দিনভর রাতভর তোমার উদ্দেশেই আমার এই ডাক,
গলা-চেরা, বুক-ছেঁড়া। আসা না আসা
তোমার খেয়ালের বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান, কোনো পাখি যদি
স্বপ্নঝিলিক, আশার খড়কুটো আমার ঘরে
না ঝরায়, তবু ডেকে যাবো,
যতদিন না তুমি আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াও।


সে কবে তোমাকে দেখলাম;
তুমি এসে বসলে আমার পাশে, সবুজ ঘাসে
লুটিয়ে পড়েছে তোমার ঘাসফুল-রঙ শাড়ির আঁচল,
তোমার হাসির ঢেউ,
আমার ভেতরে নৌকার দোলা, তোমার খোলা
চুল নিয়ে খেলছে হাওয়া, স্বপ্নছাওয়া চোখ তুলে
কী যেন বললে তুমি, কিছু শুনতে না পেয়ে
আমি তোমার সৌন্দর্যের গহনে ডুবুরী।
তোমার নরম হাত আমার মুঠোয়।
আমি কোনো গোলাপ
কিংবা স্বর্ণচাঁপাকে স্পর্শ করিনি। মনে হলো,
তোমার সকল কিছুই স্পর্শাতীত।


মুখের ওপর রোদের ঝলক, বাসী
ধু ধু বিছানায় আমার ধড়ফড়িয়ে ওঠা, চোখ রগ্‌ড়ে
বারবার স্বপ্নের ছেঁড়া
মসলিন সেলাই করবার পরিণামহীন চেষ্টা।
ভীষণ তেষ্টায় আমার চোখ জুড়ে,
গলা জুড়ে, বুক জুড়ে বালি, কেবল বালি।


চকিতে মনে পড়ে, তোমার হেকারতের হ্যাঁচকা টানে
টালমাটাল আমি
দেখেছি আমার স্বপ্নের সওদাকে গড়াতে
সদর রাস্তায়।
টুকরো টুকরো ছবি ভাসে, ডোবে। খণ্ডগুলোকে
জোড়া দিতে অপারণ আমি
অমিলের বেড়াজালে আটকা। যাকে দেখেছিলাম
শেষরাতের স্বপ্নের অভ্রের
আভাময় মাঠের মাঝখানে, সেকি তুমি? তার কালো
চুল কি নিতম্ব অব্দি নেমে-আসা
ঝর্ণা নাকি বিউটি পার্লারে রচিত খাটো স্তবক?


আর তার আয়ত সুন্দর চোখ? ঈষৎ বাদামি নাকি
নীল ঢেউয়ের ঝলকানি-লাগা? অথবা
মৃত্যুর মতোই ঘন কালো? তোমাকে আর
তাকে মেলাবার আমার
সকল আয়োজন শুধু, পণ্ড হতে থাকে।
তোমাকে বাস্তবিকই কখনো দেখেছি কি দেখি নি,
এই ধন্দ আমাকে নিয়ে লোফালুফি করে লাগাতার।
বুকের ধুক ধুক আর হৃৎপিণ্ডের রক্তের দাপাদাপি
আর সীমাছাড়ানো অস্থিরতা নিয়ে
আমি কিছু শব্দকে ‘আয় আয়’ বলে ডেকে বেড়াই
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। অনন্তর
যে প্রতিমা গড়ে ওঠে আমার হাতে,
তাকে দেখে অনেকে বলে ওঠে সোল্লাসে, ‘সাবাস কবি,
কেমন করে, এই অসম্ভব সুন্দরকে
আনলে মর্ত্যলোকে?’ মাঝে-মধ্যে আমারও
অবাক হবার পালা। অথচ এই আমি
বহুদিনের নাছোড় অস্থিরতা
এবং অনেক নির্ঘুম রাত্রির বিনিময়েও তোমাকে
আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে অক্ষম। এর ব্যর্থতার
ঝুলকালি মুখে নিয়ে চৌদিকে
মানুষের মেলায় হাঁটবো কী করে?


মনকে প্রবোধ দিই, আমাকে না বলেই তুমি চলে যাবে,
বিশ্বাস করি না। তুমি সাড়া দাও
আর নাই দাও, আমি দিনরাত্তির ডেকেই যাবো
অকাল বসন্তের ব্যাকুল
কোকিলের মতো। গলায় রক্ত চল্‌কে দেয়া এই ডাক
তোমাকে কি কখনো নামিয়ে আনতে পারবে না
তোমার উদাসীনতার মিনার থেকে? তুমি কি
শীগগীরই একদিন এসে
আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে না, এই যে আমি?
আজ শুধু অন্ধকারে হারড়ে বেড়ানো, নিজের সঙ্গে কথা বলা।
শোনা যায়, কখনো কখনো মর্মর মূর্তিও
বেদীর স্থানুত্ব বিসর্জন দিয়ে
তার রূপের সাধককে বাঁধে নিবিড় আলিঙ্গনে।
কোন্‌ দিকে পড়বে তোমার পদচ্ছাপ,
তা দেখার জন্যে প্রতীক্ষায় কখনো আমি
পাথরের নুড়ি, কখনো প্রজাপতি, কখনো বা দোয়েল।


   (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)