বন্ধুগন, বেশ আগে "কবিতা নিয়ে কিছু বলবো " শিরোনামের একটি ধারাবাহিকে হাত দিয়ে বৃহৎ  ৬ পর্ব পর্যন্ত এ আসরে পোস্ট করেছিলাম। পরে অন্য শিরোনামে আরো দুটি পর্ব পোস্ট করি। আজ অনেকটা নিজের কারনেই, ৯ম পর্ব নিয়ে আপনাদের সামনে এলাম। এ পর্বে থাকছে, কবিতার পঙক্তি ও স্তবক বিন্যাস ও বিদেশি রীতি নিয়ে আলোচনা। এছাড়া,বাংলা কবিতায় ছন্দ, পঙক্তি ও স্তবক সজ্জায় বিদেশী রীতির প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত।  আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা যারা বিষয়গুলো জানি তাদেরসহ যারা অল্প জানি তাদেরও উপকার বৈ ক্ষতি হবে না।


★কবিতার পঙক্তি,চরণ ও স্তবক বিন্যাস ও বিদেশি রীতি★


পঙক্তি বিন্যাস
=========


পঙক্তি আর চরণ নিয়ে প্রায়ই আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। কেউ মনে করেন: পঙক্তি আর চরণ একই বিষয়। আবার কেউ মনে করেন: পঙক্তি আর চরণ দুটো আলাদা বিষয়। তাহলে কোনটা ঠিক? আসলেই দুই মতবাদের পক্ষেই যথেষ্ঠ যুক্তি আছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক।


পঙক্তি :
এক লাইনে সাজানো শব্দগুলোকেই পঙক্তি বলা হয়। তাহলে কবিতায় আমরা যে লাইন সাজাই সেগুলোর প্রত্যেকটিকে আমরা পঙক্তি বলতে পারি। উদাহরণ দেওয়া যাক।


আজকে দিনে মানুষ তুমি
উড়নি দিয়ে ঘুর্ণি লেখো


এখানে আমরা দুটো কবিতার লাইন দেখতে পাচ্ছি।  তাহলে দুটো লাইন মানে,এখানে পঙক্তি ২টা। অর্থাৎ লাইনের সংখ্যা = পঙক্তির সংখ্যা।


চরণ:
কবিতার যে অংশে একটি ভাব সম্পূর্ণ হয় তাকেই চরণ বলে। অর্থাৎ কবিতার একটি বাক্যই এক একটা চরণ। লাইন তো সহজেই চিনে ফেললাম।  বাক্য সম্পর্কেও আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু কবিতার বাক্য! উদাহরণ দেওয়া যাক।


আজকে দিনে মানুষ তুমি উড়নি দিয়ে ঘুর্ণি লেখো


' আজকে ' থেকে শুরু করে ' লেখো ' পর্যন্ত যদি দেখি, তাহলে আমরা দেখব: এখানে একটি ভাব সম্পূর্ণ হয়েছে। তাহলে এটাই একটি কবিতার বাক্য। সুতরাং  আমরা বলতে পারি, এটাই একটা চরণ।


কবিতার লাইন বা পঙক্তি বিন্যাস কবিতা লেখার জন্যে খুব জরুরী। কোনো কোনো ছন্দকার তাদের বইতে চরণ আর পঙক্তি সমার্থক হিসেবে ধরেই কবিতার ছন্দ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সব সময় তা ঠিক নয়। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতাটি দেখা যাক।


"ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠরে"
এখানে,
লাইনের সংখ্যা= পঙক্তির সংখ্যা= চরণের সংখ্যা=১
অর্থাৎ চরণ আর পঙক্তি সমান।


নজরুল লিখেছেন,
ভোর হল
দোর খোল
খুকুমণি ওঠরে।


এখানে,
লাইনের সংখ্যা= পঙক্তির সংখ্যা=৩
কিন্তু, চরণের সংখ্যা= ১
অর্থাৎ, চরণ আর পঙক্তি সমান নয়।
নজরুল চরণটি ভেঙেছেন। কেন ভেঙেছেন? তিনটি চিত্রকল্প তৈরির তাগিদে। কাজেই আমি পঙক্তি বিন্যাস কীভাবে করব তা নির্ভর করছে কবিতার ভাবের ওপরে। আগের যুগের কবিতাগুলোতে চরণ হিসেবেই পঙক্তি সাজানো হত। তখন ছিল অপ্রবহমান ছন্দ বা অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা এবং বিরাম বা যতি চিহ্নের ব্যবহার । প্রবাহমান ছন্দ বা অন্ত্যমিলবিহীন ছন্দের যুগে এসে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার কমে যেতে শুরু করে। আর গদ্যছন্দে এসে আরও কমে যায়।  আর ভার্চুয়াল যুগে এখন কবিতার লাইন বা পঙক্তি হয়ে গেছে অনেক ছোট ছোট। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, কবিরা পর্বানুসারে লাইন বা পঙক্তি সাজাচ্ছেন। অতএব আমরা লাইন ভাঙব চিত্রকল্প সৃষ্টির কারণে এবং পাঠের সুবিধার জন্যে।


