যাবার সময় সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে পা রেখে পেছনে ফিরে তাকায় সে;
দোরগোড়ায় স্মিত মুখ, এক জোড়া চোখে ইদিশ ভাষার প্রাচীনতা। এগোনো
মুশকিল, তবু নেমে যাওয়া, হাত নাড়া। নেমে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে, নিচে হা
করা পাতাল। মনের ভিতর উথাল পাতাল।


এখন রিকশায়; ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ট্রাফিক রাগী জন্তুর মতো গজরাচ্ছে। ওর
বসে থাকা, উঠে দাঁড়ানো, চায়ের পেয়ালা বাড়িয়ে দেয়া, হাসি, ওড়না
সামলানো, কিছু কথা, ফুলের ঝরে পড়া-মনে পড়ে। সে কী করবে এই মেঘলা
দুপুরে একা একা?


সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, কোনও চিলেকোঠা নয়, ফ্ল্যাট বাড়ির ঘরের আশ্রয় খোঁজা
চুপিসারে। নারকেল গাছের অশ্রু জানালার গাল বেয়ে নামে। কে যেন
ফিসফিস স্বরে প্রাচীনকালের কবিতা পড়ে। এখুনি অফিসের ডাক, যাওয়ার
তাড়া। ঝাড়া চার ঘণ্টা কবিতার অনুলিপি তৈরি করা, চা খাওয়া, আড্ডা দেয়া,
সম্পাদকীয় লেখা না-লেখার দোটানা। হঠাৎ তাতারী তরবারির মতো ঝলসে
উঠে হানা দেয় সদ্য-অতীত। ঈষৎ শীত, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা বন্ধুর
গাড়িতে।


বিছানায় শুয়ে ঘুমের প্রতীক্ষা; বলা-নেই না হওয়া কবিতার অবুঝ
গুঞ্জরণ মাথার ভেতর। ডুবে যাচ্ছে চোরাবালিতে, চিৎকার স্তব্ধ, কোনও দড়ি
কিংবা লতা নেই আশ-পাশে। মধ্যরাতে কাঁপুনি, কাকে ডাকবে? রাতের শেষ
প্রহরের প্রবল ঝাঁকুনি। ঠাণ্ডা বশ্যতা করে না স্বীকার কাঁথার, কম্বল, খোঁজে,
মাথা গোঁজে বালিশের নীড়ে। বশ্যতা ডেকে উঠবে কি?
রাত্রির মশক থেকে চলকে চলকে পড়ে তরল সোনা।



লোকটাকে ওরা ক্রমান্বয়ে ক্ষেপিয়ে তুলছে। কারও পাকা ধানে মই দেয়া
তার কাজ নয়। নিজের হালেই আছে, হৈ চৈ থেকে দূরে থাকার বাসনা কাচের
বাসনের মতো চূর্ণ। তাই ওর মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা। উঠে দাঁড়ালেই,
অনেকে ভাবে একটা হট্রগোল বাঁধাবে লোকটা, অথচ তেমন কোনও উদ্দেশ্য
গরহাজির। আস্তিন গোটানো ওর ধাতে নেই।


মেপে মেপে কথা বলা, অট্রহাসিতে ফেটে না পড়া, সময় বুঝে আস্তে সুস্থে পা
ফেলা, কোনও দিকে মাটির ঢেলা না ছোঁড়া এসব যাবতীয় খুঁটি নাটি
লোকটার কাছে প্রত্যাশা ছিল সবার। এতো ভারি মজার আব্দার। সবাইকে
ঘুম পাড়িয়ে রাখার দায়িত্ব সে তো নেয়নি কখনও। সে চায় ধাক্কা দিয়ে ঘুমে
ঢুলুঢুলু লোকগুলোকে জাগিয়ে রাখতে, যখন জেগে থাকাটাই সবচেয়ে
জরুরি।


