম যেন তার কাব্যগাঁথা” ।


আমার কাছে ‘কবি’ হতে গেলে তাই শুধু কবিতাকেন্দ্রিক জ্ঞান আহরণ বাতিলযোগ্য । এযুগে তাই ‘সার্বিক জ্ঞানচর্চা’র সাথে ‘শৈল্পিকতার’ নিরিখেই কেবল ‘কবি’কে মূল্যায়ন করা উচিৎ বলে মনে করি । ‘লিখা’- আধুনিক সভ্যতার আবিষ্কার বলেই লিখিত কবিই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ, মূলত এরাই কবি । জ্ঞানের সুবিশাল রাজ্য আধুনিককালে বই-পুস্তকেই লিপিবদ্ধ আছে বলে ‘জীবনযাপনের’ চেয়ে ‘একঘরে’(ধ্যান-জ্ঞান) হওয়াটাই বেশি জরুরী । তাছাড়া বেঁচে থাকা মানেই নুন্যতম সামিজিকতা এমনিতেই রক্ষা করতেই হয় । তাছাড়া লিখা শুধুই এই সময়ের নয় ভবিষ্যতের তরেও প্রভাবক ।


চিন্তায়-মননে যিনি সময়ের চেয়ে আধুনিক তিনি-ই কবি । অর্থাৎ এই সময়ের কবি হলেন ভবিষ্যতের মানুষ । যিনি যত বেশি সুদূর ভবিষ্যতের মানুষ তিনিই এই সময়ের তত বেশি উৎকৃষ্ট কবি । তাই যৌবনে কেউ জনপ্রিয় হলে তাকে আমি কবি বলি না । এমনকি বার্ধক্যে জনপ্রিয় কোন কবিকেও তাই বড় মাপের কেউ মনে করি না ।
আগেই বলেছি- সামাজিক জীবনযাপন কবিত্ববিরোধী, প্রয়োজন ধ্যান আর পুস্তকজ্ঞান । তাই সংঘ-সংঘটনে কবিদের সংশ্লিষ্টতা আমি ক্ষতিকর বলে মনে করি । কবিতা থেকে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ কবি কিংবা কবিতাপ্রেমীদেরকেই পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসা উচিত ।
একটি কবিতায় লিখেছি-
“আমি আর কোন কবিতা লিখবো না
এবার থেকে আমার মুখের কথাই কবিতা হবে"
কিংবা
"আজ আমি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলের মাঝে ফিরলাম
কবি হলে ঠিক এভাবেই ফিরতে হয় আবার” ।


তবে উৎকৃষ্ট শ্রোতাই উৎকৃষ্ট বক্তা হতে পারে, সত্যিকার পাঠকই একজন সত্যিকার লেখক হতে পারে; তেমনি কবিত্বের বিকাশ বক্তৃতায় হয় না, চিন্তায় ঘটে । আমার লিখা ‘মৌলিক খুঁটি’ কবিতার কিছু পংতি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক-
‘হাজারো লোকের ভিড়ে মানুষ দেখি নি কতদিন ধরে
আজ যেন আমি নিজের ঘরেই ফিরেছি আবার,
তোমার-আমার-সবার সত্যিকার ঘর-
সেতো সর্বদা নিজের ভিতরে জন্মাবার মাঝেই......'


স্বপ্ন দেখা কি কবির কাজ ? জ্ঞান বাড়লে স্বপ্ন পরিবর্তিত হয় বা বড় হয় । তাই কোন নির্দিষ্ট স্বপ্ন দেখা, কোন নির্দিষ্ট আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা কবির কাজ নয় । তাই মানবতাবোধ-প্রকৃতিপ্রেম বা বিপ্লবীসত্ত্বাকে ধ্বংস করাই কবিদের কাজ । কবিতায় এসবের চর্চা করা তাই এর শতভাগ বিপরীত । ‘মৌলিক খুঁটি’ কবিতাটিতে তাই কবির উদৃতির মধ্য দিয়ে বলেছি-
“দ্বিধা হল ইচ্ছের ক্ষুধা,
যেসব বিশ্বাস-অবিশ্বাস পথ রুদ্ধ করে-
তাকে তোমরা দ্বিধায় ভেঙ্গে অতঃপর গড়ো,
এবং আবারো পরোখ করো সূক্ষ্মতায়
অনন্তের মতই আমাদের পথে শাশ্বত হোক দ্বিধা”