স্তবক বিন্যাস
========


স্তবক সাজানো একটা শিক্ষা। কীভাবে স্তবক সাজাতে হয় তা জানতে হলে আমাদের এর বিন্যাসের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা এটা জানি যে অনেকগুলো চরণ নিয়ে একটি স্তবক গঠিত হয়। সাধারণত, একটি স্তবকে একটি ভাব প্রকাশিত হয়। স্তবক গঠিত হয় দুই বা আরো বেশি পঙ্‌ক্তি নিয়ে। একটি স্তবকে কবিতার মূল ভাবের এক অংশের প্রকাশ হয়, অন্য একটিতে পরিবেশিত হয় ভাবের আরেক অংশ, এবং সেই মত এগোয় কবিতার রচনা। পঙ্‌ক্তির সংখ্যা অনুসারে স্তবকের বিভিন্ন নাম হয়, যেমন- দ্বিক, ত্রিক, চতুষ্ক, ইত্যাদি। নিচে দুইটি দৃষ্টান্ত:


দ্বিক (Couplet) :


স্ফুলিঙ্গ তার  পাখায় পেল ক্ষণ কালের ছন্দ
উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই তারি আনন্দ  (‘লেখন – ৭’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


চতুষ্ক (Quatrain) :


ফুলে ফুলে  ঢ’লে ঢ’লে বহে কিবা মৃদু বায়,
তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়
পিক কিবা কুন্জে কুন্জে কুহু কুহু কুহু গায়,
কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় - হায়।  (‘কাল মৃগয়া’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


★বাংলা কবিতায় ছন্দ, পঙক্তি ও স্তবক সজ্জায় বিদেশী রীতির প্রভাব★


সনেটঃ


অনেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি বলে মনে করেন। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন মহাকাব্য, সনেট ও মনোনাট্যের। তিনি ১৪ চরণ ও ১৪ মাত্রার চতুর্দশপদ সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার সৃষ্টি করেন। এই ধরনের কবিতায় স্তবক থাকে মাত্র দুটি ; প্রথম স্তবকে আট চরন ও ভাবের অবতারনা এবং দ্বিতীয় স্তবকে ছয় চরন ও ভাবের পরিণতি । আবার তিনিই পরবর্তীকালে চৌদ্দ মাত্রার পয়ারে আট-ছয়ের চাল ভেঙে দেন এবং আঠারো মাত্রার মহাপয়ার রচনা করেন। তবে চতুর্দশপদী কবিতা কি বলার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক যে সনেট জিনিষটা কি।
ইতালীয়ান শব্দ সনেটো বা সনেটাস শব্দ হতে সনেট শব্দটির উৎপত্তি। এর আক্ষরিক অর্থ মৃদুধ্বনি। সনেট এক ধরনের নরম গীতিধর্মী কবিতা। ইতালীয়ান কবি পের্ত্রাক সনেটের জন্মদাতা। ইংরেজী ভাষায় প্রথম সনেট রচিত হয় ষোড়শ শতকে। ইংরেজী সনেট প্রথম পরিচিতি পেয়েছিল খ্রীষ্টীয় ১৬শ (ষোড়শ‏) শতাব্দীতে ' টমাস ওয়াট ' এর প্রয়োগের মাধ্যমে।
প্রথম বাংলা ভাষায় সনেট রচনা করতে গিয়ে মধুসূদন দত্তই এর নাম দিয়েছেন চর্তুদশপদী কবিতা। যা কিছুটা অঙ্কের মতো হিসাব কষে লেখার বিষয়। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পের্ত্রাকের আঙ্গিকগত আর্দশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম ১৮৬০ সালে ‘বঙ্গভাষা’
কবিতাটি রচনা করে বাংলা সনেটের প্রবর্তন করেন। মধুসূদন বাংলায় সনেট লেখার আগে ইংরেজিতে আঠারোটি সনেট রচনা করেছেন। তিনি অবশ্য ভার্সাই থেকে গৌরদাসকে লেখা এক চিঠিতে সনেট রচনায় পেত্রার্ককে অনুসরণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সনেট বা এই চত্র্দশপদী কবিতার কিছু নির্দ্দিষ্ট নিয়মকানুন ছিল বা আছে।আগে একটু তাদের সম্বন্ধে বলে নিই। তাতে যদি ব্যাপারটা একটু বোধগম্য হয়।
১)  ১৪ বা ১৮ মাত্রার চরণ হয়…
২)  দুই স্তবকে ১৪টি চরণ থাকে,
সাধারণত দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮টি ও ৬টি চরণ থাকে (চরণ বিন্যাসে ব্যতিক্রম থাকতে পারে),প্রথম আটটি চরণের স্তবককে অষ্টক ও শেষ ৬টি চরণের স্তবককে ষটক বলে…
৩)  এছাড়া সনেটের অন্ত্যমিল ও ভাবের মিল আছে এমন চারটি চরণকে একত্রে চৌপদী, তিনটি পদকে ত্রিপদীকা বলে…
৪)  নির্দিষ্ট নিয়মে অন্ত্যমিল থাকে…
৫) দুইটি স্তবকে যথাক্রমে ভাবের বিকাশ ও পরিণতি থাকতে হয়;


