কবিতা নিয়ে কিছু বলবোঃ- পর্ব - ৫
==========================
শরীফ এমদাদ হোসেন


♦আজকের বিষয় আধুনিকতা উত্তরাধুনিকতা আর উত্তরাধুনিক কবিতার জটিল বিষয়♦


আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতা
------------------------------------------------
আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদ দুটি সাহিত্য আন্দোলন যা উনিশ শতকের এবং কুড়ি শতকের শেষভাগে ঘটেছিল। আধুনিকতা হ'ল উনিশ তম শতাব্দীর শেষের দিকে এবং কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে কবিতা ও গদ্যের traditional ঐতিহ্যবাহী রূপ থেকে ইচ্ছাকৃত বিরতি। উত্তর আধুনিকতাবাদ, একটি আন্দোলন যা বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়েছিল, প্রায়শই তাকে আধুনিকতাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে বর্ণনা করা হয়। আধুনিকতাবাদ ও উত্তর-আধুনিকতার মধ্যে মূল পার্থক্য হ'ল আধুনিকতাবাদটি গদ্য ও শ্লোকের traditional ঐতিহ্যবাহী রূপ থেকে র‌্যাডিক্যাল বিরতি দ্বারা চিহ্নিত, যেখানে উত্তর-আধুনিকতা পূর্ববর্তী শৈলী এবং সম্মেলনের স্ব-সচেতন ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয় ।


আধুনিকতা কি
-----------------------
আধুনিকতাবাদ সাহিত্যের একটি আন্দোলন যা উনিশশতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে, মূলত উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে। আধুনিকতা গদ্য এবং কবিতার traditional ঐতিহ্যগত শৈলীর থেকে একটি দুটি এবং ইচ্ছাকৃত বিরতি চিহ্নিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং চার্লস ডারউইন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্কস প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা বিকাশিত বাস্তবতা সম্পর্কে পরিবর্তিত ধারণাগুলি সমাজ সম্পর্কে প্রচলিত অনুমানগুলির পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার চিত্র তুলে ধরেছিল।


আধুনিকতাবাদীরা নতুন ফর্ম এবং শৈলী নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। বিদ্রূপ, ব্যঙ্গ, চেতনা প্রবাহ, অভ্যন্তরীণ একাকীত্ব, একাধিক পয়েন্ট অফ দর্শন ব্যবহার এবং তুলনা আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে জনপ্রিয় সাহিত্য কৌশল ছিল। ব্যক্তি চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি, বিচ্ছেদ, ক্ষতি এবং হতাশার উদযাপন এই আন্দোলনের সাধারণ বিষয় ছিল themes এই আন্দোলনের সময় বাস্তবতার ধারণাটি একটি বৃহত পরিবর্তন ঘটেছে। বাস্তবতাকে একটি নির্মাণকল্পকাহিনী হিসাবে দেখা হয়েছিল যেহেতু আধুনিকতাবাদীরা বিশ্বাস করত যে বাস্তবতা এটি উপলব্ধি করার অভিনয়তে তৈরি করা হয়েছে; মূলত, তারা বিশ্বাস করেছিল যে বিশ্ব আমরা যা বলি তা হয়।


ডি এইচ লরেন্স, ভার্জিনিয়া ওল্ফ, জেমস জয়েস, ডাব্লু বি ইয়েস্ট, সিলভিয়া প্লাথ, এফ স্কট ফিট্জগারেল্ড, উইলিয়াম ফকনার এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে হলেন কিছু উল্লেখযোগ্য আধুনিক লেখক।
জেমস জয়েসের ইউলিসেস, ফকনার এর আইজ লে ডাইং এবং ভার্জিনিয়া উলফের মিসেস ডাল্লোয়, টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড এমন কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম যা আধুনিকতাবাদকে চিত্রিত করে।


এবার আসি উত্তর আধুনিকতা কি
------------------------------------------------


উত্তর-আধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদের প্রায় সকল ধারণাকেই অনুসরণ করে, তারা শিল্পকলার ক্ষেত্রে high and low forms এর বিভাজনের ধারণাকে খারিজ করেন, pastiche, parody, bricolage, irony, and playfulness এর উপর জোর প্রদান করেন। উত্তর-আধুনিকতাবাদ এ শিল্পকলার ক্ষেত্রে reflexivity বা আত্মসমালোচনামূলকতার উপর জোর দেওয়া হয়।


