কবিতা নিয়ে কিছু বলবো-- পর্ব-১
=======================
-- শরীফ এমদাদ হোসেন


♦এ ধারাবাহিকটির অনেকগুলি পর্ব। ফেসবুকে, অনেক সাহিত্যগ্রুপে এবং ওয়েব পোর্টালে ২০২০-২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। ভাবছি প্রতি বুধবার একটি করে পর্ব আগের থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে এ আসরে প্রকাশ করে যাবো। যদি কারো কোনরূপ উপকার হয়, কেউ পড়ে যদি আমাকে  কোনরূপ পরামর্শ প্রদান করেন, তাহলে আমিও উপকৃত হবো। এ লেখাটা পরিপূর্ণ আমার মৌলিক রচনা নয়। বহু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে বিশদ একটা রচনা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আপনার সসুপরামর্শ সানুগ্রহে গৃহীত হবে। আশাকরি  বাংলা কবিতার আসরের অনেক বন্ধু আমাকে আমার লেখাকে সঙ্গ দিয়ে পুষ্ট করবেন ♦


আজ গদ্য কবিতা
============


গদ্য কবিতা মানে ছন্দহীনতা নয়, মুক্তছন্দ মানে ছন্দের বাঁধন মুক্তি নয়।


একজন কবিতার সাধক লেখক ছাত্রকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে:


★ছন্দ কি


★কবিতা কি


★কোন বৈশিষ্ট্য কোন গদ্যকে কবিতায় উন্নিত করে


★কবিতার। শরীর থাকলেও কোন্ লেখাটা প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠছে না প্রভৃতি।


আমাদের দুঃখ- এসব বিষয়গুলো সামনে না রেখেই, শিল্প প্রকরণ, অলঙ্কার তত্ত্ব, ছন্দ মাত্রা না জেনেই না বুঝেই অনেকেই কবিতায় হাত পাকানোর চেষ্টা করছেন। অনেকেই শিক্ষা জীবনের পুরোটা কাল বুয়েটে কাটিয়ে কর্মজীবনে ডাক্তারী পেশায় মনোনিবেশ করার মতো হাস্যকর বিষয় যা।


★আমরা গদ্য কবিতার ছন্দ মাত্রা নিয়ে কথা বলার আগে কবিতা কাকে বলে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করে নিই।★


★কবিতা কী?★
=============
চারুশিল্পের অন্যতম একটি শাখা হচ্ছে কবিতা।ইংরেজিতে যার প্রতিশব্দ দেয়া হয়েছে Poem বলে। আমি মনে করি “কবিতা অন্তর্জাত এমন একটি উপলব্ধি যা বিশিষ্ট শব্দকল্প এবং অলঙ্কারের মাধ্যমে রসাশ্রিত হয়ে মানব মনে অনির্বাণ আনন্দধারার সৃষ্টি করে থাকে।


★ইংরেজ কবি কোলরিজ তার কবিতার সংজ্ঞায় বলেছেন: Best Word In The Best Order.


★কবি ড.সৈয়দ আলী আহসান যার রূপান্তর করেছেন: সুষম শব্দের সুষম বিন্যাসই কবিতা। এটাকে অন্যভাবেও বলা যায়: অনিবার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসই কবিতা।


★কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে- রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।


★রূপসীবাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মতে- উপমাই কবিতা।


★মালার্মে বলেছেন- শব্দই কবিতা।


★দান্তের মতে- সুরে বসানো কথাই হল কবিতা।


★ম্যাকলিশ বলেছেন- কবিতা কিছু বোঝায় না; কবিতা হয়ে ওঠে।


★রবার্টফ্রস্টের মতে- সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।


★কবি শঙ্খ ঘোষের মতে- ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা।


★সৈয়দ শামসুল হকের মতে- কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ।


★হুমায়ুন আজাদের মতে- পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিতহয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।


★সিকানদার আবু জাফরের মতে- আমি কবিতা লিখি অনায়াসে। যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশে-পাশে অসংখ্য সুলভ দুর্লভ মুহূর্ত নানা রূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোন কোন সময় সেই সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য-বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।


★কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন- কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো‘ যাবে না ।


★কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে- যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে তাকেই বোধহয় কবিতা বলা যেতে পারে।


★শক্তিমান কবি আল মাহমুদ বলেছেন- পাখির নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার সেটাই কবিত্ব।


★এসব সংজ্ঞার মাধ্যমে কবিতার একটা চিত্র ফুটে উঠেছে সবার সামনে। যেকোন লেখা তাই কবিতা হবে না, কোন কোন লেখা হবে কবিতা। যেমন সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। কবিরা জেনে বুঝে কবিতা লিখলে কবিতা হয়, অকবিরা লিখলে হয়তো পদ্য হয়, নয়তো গদবাঁধা গদ্যই থেকে যায়।


★মনে রাখতে হবে- কবিত্ব স্রষ্টা প্রদত্ত একটি বিশেষ শক্তি, বিশেষ এক উপলব্ধির নাম। আল্লাহ যাকে এই অপার মহিমাটা দান করেছেন, তিনি অন্যদের থেকে একটু আলাদা ,একটুস্বতন্ত্র, একটি ব্যতিক্রম। একজন সচেতন কবির শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, উপমা অলঙ্কারের প্রয়োগ- সব সময়ই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত।