ব্যাপারটাকে সহজে ব্যাখ্যা করতে গেলে তা অনেকটা এভাবে বলা যায়- প্রথম স্তবকে কোন সমস্যা বা ভাবের কথা বলা হয়, আর দ্বিতীয় স্তবকে সেই সমস্যার সমাধান বা পরিণতি বর্ণনা করা হয়, অষ্টকে যে ভাব প্রকাশিত হয় ষটকে তার সম্প্রসারণ থাকে, অনেক সময় বা ঈষৎ সরানো বক্তব্য এমনকি বিরোধী কোনো প্রশ্নও উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু অষ্টক-ষটক মিলিয়ে কবিতার একটি অখণ্ড মণ্ডল রচিত হয়…
৬)  ছন্দের পয়ার বা Iambic Pentameter থাকা বাঞ্জনীয় …
(প্রসঙ্গত বলে নিই, Iambic ছন্দ ইংরাজী কবিতার একটি বিশেষ ধারার ছন্দ, যে ছন্দে একটি weak syllable-এর পরে একটি strong syllable বসে foot বা পর্ব গঠন করে তাকে Iambic ছন্দ্ বলে। যেমনঃ
Come live with me and be my love,
And we will all the pleasure prove
( The Passionate Shepherd to his love/Christopher Marlowe)
আবার বাংলার পয়ার ছন্দটিকেও ঠিক একইভাবে ভেঙে দেখানো যায়:
সুন্দর দেখিয়া গবী/কহিল স্বামীরে।
কাহার সুন্দর গবী/দেখ বনে চরে।।
দিব্যবসু বলে, এই/বশিষ্ঠের গবী।
কশ্যপের অংশ জন্ম/জননী
সুরভী।। (মহাভারত/কাশীদাসী))
৭)  সনেটের ভাষা মার্জিত এবং ভাব গভীর ও গম্ভীর হতে হয়।


বাংলাভাষায় সাধারনত ৩ ধরনের সনেটের চর্চা হয়। পেত্রার্কীয় সনেট, শেক্সপীয়রীয় সনেট ও ফরাসি সনেট; এই ৩ রীতির সনেটের প্রধান পার্থক্য অন্ত্যমিলে। এবার আমার সীমিত জ্ঞানে দেখে নিই ব্যাপারটা আদতে কি।
পেত্রাকীয় সনেটের গঠন প্রকৃতি ১৪ সংখ্যাটির মধ্যে প্রবলভাবে সীমাবদ্ধ। আর এতে স্তবক থাকে মাত্র দুটি ; প্রথম স্তবকে আট চরন ও ভাবের অবতারনা এবং দ্বিতীয় স্তবকে ছয় চরন ও ভাবের পরিণতি । পেত্রার্কীয় গঠন প্রণালী ----- কখখক  কখখক     গঘঙগঘঙ  অথবা  কখখক  কখখক  গঘগঘগঘ    