কিন্তু এইভাবে আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদকে একই মনে হলেও এটি দৃষ্টিভঙ্গী, মনোভঙ্গীর দিক দিয়ে আধুনিকতাবাদের চেয়ে ভিন্নতা পোষন করে। আধুনিকতাবাদ human subjectivity এবং ইতিহাসের একটি খন্ড চিত্র পরিবেশন করতে চায় কিন্তু কিছু সময় এই খন্ড চিত্র পরিবেশন দুঃখজনক, একটি ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করে এখানে শোক করা হয়। অনেক আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক এই ধারণাকে পোষন করেন যে, শিল্পকলা নিয়ে কাজ মানুষকে একত্রিত থাকতে সহায়তা করে। শিল্পকলা তাই করে যা মানুষের প্রতিষ্ঠান করতে পারেনা। পক্ষান্তরে উত্তর-আধুনিকতাবাদ এই খন্ড চিত্র, অনৈক্যতা নিয়ে শোক না করে বরং একে celebrate করে। তারা বলেন, এই বিশ্বই হলো অর্থহীন? তাই শিল্পকলা কোন অর্থ তৈরী করতে পারে এমন ধারণাই অযৌক্তিক। তারা বলেন,‘let’s just play with nonsense.’


আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদের মধ্যকার সম্পর্ককে দেখবার ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গী এ বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করবে। Frederic Jameson এর মতে, আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ হলো একটি সাংস্কৃতিক গঠন যা পুঁজিবাদের নির্দিষ্ট ধাপের সাথে জড়িত। তিনি পুঁজিবাদের তিনটি প্রাথমিক ধাপের কথা উল্লেখ করেন যা নির্দিষ্ট ধরণের সাংস্কৃতিক চর্চাকে নির্দেশ করে। এখানে এ সময়ে যে সকল শিল্পকলা ও সাহিত্য লেখা হয়েছে তাও অন্তর্ভুক্ত।


উত্তর-আধুনিকতাবাদ জ্ঞান উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। আধুনিক সমাজে জ্ঞান আবশ্যিকভাবেই বিজ্ঞানের সাথে জড়িত এবং যাকে বয়ান (narrative) এর সাথে তুলনা করা হয়। এখানে বিজ্ঞানকে ভালো আর বয়ানকে খারাপ, আদিম, অযৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। একজন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলে। উত্তর-আধুনিক সমাজে, জ্ঞান অনেকাংশেই functional – একজনকে কোন জিনিস শিখতে হয় তাকে জানতে হয় না কিন্তু এই জ্ঞানকে ব্যবহার করতে হয়।


এ কথাটি পরিষ্কার যে, আধুনিকতাবাদকে বোঝা ছাড়া কোনভাবেই উত্তর-আধুনিকতাবাদকে বোঝা সম্ভব নয়। বিংশ শতাব্দীর সংস্কৃতিকে বুঝতে আধুনিকতাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে উত্তর-আধুনিকতাবাদ মূলত ৮০’র দশকের। মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আধুনিকতাবাদ একটি নান্দনিক আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয়, যেটি সে সময়ের শিল্প ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রন করেছে। মোদ্দা কথা আধুনিকতাবাদকে বোঝা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর সংস্কৃতিকে বোঝা রীতিমত অসম্ভব। আধুনিকতাবাদ একভাবে ইতিহাসের খন্ডিত চিত্র পরিবেশন করে এবং এর জন্য তারা বিলাপও করে পক্ষান্তরে উত্তর-আধুনিকতাবাদ এই খন্ডায়নকে উৎযাপন করে। আধুনিকতাবাদের মতো উত্তর-আধুনিকতাবাদও এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী, মনোভঙ্গী। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, আধুনিক মনোভঙ্গী বলতে বোঝানো হয়েছে বিশেষ কিছু বৈর্শিষ্ট্যাবলীকে।
যেমন ঃ নতুনত্ব তৈরী, পুরাতনকে ভেঙ্গে ফেলা, জনসংস্কৃতি হতে দূরত্ব ইত্যাদি। আধুিনকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ দু’টোকেই আমরা একটি আন্দোলন হিসেবে দেখতে পাই। দু’টো আন্দোলনই বিংশ শতকের শিল্পকলা ও সংস্কৃতির খন্ডিত রূপের উপর গুরুত্বারোপ করলেও, এটি তারা করেছে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে।