★একজন প্রকৃত কবি যখন আধুনিক গদ্য কবিতা লিখবেন- তিনি ছন্দকে পরিহার করে কবিতা লিখবেন না, বরং ছন্দকে ধারণ করেই লিখবেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথাই প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়লো (তার কবিতার ক্লাস পড়ে মূলত ছন্দজ্ঞানটাকে পরিস্কার করে ঝালাই করে নিতে পেরেছিলাম প্রথম তারুণ্যে)। তিনি বলেন: “ছন্দ জানা ভালো কিন্তু এর দাসত্ব করা ভালো নয়”।


★একজন সচেতন কবি ছন্দকে অনুসরণ করবেন, ব্যবহার করবেন,ভাঙবেন, নতুন করে গড়বেন। তিনি কখনো একটি ছন্দের মধ্যে আবদ্ধ থাকবেন না। ছন্দের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা , নতুনত্ব আনাই হচ্ছে ছন্দের দাসত্বমুক্তি। দাসত্বমুক্তি মানে কখনো ছন্দহীনতা নয়, ছন্দহীন পথের অভিযাত্রা নয়। ছন্দের দাসত্বমুক্তির অভিপ্রায়ে কেউ কেউ ছন্দকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চান, যা খুবই অবিবেচনা প্রসূত, কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।


★গদ্যকবিতাকে ছন্দহীন ভাবার ন্যূনতম অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে- আধুনিক কবিতা বা গদ্য কবিতার ভেতরেও বহমান থাকে শক্তিমান ছন্দের নির্ঝরণী। যা সাধারণ পাঠকের চোখে আবিষ্কৃত হয় না। সাহিত্য গবেষক মাহবুবুল আলম তার ‘‘বাংলা ছন্দের রূপরেখা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: “পদ্যের ছন্দ প্রস্ফুট আর গদ্যছন্দ অস্ফুট। পদ্যছন্দের যতি চরণকে কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্বে বিভক্ত করে- পর্বগুলোতেও শৃঙ্খলা থাকে। কিন্তু গদ্য ছন্দে যতি থাকে না। এর পরিবর্তে আছে ছেদ। ছেদকর্তৃক বিভক্ত বাক্যে বাক্যাংশের পর্বের মতো কোনো নির্দিষ্ট মাপ নেই। ছেদকে সুনিয়ন্ত্রিত করে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাক্যাংশের দ্বারা গদ্যে ছন্দের আভাস আনয়নকরতে হয়। গদ্যছন্দে যতি, যুগ্মচলন, মিত্রাক্ষর, অনুপ্রাস-যমক প্রভৃতি থাকবে না। গদ্যছন্দে গদ্যের বা শব্দের ক্রম অনুসরণ করতে হয়।


★আমরা দেখতে পাই- গদ্যছন্দ বাংলা কবিতার ছন্দের শেষ পরিণতি হিসেবে সাম্প্রতিক কাব্যে প্রভূত সমাদৃত। পয়ার থেকে মুক্তক পর্যন্ত যে বন্দনমুক্তি তা শুধু যতি, মিল ও পংক্তি সীমার বন্ধনমুক্তি, কিন্তু তা মাত্রাবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্তি নয়। গদ্যছন্দে মাত্রাবিন্যাসের এই বন্ধনের অবসান ঘটেছে। গদ্যছন্দে মাত্রাবিন্যাসের স্বাধীনতা কবিপ্রাণকে ২য় বারের মতো মুক্তি দিয়েছে । প্রথম মুক্তি ঘটেছিলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দের আবিষ্কারের মাধ্যমে।
মনে রাখতে হবে: ছন্দকে পরিহার করা নয়, ছন্দকে মাত্রাকে গভীরভাবে ধারণ করেছে আধুনিক গদ্য কবিতা।
অবশ্য আমাদের অনেক অগ্রজ কবি এবং বর্তমানের বা সমসাময়িক সচেতন অনেক কবি জেনে বুঝেই, সুস্থ ধ্যানে জ্ঞানে সমর্পিত হয়ে গদ্য কবিতা (আধুনিক কবিতার কথা বলছিনে ইচ্ছে করেই, আধুনিক কবিতা আরেক প্রেক্ষাপট) লিখছেন। তাদের লেখাগুলো কবিতা হয়ে উঠলেও অন্য অধিকাংশ গদ্য কবির লেখা কবিতা হয়ে উঠছে না। অকবিদের পণ্ডশ্রম গদ্য কবিতার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, ভুলপথে বাংলা সাহিত্যকে ঠেলে দিচ্ছে। টিনএজ প্রেমপত্র মার্কা গদ্যকে গদ্য কবিতার দর্পণে সেঁটে দেবার আয়োজন চলছে চতুর্দিকে।এই অস্থিরতা, অপরিপক্কতা, অদূরদর্শিতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার।


আজ এ পর্যন্তই.........