বঙ্গভাষা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত


হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব ∣ বিবিধ রতন;- ∣∣  (৮+৬)   ক
তা সবে, (অবোধ আমি!) ∣ অবহেলা করি, ∣∣ (৮+৬)  খ
পর-ধন-লোভে মত্ত, ∣ করিনু ভ্রমণ ∣∣ (৮+৬)   ক
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি ∣ কুক্ষণে আচরি। ∣∣ (৮+৬)  খ    অষ্টক
কাটাইনু বহু দিন ∣ সুখ পরিহরি। ∣∣ (৮+৬)   খ
অনিদ্রায়, অনাহারে ∣ সঁপি কায়, মনঃ, ∣∣ (৮+৬)  ক
মজিনু বিফল তপে ∣ অবরেণ্যে বরি;- ∣∣ (৮+৬)   খ
কেলিনু শৈবালে, ভুলি ∣ কমল-কানন। ∣∣ (৮+৬)   ক


স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী ∣ কয়ে দিলা পরে,- ∣∣ (৮+৬)  গ
ওরে বাছা, মাতৃকোষে ∣ রতনের রাজি ∣∣, (৮+৬)   ঘ
এ ভিখারী-দশা তবে ∣ কেন তোর আজি? ∣∣ (৮+৬)  ঘ    ষটক
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, ∣ যা রে ফিরি ঘরে। ∣∣ (৮+৬)  গ
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; ∣ পাইলাম কালে ∣∣ (৮+৬)  ঙ
মাতৃভাষা-রূপ খনি, ∣ পূর্ণ মণিজালে । ∣∣। (৮+৬)  ঙ
বাংলাভাষায় শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেট বহুলাংশে রোমান্টিক সনেট হিসেবেই বিশেষ ভাবে পরিচিত । কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধাঁচে সনেট লিখেছেন। শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেটে স্তবক থাকে চারটি , ৪+৪+৪+২, যার চারটি স্তবকের মধ্যে প্রথমটিতে থাকে "উপক্রমণিকা" , দ্বিতীয়টিতে বিষয়ের "বিশ্লেষণ" , তৃতীয়টিতে  "মর্মরূপায়ণ" এবং সর্বশেষে
"সিদ্ধান্ত বা মন্তব্য" । শেক্সপিয়রীয়ান গঠন প্রণালী-----  কখকখ  গঘগঘ  ঙচঙচ  ছছ।
এইবার শেক্সপীয়রিয়ান রীতি অনুযায়ী  লিখিত বাংলা কবিতার উদাহরণ পেশ ক’রা যাক। আমরা বেছে নিচ্ছি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘মহাসত্য’  কবিতাটি।
      
অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ; (ক)
অসংগত চিরপ্রেম;সংবরণ অসাধ্য,অন্যায় ; (খ)
বন্ধদ্বার অন্ধকারে প্রেতের সন্তপ্ত সঞ্চরণ  (ক)
সাঙ্গ ক’রে ভাগীরথী অকস্মাৎ বসন্তবন্যায়।।(খ)


সে মিলন অনবদ্য, এ-বিরহ অনির্বচনীয় (গ)
ধ্বংসসার স্বপ্নস্তুপে অচিরাৎ হারাবে স্বরূপ; (ঘ)
আশা আজি প্রবঞ্চণা; দিব না স্মারক অঙ্গুরীয় ;(গ)
ব্যবধি ব্যাপক জেনে অঙ্গীকার নির্বোধ বিদ্রূপ।।(ঘ)


তবু  রবে অন্তঃশীল স্বপ্রতিষ্ঠ চৈতন্যের তলে (ঙ)
হিতবুদ্ধিহন্তারক ক্ষণিকের এ-আত্মবিস্মৃতি;  (চ)
তোমারই বিমূর্ত প্রশ্ন জীবনের নিশীথ বিরলে (ঙ)
প্রমাণিবে মূল্যহীন আজন্মের সঞ্চিত সুকৃতি।।(চ)


মৃত্যুর পাথেয় দিতে কানা কড়ি মিলিবে না যবে ,(ছ)
রূপান্ধ যুবার ভ্রান্তি সেই দিন মহাসত্য  হ’বে ।। (ছ)