সম্প্রতিকালে উত্তর-আধুনিকতাবাদ বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশে চিন্তার পদ্ধতি বা মতবাদ হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
অবশ্য উত্তর-আধুনিকতাবাদকে ঠিক কী ভাবে বা কোন সময়ের মতবাদ হিসাবে গণ্য করা হবে তা নিয়ে মতভেদ আছে। কেন না, ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদ’  নিজেকে উপস্থিত করে ‘আধুনিকতা’ অর্থাৎ জ্ঞানবিজ্ঞান, উৎপাদন প্রক্রিয়া, দর্শন, সাংস্কৃতিক ব্যাপকতার ধারণার বিপরীতে। পুঁজিবাদীই হোক বা মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক হোক এক সামগ্রিকতার চিন্তন পদ্ধতি উপস্থিত করে। উত্তর-আধুনিকতাবাদ ঠিক এর বিপরীতে কোনও ‘সামগ্রিকতা’ (totality) কে মানে না।


উত্তর-আধুনিকতা মোটেই আধুনিকতা উত্তর কোনও দর্শন নয়। এই দর্শনের কোনও সুনির্দিষ্ট ভাষ্য নেই, কেননা এই দর্শনের উৎপত্তিই যে কোনও সুনির্দিষ্ট ভাষ্যের বিরোধিতা করে। তাদের এ’ধারণাটুকুও নেই যে “কোনও সার্বিক ভাষ্য বা অধিভাষ্যকে মানি না” বা “কোনও সার্বিক ভাষ্য বা অধিভাষ্যকে অস্বীকার করি” এই ভাষ্যগুলিও এক অর্থে এক ধরণের সার্বিক ভাষ্য উপস্থিত করে। তবে যেহেতু বিভিন্ন ভাষ্যের সমাহারজনিত এক মিশ্রণ (খিচুড়ি শব্দটিও ব্যবহার করা যেতে পারে) এই দর্শন, তাই এই দর্শনের অনুগামীদের সামাজিক সক্রিয়তাও ভিন্ন ভিন্ন রূপ পায়। এদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ প্রয়োজন। আর যেহেতু মার্কসবাদীরা সর্বক্ষেত্রেই, তা দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি যে ক্ষেত্রেই হোক, ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতে নিজেদের সঠিকতা প্রমাণে কখনও ক্লান্তি বোধ করে না, তাই এদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনার সাথে সাথে সামাজিক ক্রিয়ায় এদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পৃথক পৃথক ভাবেই ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপের চিন্তা করতে হবে


★তবে হ্যাঁ, উত্তরাধুনিক বলে কোনো যুগ নেই, আধুনিকই চলতে থাকে। সাধারণ অর্থে আধুনিকতা-পরবর্তী বা উত্তরাধুনিক বলতে বোঝায় ভবিষ্যৎ। তাই উত্তরাধুনিক যুগে কেউ বাস করতে পারে না। তাহলে কেন উত্তরাধুনিক বলা হয়? আসলে এটি শিল্প-সাহিত্যের একটি ধারা।সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে উত্তরাধুনিকতা এ জমানার একটি কাব্য আন্দোলনের নাম।


বাংলাদেশের কাব্য-ভুবন উত্তরাধুনিকতা ও এর পাশ্চাত্য ঢং-টি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই একটি তুলকালাম অবস্থা পার করছে। তা যতটা না আলাপ-আলোচনায়, তার চেয়ে কম প্রয়োগে। প্রকৃত প্রস্তাবে এখানে এখনও এই ধারার উল্লেখযোগ্য দৈশিক আদল গড়ে ওঠেনি। অবশ্য পশ্চিম বাংলার কবিতায় এ নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে, সেখানে স্থানিক ও কালিক বিবেচনায় নিজস্ব আধুনিক হিসেবে উত্তরাধুনিকতার চর্চা হয়েছে। মলয় রায় চৌধুরী-সমীর রায় চৌধুরীদের হাংরি আন্দোলন এই স্বতন্ত্র পথে চলার শক্তি জুগিয়েছে। ষাটের দশকের প্রথাবিরোধী এই আন্দোলনের ঢেউ পাশ্চাত্যের দরজায় পর্যন্ত কড়া নাড়িয়েছিল। তাদের ভাবধারাকে সম্মান জানাতে ছুটে এসেছিলেন বীটকবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, তখনকার কথাকবি ও পরবর্তী সময়ের উত্তরাধুনিক কবি ডেভিড অ্যান্টিনসহ অনেকেই। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস হাংরি নিয়ে মস্ত এক ডকুমেন্টারি প্রচার করে। টাইম ম্যাগাজিনসহ বিশ্বের সেরা পত্র-পত্রিকা হাংরি নিয়ে ব্যাপক কাভারেজ দেয়। সে এক মহাকাণ্ড!