আমার কাছে ‘প্রচলিত সহজ শব্দে জটিলতর ভাব’ প্রকাশই উৎকৃষ্ট কবিতা হিসেবে বিবেচিত । কবিতা মূলত তাই ভাবের খেলা, শব্দের নয়; এই দুইয়ের ভারসাম্যই কবিতা । তবে জটিলতর ভাব জটিলতর সৌন্দর্যে প্রকাশ করতে গেলে ছন্দবদ্ধ শব্দ (শুধু অন্ত্যমিল নয়!) অবশ্যই গদ্য আশ্রয়ী শব্দের চেয়ে এগিয়ে থাকবে ।
অন্যদিকে কবিতা লিখা কখনোই কষ্ট বা বিরহের মাঝে থেকে সম্ভবপর নয় । কষ্ট বা বিরহকে অতিক্রম করে কিংবা অতিক্রম করার বাসনাই উৎকৃষ্ট কবিতার জন্ম দেয় । এই ‘বাসনা’ দুঃখের যতটা তারচেয়ে অনেক বেশি সুখের বা শিল্পসুখের সাথে সম্পর্কিত । কবিরা তাই দুখের ক্ষেতে মূলত সুখেরই চাষ করেন ।
যেমন প্রেম মানে না পাওয়া বা শুন্যতা অথচ উপভোগ্য, কবিত্ব তেমনি- স্বপ্নও তাই । তাই আমি কয়েকটি পংতি লিখেছি এমন-
* “না বুঝে প্রিয়া করেছ ভালই- মাথায় চাপিয়ে ভুলের খাঁচা
আমার তুমি অবুঝ বলেই- বহুমাত্রিক শিল্পে বাঁচা” ।
* “তুমি কবিতা বুঝো না বলেই তোমার জন্য কবিতা”
* “স্বপ্ন তুমি ছুঁয়ে দিলেই স্বপ্ন থাকে না"


প্রেম-স্বপ্নের মত কবিতাও আমার ব্যক্তিগত আবেগের বিষয়, এটি কারো জন্য নয় । অসংখ্য কবি-কবিতার সাথে যখন আমি বা আমার কবিতাকে এক কাতারে নেয়া হয়, তখন অহংকার শব্দটি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আসে- এবং আমি সেটা পছন্দ করি । তাই তো ‘আমি কবি’ কবিতায় লিখেছি-
* “প্রয়োজনে পোষ্য কুকুরের মত পায়ের কাছে বসে থাকব
শুধু ভুল করেও কবিতার কথা বলতে এসো না”
কিংবা
* “আমি কবি; স্বঘোষিত  
এবং তাই সত্য
আমি কবি কবিতায় স্বীকৃত” ।


পাঠকের সীমাবদ্ধতা বুঝে প্রবচনে লিখেছি-
"কবিতা অন্তত দুইবার পড়া উচিত । না বুঝলে পড়া উচিত যতবার বুঝা যায় না ঠিক ততবার"


কোন ব্যক্তিগত বিরোধ নয়, সুন্দরের উপলদ্ধি বা তীব্রতা থেকে কবিতায় লিখেছি-
“অহংকারে নয়- এ আমার অনিন্দ্য সুন্দরের প্রতি নিবিড় দায়বদ্ধতা”


সুন্দরের প্রতি এই তীব্র টান থেকেই আমি নিজেকে ‘কবি’ গোত্রবদ্ধ ভাবতে নারাজ । আমি নিজেকে তাই কাব্যিক দার্শনিক বলে প্রকাশ করি । যদিও জানি- আমি সুন্দর-অসুন্দর নিয়ে যেভাবে ভাবি তাই একজন সত্যিকার কবির কবিত্ববোধ । সেই বোধের মাঝে এতটাই গভীরতা যে একসময় লিখেছিলাম-
"কবি কবিতা লিখে, কারণ আর কিছু লিখার প্রয়োজন নেই” ।


"কবি”- উপন্যাসটিও তাই সম্পূর্ণ করার পরও আরও সুন্দরতম করার জন্যই প্রকাশ করি নি, প্রয়োজনে আরও ১০বছর একে সমৃদ্ধ করবো বলেই ঠিক করেছি । এই শাশ্বতবোধের জন্যই আমার প্রেম-কবিতা একাকার হয়ে উঠে । ‘অসমাপ্ত কবিতা’ কবিতাটিতে সেই শৈল্পিক অপূর্ণতার সাথে নিজেকেই তুলনা করেছি-
“আমি তো শুধুই এই পৃথিবীর বৃহৎ শূন্যতা......
আমিতো শুধুই খেয়ালী তোমার– অসমাপ্ত কবিতা” ।


‘কবি কে’ সে-প্রশ্নের উত্তরে আমি এককথায় বলব- শুধুই শৈল্পিক পথে যাত্রা । আমার ভিতরে যে  অমরতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- সেটাও তো কবিত্ববোধের ফসল । সে ব্যাখ্যা না হয় যৌক্তিক ভাবেই অন্য একদিন প্রবন্ধে প্রকাশ করব । এই অনুভূতি থেকে ‘কবির মৃত্যু’ কবিতায় লিখেছি-
“কবির মৃত্যুতে আজ কোন শোকসভা হবে না”
জীবন-মৃত্যু নিয়ে কবির কণ্ঠে নিজের কথাই তাই শাশ্বত বাণীর মত বলতে চেয়েছি-
“জীবন এবং মৃত্যু- সেতো দুটো শব্দই শুধু
জীবন-মৃত্যু ভিতরে কতটা, সেটা-তো কেবল ভিতরই জানে
কখনো জীবন মৃত্যু নামে, কখনো মৃত্যু জীবন দামে”


কবিত্ব অর্থাৎ শিল্প-সৌন্দর্য-ই তো জীবন, অন্যথায় সবকিছুই যে মৃত্যুসম ।