ওকে নাস্তানাবুদ করার রাস্তা তৈরি করছে কেউ কেউ। ফেউ লাগানো হয়েছে
ওর পেছনে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার লোকের অভাব নেই
পাড়ায় পাড়ায়। গেরস্থবাড়ির কুকুর ভেউ ভেউ করে রাত দুপুরে তাড়ায় চোর
বাটপাড়। পুকুর চুরি বিরতিবিহীন উৎসব এখন।


লোকটা ভাবে একবার নিথর চাকাটা ঘুরিয়ে দিলেই হলো, তারপর নিজের
গতিতে চলবে ঠিকঠাক। যে যাই ভাবুক, ইচ্ছা করলেই চাকা ঘোরানো যায়
না, পাহারাদাররা সেটা অচল রাখার জন্যে মোতায়েন। মগজে কাদা নিয়ে
যারা গাদা গাদা বই লেখেন, সৌন্দর্যের শরীরে যারা কুষ্ঠের জীবাণু ঢোকাতে
আগ্রহী, যারা মধ্যযুগীয় টিউমার সাজিয়ে দিচ্ছে সমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, তাদের
হাত থেকে সবাইকে বাঁচানোর তাগিদে ধুকপুকে বুক নিয়ে লোকটা জেগে
আছে লাল কমলের মতো।



আহত করো, যত পারো। সইতে পারব, কোনও আঘাতই আমাকে আর
কাবু করতে পারে না। সেই কবে তোমার হৃদয়ের কাছে তাঁবু ফেলেছি, মেলে
দিয়েছি আমার হৃদয় নীলোৎপলের ধরনে। একে একে সবগুলো পাপড়ি
তোমার দীর্ঘ নীখে তুলে নাও, হৃদয় থাকবে প্রতিবাদহীন।


বলেছিলাম, তুমি কেমন সুদূর যেন বিষণ্ন প্রতিমা। এই শব্দগুচ্ছ তোমাকে ঈষৎ
রাগান্বিত করেছিল বলে মনে হলো। বুঝি আজও জের চলছে তার। না কি
আমি নিজেই বানিয়ে তুলছি মনে-মনে এমন কিছু, যা তোমার ভাবনার
ত্রিসীমানায় অনুপস্থিত?


‘ভালো থেকো;, বলেছিলে রিসিভার ক্রেডলে রাখার মুহূর্তে। কিন্তু কী করে
ভালো থাকি যখন তুমি, হ্যাঁ, তুমিই আমার মনের স্তরে স্তরে কালো মেঘ
ছড়িয়ে দাও বারবার। তোমাকেই ঘিরে আমার সকল ভাবনা আর স্বপ্ন।
ভোরবেলা হেঁটে যাওয়ার সময় দেখি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো পথের মোড়ে,
বইয়ের দোকানে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তোমাকে দেখতে পাই বিদেশী
কাব্যগ্রন্থের জ্যাকেটে, রাতে শুতে গেলে দেখি তুমি আমার চেয়ারে বসে পা
দোলাচ্ছো মাত্রাবৃত্তে। ছুঁতে গিয়ে তোমার ছায়াকেও পাই না। তোমার
অনুপস্থিতিতে ক্রমাগত অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।


কেন তুমি অমন করে তাকাও আমার দিকে? তুমি কি জান না আয়ত এই দৃষ্টি
আমার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিতে পারে? তোমার হাসির মাধুর্যে আমার হৃদয়ের
আরশি নগরে যে পড়শি বসত করে সে দোতারা বাজাতে বাজাতে দূরে
কোথাও যাত্রা করতে চায়, তুমি কি বুঝতে পারো?


যত পারো আহত করো। এই পরিণতি সেদিনই মেনে দিয়েছিলাম, যেদিন
প্রথম তোমার চোখে চোখ নয়, হৃদয় স্থাপন করেছিলাম। এ হৃদয় তুমি ছিঁড়ে
খুঁড়ে ফেলে দাও পথের ধারে, যেখানে মানুষ আর পশুর পায়ে দলিত হবে
হৃৎপিণ্ডের টুকরোগুলো। কেউ জিগ্যেশও করবে না, কে ধারণ করেছিল এই
রক্তাক্ত খণ্ডসমূহ?