এদেশে আমরা উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে যত আলোচনা দেখতে পাই, সে তুলনায় উত্তর-অবয়ববাদ (Post-stucturalism) ও উত্তর-প্রকরণবাদ/ নব্য প্রকরণবাদ  (Post-formalism/ New Formalism) সম্পর্কে তেমন আলোচনা নেই। কেউ কেউ আবার এই দুই ধারণা ও যাদুবাস্তবতাকে উত্তরাধুনিকতার সাথে গুলিয়ে ভাবেন। এভাবেই চলছে। আর ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দটি নিয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তিরও অবধি নেই। অনেকেই বলেন ‘পোস্টমডার্ন’ বলে কিছু নেই, এ এক অসম্ভব ব্যাপার। তাদের মতে, আধুনিকতা-পরবর্তী বিষয়ের বতর্মান চলমানতা অবাস্তব।


কবিতায় অসংলগ্নভাবের মেলবন্ধনে একটি সমীকৃত ব্যাপার-স্যাপার ঘটানো— এটি যেন এখন আমাদের উত্তরাধুনিক কাব্যকলার একটি চারিত্র্য হয়ে গেছে। দুর্বোধ্যতা যে সর্বদাই অন্বিষ্ট হবে তা কিন্তু নয়। আমেরিকার কিছু অতিসাম্প্রতিক কবির (যারা আগে হাড়ে-মাংসে পোস্টমডার্ন ছিলেন) কবিতায় দেখছি দুর্বোধ্য বাণীভঙ্গি ঝেড়ে ফেলে ফের পাঠক বা ভোক্তার সাথে ফলপ্রসূ কমিউনিকেশনের তাড়না। সেখানে কবিতা একদিকে যেমন বিষয়হীনতা ও শূন্যবোধের দিকে যাচ্ছে, অন্যদিকে অর্থপূর্ণ বিষয়েও ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলা উত্তরাধুনিক কাব্যরীতি সেই নতুন নতুন যৌগশব্দের শব্দচিত্র গঠন (যা উভয় বাংলার নবীন কবিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়) এবং অসংখ্য অসম্পূর্ণ বাক্যের সমাহার (যা ওপার বাংলায় বেশি) নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বোধ করি, মলয়বাবুর হাংরি আন্দোলনের যুগে মার্কিনি পোস্টমডার্ন কবি ডেভিড অ্যান্টিনের কলকাতায় আসার প্রভাব এই বাক্যাংশ-কলা, যা অর্ধশতাব্দী প্রাচীন। আর চার্লস অলসনের 'প্রজেকটিভ ভার্স'-রীতি থেকে ঝেড়ে ফেলা যে শব্দচিত্রখেলা (অর্থাৎ শব্দ থেকে জেনারেটরের ব্যাটারির শক্তি-নিঃসরণ) সে-ও সেকেলে হওয়ার পথে। আর দুর্বোধ্যতাও কোনো উত্তরাধুনিক সম্পদ নয়।
গত শতকের প্রথম দিক থেকেই ড্যাডা, ফিউচারিষ্ট, অ্যাবস্ট্রাক্ট, কিউবিস্ট, পাউন্ড, এলিয়ট, হার্ট ক্রেনের যুগের, অর্থাৎ গত শতকের প্রথমার্ধের মডার্নিস্ট কবিতাই ছিলো এই দুর্বোধ্যতা। এছাড়া আমাদের কিছু কবি গত শতকের সেই ল্যাটিন জাদুবাস্তবতাকে কিংবা ফরাসি বিন্দুবাদী কাব্যকলাকে গুলিয়ে ফেলেছেন উত্তরাধুনিকতার সাথে। এ নিয়ে কেউ কেউ ইস্তেহারও লিখেছেন এবং নিজেরা লিখে এই ধারার কবিতার নমুনা দিয়েছেন।


