কবি টিএস এলিয়ট বলেছেন, “যখন কবির মন কাব্য সৃষ্টির জন্য উন্মুখ এবং সমগ্রভাবে প্রস্তুত তখন সে মন তার চরম নিরুদ্ধ অভিজ্ঞতাগুলোকে একাকার করে। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা যেখানে বিশৃঙ্খল, অসম এবং অসম্পূর্ণ, কবির অভিজ্ঞতাগুলো সেখানে একটি চূড়ান্ত এককরূপে প্রকাশ পায়। একজন মানুষ ভালোবাসতে পারে আবার ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে পারে। এ দুটি অভিজ্ঞতা পরস্পর পরিপূরক নয়। তেমনি সমন্বয় নেই টাইপরাইটারের শব্দের সাথে রান্নার গন্ধের। কিন্তু একজন কবির মনে সবক’টি অভিজ্ঞতা একাকার হয়ে একটি চৈতন্য জাগরিত হতে পারে।”


তবে এক্ষেত্রে নিজ চৈতন্য কিংবা আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেবার পাশাপাশি জাতীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বহুজাতিক স্রোতধারায় মিশে যাওয়া সফল কবির জন্য অতিশয় জরুরী। কবিতার বিষয়ভাবনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা এবং প্রকরণ-পরিচর্যায় আপন ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত থাকার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকে ধারণ করা একজন সফল কবির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। না হলে একজন কবি কিভাবে বিশ্বকে সৌন্দর্য দেখাবেন, বিশ্বকে ভাবাবেন, বিশ্বের হৃদয়ে হৃদয়ে সত্যের উদ্রেক ঘটাবেন।


যুগে যুগে রসের স্বাদ এক থাকে না। কবিতায় আধুনিক চেতনা কি? কবিতা কি কেবল নিজ বাসভূমেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি পৃথিবীটাকে তার উত্তরাধিকার করে নিবে? একজন কবির উচিত আন্তর্জাতিক চারিত্র নিয়ে আধুনিকতার তালাশে নিত্য নিমগ্ন থাকা, আধুনিকতাকে আপন সম্পদ করে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। ক্লাসিক সংযম, রোমান্টিক সৌন্দর্যতৃষ্ণা, রেনেসাঁস-উদ্ভূত মানবতাবাদ ও নারীভাবনা কবিতায় রোপণ করা আন্তর্জাতিক চেতনার প্রাণবীজ। এছাড়াও, সভ্যতার সংকট, যুদ্ধোন্মাদ শাসকের রক্তচক্ষু, বিশ্বের দেশে দেশে রক্তের স্রোতধারা, বিভিষীকা এসব বিষয় একজন কবি কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না, এগুলো একজন অনুভূতিশীল কবির হৃদয়ে দোলা না দিয়ে পারে না। তাই, রোমান্টিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, জাতীয়তাবোধের পাশাপাশি যুদ্ধোন্মুখ বিশ্ববাস্তবতার বিপরীতে কবির অবস্থান এবং সেই বাস্তবতা থেকে সামগ্রিক মানবের মুক্তির গতিপথের সন্ধান-প্রচেষ্টা, আধুনিক বিশ্বমানব-চৈতন্যের পীড়িত সত্তার সংকট, ইত্যাদি একজন সফল কবির কবিতার পঙতিতে পঙতিতে ব্যক্ত হতে হবে।
  
তিরিশ ও চল্লিশের দশকে আন্তর্জাতিকতার স্পর্শে বাংলা কবিতার উপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় এবং বিশেষভাবে ইংরেজি কবিতার কাব্যভাবনা গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এখন বিশ্বায়নের যুগ আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বহুরৈখিক ছাপ পড়বে, থাকবে বহুজাতিক সুর, এটাই স্বাভাবিক। নাহলে বিশ্বকবিতার উপর বাংলা কবিতার কোনরূপ প্রভাব থাকবে না। যদিও, নানা মাত্রায় বাংলা কবিতা বিশ্বকবিতার অগ্রগতির সমান্তরাল, তবু অনুবাদের অভাবে তা আন্তর্জাতিক শিল্পভুবনে অজ্ঞাতই থেকে গেছে। পাশাপাশি, অর্থনীতির দৈন্যদশায় বাংলা কবিতার সামাজিক উপরিকাঠামো বিশ্ব-পুঁজিবাদের কাছে থেকেছে অবহেলিত। গুটিকয়েক কবির (এলিয়ট কিংবা হুগো) কবিতায় কখনো সখনো বাংলা কবিতার কথা এসেছে, তবে তার আশ্রয় কবিতা নয়, দর্শন। ইউরোপ-আমেরিকাতেও আমাদের কবিগুরু কবি নয়, দার্শনিক ঋষি পরিচয়েই স্মরণীয় হয়ে আছেন।