আঃ, আমাকে বাঁচাল এই বিকেল। সকাল বেলা থেকে, বলা যায়, ছিলাম
প্রায় মৃত। বাসায় রোবটের মতো ঘোরাফেরা সারাক্ষণ। অকস্মাৎ ঘরে বসন্তের
প্রবেশ বাসন্তী রঙের ঝলক এক পলকে রোবটের মধ্যে করল প্রাণ সঞ্চার।


বসন্ত চেয়ারে বসে বলে, ‘এলাম চলে। শোনো তো, এই বিবর্ণ ফুলগুলো
ফেলে দাও। শুকনো ফুল দেখতে আমার একেবারে ভালো লাগে না।
অতিশয় ম্লান ফুলগুলোর পাশে ওকে মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত।


‘অন্তত আজ থাক ওরা এখানেই’, নিষ্প্রাণ ফুলগুলোর গায়ে হাত বুলোতে
বুলোতে দিলাম জবাব। ইচ্ছে হলো ওকে, বসন্তকে, বলি, ‘আমিও তো বিবর্ণ,
জীর্ণ। তা বলে তুমি কি আমাকে ছুঁড়ে দেবে আঁস্তাকুড়ে?’ শেষ অব্দি বলা হলো
না, নিশ্চুপ পান করে চলি বসন্তের সৌন্দর্য।


বিদায়ের ঘণ্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বসন্ত। যে
যাবেই চলে তাকে ফেরানোর মন্ত্র আমি শিখিনি। একটা হাহাকার বারবার
আমাকে উদাস, বিষণ্ন জলাশয়ে ডুবোতে থাকে। ভুলে ছিলাম এই বিকেল
আমার শিরায় কোরামিন সঞ্চারিত করেছিল। এখন অন্ধকারে ইঁদুরের দল
আমাকে খেতে শুরু করলেও, ওদের তাড়ানোর ধৈর্য আমার ভগ্নপক্ষ, নখর ও
চঞ্চুবিহীন ঈগল।



ফল কাটার ছুরি আমূল বিদ্ধ হৃৎপিণ্ডে। হাতলে দু’টি প্রজাপতি। স্বপ্নে-দেখা
শল্যচিকিৎসক দাঁড়ানো কফিনের গা ঘেঁষে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চেটে কখন
যে তিনি ঘাসফড়িং, বুঝতে অক্ষম। হৃৎপিণ্ড থেকে ছুরি কনক চুড়ি রূপসীর
হাতে। আজকাল কী যে হচ্ছে, কখনও শুক্রবারকে মনে হয় সোমবার, কখনও
বুধবার রোববারের আদল ধরে। একটা ব্রেসলেট তার হাতে পরাতে গিয়ে
দেখি, পলঙ্কার নয়, সাপ জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে হটতেই পিঠ দেয়ালে,
সাপিনী মোহিনীর রূপে এগোয় আমার দিকে। একঝাঁক প্রজাপতি আমাদের
মাঝখানে দোদুল্যমান ঝালর। ঘাসফড়িং পুনরায় দক্ষ শল্যচিকিৎসক, বাইপাস
অস্ত্রোপচারের জন্যে তৈরি বৈরী ঋতুতে। ঋতু বদলের প্রতীক্ষায় বসে আছি
ঝড় বাদলে, লম্বা করিডোরে, মেঘের মাদলে মিয়া কি মল্লার। দূর পাল্লার যাত্রী
কেউ আছে কি এখানে। হাসপাতালের বেডের শিথানে পাশে। খেলে একজন,
পরনে তার কালো আলখাল্লা। ঠাণ্ডা পাথর বিছানায় উঠে আসে, কবি পাথর
বুকে টেনে ঘুমান। পাখির গানেও তার ঘুম ভাঙবে না। তার শরীর থেকে
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে আঙুরের রস। শল্যাচিকিৎসক খস খস করে কী যেন
লিখছেন টুকরো কাগজে ঝোড়ো বাতাসে নার্সের ত্র্যাপ্রন এখন গাঙচিল।
কবির বুকের পাথর সরিয়ে দাও।