উত্তরাধুনিকতা নিয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আলী আফজাল খান,পশ্চিমবঙ্গের গোলাম রসুল -এদের লেখার উদ্দেশ্য অনুকারী সৃষ্টি করা ছিলো না, তাদের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে গর্ব করার মতো উদ্ভাবনী কাব্যশক্তির উদ্বোধন ঘটেনি। আবার কেউ কেউ উত্তরাধুনিকতার নামে চটক-চমক, হেঁয়ালিপনা, বেখাপ্পাপনা, অসংখ্য বোধের বিক্ষিপ্ত উল্লম্ফন ইত্যাদিকে সার মেনেছেন। আমরা চাই আমাদের মতো করেই উত্তরাধুনিক হয়ে উঠি। এক হাংরি পশ্চিম বাংলায় যে কাব্যিক বিপ্লব নিয়ে এলো তার প্রভাবে ওখানকার পল্লী এলাকার কবিতার প্যাটার্নও বদলে গেছে। দেখা যাবে, সেই সুদূর জলপাইগুঁড়ি থেকে শুরু করে ওখানকার অনেক কবিই এখন তিরিশ-চল্লিশের আধুনিক কবিতার ঢংয়ে আর লিখছেন না। কিন্তু, স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত অল্পসংখ্যক কবি বাদে আমাদের অধিকাংশ কবি (তিনি যতো তরুণই হোন না কেনো) শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের যুগেই পড়ে আছেন। (পদ্যকার ও স্বভাব-কবিদের কথা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়)। ব্যতিক্রম সামান্যই। হাতে গোনা কয়েকজনের উঁকি এমন আহামরি কিছু নয়।


’নাই’ বা শূন্য যার মূল। আবার কিছু নয় উদ্দিষ্ট তার। ফলতঃ ভাষার বুনন হয় কিছুটা ভিন্নতর। বাংলা কবিতায়এ সব প্রবণতা স্পষ্ট হতে থাকে। শতাব্দীর শেষ দশকে লক্ষণগুলো আরো বেশী উজ্জ্বল, আরো বেশী ধারালো। উত্তরাধুনিকেরা অস্বীকার করেন আধুনিকতার রেখাঙ্কিত পথে চলতে। তাই তাদের উপমা উঠে আসে উৎপেক্ষার কাছাকাছি। কবিতা হয়ে পড়ে আরো বেশী শব্দ নির্ভর। পরিবর্তন হয় আঙ্গিকের।”


★সহজ কথায় বলা যায় যে, বাংলা কবিতা এখন একটু ভিন্ন ভাবে লেখা হচ্ছে। এই ভিন্নতাই উত্তরাধুনিকতা। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেমন ল্যান্ডফোন থেকে সেলফোন, টাইপরাইটার থেকে কম্পিউটার, এবং ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি; কবিতার ক্ষেত্রেও তেমনি একটি ভাষাগত, উপমা নির্মাণের কৌশলগত, শব্দব্যবহারের চিন্তাগত একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এটি কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে উপলদ্ধির ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক কবিতার থেকে জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসুর আধুনিক কবিতা আলাদা; তিরিশের কবিতারও যে অংশটি রোমান্টিকতা ঘেঁষা ভাষাবিন্যাসে জড়িয়ে ছিলো তাও মুক্ত করে দেন পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী। আবার পঞ্চাশের কবিতা থেকে বায়তুল্লাহ কাদেরী, রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর প্রমুখ কবিরা আলাদা কবিতা লেখেন। এই নতুন কবিতার নামই ‘উত্তরাধুনিক কবিতা’। উত্তরাধুনিক শব্দটি কিন্তু ‘আধুনিক উত্তর’ নয়। এটি একটি কালখণ্ডের কবিতার নাম
আপাত ভাবে সহজ হলেও এটা বেশ জটিল; নিরূপণ করা হবে কালখণ্ডের ধারাবাহিকতায়। আমি যে পুরো সফল আলোচক তা নয়। এটা অনস্বীকার্য যে, একজন কবির থেকে একজন তাত্ত্বিকই এগুলো আরো ভালো বলতে পারবেন।

♦ আগামী পর্বে থাকবে থাকছে কবিতায় প্রতিকবিতা, শ্লীলতা আর অশ্লীলতা ♦
*****************************
টুঙ্গিপাড়া,