ভেঙে ফ্যালো, আর নয় কালক্ষয়। হাতে তুলে নাও হাতুড়ি ও ছেনি।
এতকাল শুধু গড়েছ এলেবেলে ভুল পুতুল। এবার গড়ো আনকোরা সৌন্দর্য,
কালের ধুলোর স্পর্শাতীত। মাইকেলেঞ্জলো থেকে হেনরি মূর-যুগেশ্বর সবার
জন্যে লাল গালিচা; তুমি হেঁটে যাবে ঘেসো অথবা এবড়ো থেবড়ো পথে।


সময় মোমবাতির মতো দ্রুত গলছে, হাত চালাও জোরেশোরে। পাথরের কুচি
ঢেকে ফেলুক তোমাকে, তবু বিশ্রামের মদে চুর হয়ো না। এই তো অদূরে
সত্য আর পবিত্রতা তোমার রূপায়ণের অপেক্ষায়। ঠাঁই দাও পাথরে, অমর্তের
সঙ্গীত হোক মর্মরমুর্তি। সে গানের মূর্ছনা শ্যাওলা ছিঁড়ে বিশ্বের সকল সীমান্ত
পেরিয়ে যাক।


গত রাতে স্বপ্নে আমাকে কেউ ভাঙার গান শুনিয়েছিল। এখনও অটুট স্বপ্নের
স্বায়ত্তশাসন, দেয়ালে ডানা যুগ্মতায়, উড়ে যাব, প্রফুল্ল ঘুড়ি আকাশে আকাশে
ফিসফিসানি।



ধাপ্পা, অনাস্থা, ধান্দা মর্গে যায় না, কাটা ছেঁড়া নেই। বিদেশ থেকে কফিন
উড়ে আসে মেঘের নানা স্তর ভেদ করে। আশশ্যাওড়ার বনে সবুজ টিয়ে
চওড়া অ্যাভিনিউতে বিয়ের গাড়ি। টিয়ে ফুটপাতে বান্ডিলের মতো পড়ে
থাকে, মর্গে যাবে না। ময়না তদন্তের প্রয়োজন নেই ওর। পাখির জগতেও
ফিরবে না আর। কফিনে এক জোড়া শাদা হাত, ছড়িয়ে-পড়া চুল, কফিন শুষে
নেয় ক্রন্দন। কারা ভুল করে যেপথে যাওয়া উচিত ছিল, সেপথে না গিয়ে
ডোবায় পড়ে হাবুডুবু খায়। একজন চৌরাস্তায় ক’খানা হাড় নিয়ে মাদারির
খেল দেখায়। ‘সব কিছুই মস্ত ধাপ্পা’, হনহনিয়ে চলে যায় অন্যজন।
সমস্ত শহর কী দ্রুত কাদায়, বিষ্ঠায় ডুবে যাচ্ছে। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার
করার মতোও কেউ রইল না। তবে কীসের ধ্বনি যাচ্ছে শোনা? ন্যালাক্ষ্যাপা
একজন কাদায় ডুবতে ডুবতে বাজাচ্ছে মাউথ অর্গান। ওকে তুলে ধরো, বলছে
সিংহের কেশরের মতো মেঘ, বলছে দূর দিগন্ত। করুণ সুর সূর্যাস্তে মিলিয়ে
যেতে থাকে, যেমন নাট্যমঞ্চে যবনিকা পতনের সময়ে হয়।


   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)