এই চতুর্দশপদীটিতে কবি হুবহু শেক্সপীয়রীয় রীতি কে মান্যতা দিয়েছেন । স্তবক বিভাগ থেকে চরণের মিল পর্যন্ত। অন্তিম দু’লাইনে সেই ঘূর্ণন। উপসংহার । চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের প্রয়োগ। যাকে ‘Volta marks’ বলা হ’য়ে থাকে ।
এবার দেখা যাক জয় গোস্বামী’র ‘ ক্রিশমাস ও শীতের সনেট গুচ্ছ’-তে পদান্ত্যমিলবিন্যাস  সর্বত্র মান্যতা পায়নি। তবে  স্তবক বিভাগে শেক্সপিয়রীয় আঙ্গিক-ই অনুসৃত হ’য়েছে । একজন প্রকৃত কবি, তাঁর স্বকীয়তাকে ফুটিয়ে তুলবার প্রচেষ্টা চালাবেন, এটাই স্বাভাবিক এবং সেই  নিজস্বতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাকে সমীহ না করেও উপায় নেই।


ফরাসী সনেট এর স্তবক সংখ্যা থাকে শেক্সপীয়রীয় রীতির মতই চারটি তবে চরন – এর তারতম্য আছে এখানে । ফরাসীতে চারটি স্তবক যথাক্রমে ৪+৪+৩+৩ অথবা ৪+৪+২+৪ চরন নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে আর ভাবের অবতারনা ও পরিণতির বিষয়ে এখানে অতটা দৃঢ় ব্যাকরণের নজর পাওয়া যায় না । আর এ কারনেই রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের বাংলা সাহিত্যিকদের মাঝে এ রীতির ব্যাপক চর্চা লক্ষ্যণীয় । ফরাসী সনেট গঠন প্রণালী - ক+খ+খ+ক  ক+খ+খ+ক গ+গ  চ+ছ+চ+ছ।
বাংলা কবিতায় সনেট সৃষ্টিতে এগিয়ে আছেন আল মাহমুদ। সমসাময়িক কালে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকেই সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা লিখেছেন। পরবর্তীতেও চতুদর্শপদী কবিতা রচনার ধারা অব্যাহত রয়েছে। কবি আল মাহমুদ তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে ‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক চৌদ্দটি সনেট রচনা করে সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশিত হবার পর উভয় বাংলায় তথা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে আল মাহমুদের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। অনেকেই দম্ভ করে কোমর বেঁধে নেমে ছিলেন সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছকে অতিক্রম করতে। কিন্তু আজো পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কোন কবির পক্ষে সোনালি কাবিনকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি।


বাংলা সনেটের মেলবন্ধনে আল মাহমুদ ইতালিয়ান সনেট ও শেক্সপিরিয়ান সনেট উভয় রীতিকে অনুসরণ না করে নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আঠার মাত্রার পংক্তি রচনা করেছেন তিনি। মধুসূদনের মতো ১৪ মাত্রার সনেট সোনালি কাবিনে নেই। পর্ব ভাগ ৮+১০ কিংবা ১০+৮ মাত্রায় বিন্যস্ত। মেলবন্ধনে ক-খ, কখ, গক, গক, ঘচ, ঘচ, ছছ। আবার কখ, কখ, গঘ, গঘ, ঙচ, ঙচ, ঙচ, মেলবন্ধনও দিয়েছেন। তাই বলে সনেটের বৈশিষ্ট্য ও ভাবের সংহতি কোথাও বিঘ্নিত হয়নি।
নদীর সিকস্তি কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ-ক
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার-খ
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও-ক
সে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার খ
অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত-গ
তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস-ঘ
খোরাকির শত্রু আনে যত হিংস্র লোভের আঘাত-গ
আমরা ফিরাবো সেই খাদ্যলোভী রাহুর তরাস-ঘ
নদীর চরের প্রতি জলে খাওয়া ডাঙার কিষঠু-ঙ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাঁই অধিকার তার,চ
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান-ঙ
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার’-চ
ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান-ঙ
ঝড়ের কসম খেয়ে, বলো নারী, বলো তুমি কার?-চ
(সোনালি কাবিন-১২)


তেরজারিমা (বা তের্ৎসারিমা)ঃ
এটা একটা ইতালিয়ান "স্তবকবিন্যাস" বা স্ট্যাঞ্জা ফর্ম এবং একটা ত্রিপদী ছন্দ। এটা স্তবক বিন্যাসে ত্রিক-এর সমধর্মী। বাংলায় অনেকেই তের্ৎসারিমা লিখছেন। জীবনানন্দের "শকুন" কবিতাটি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।


শকুন
জীবনানন্দ দাশ


মাঠ থেকে মাঠে মাঠে —সমস্ত দুপুর ভরে এশিয়ার আকাশে আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে;মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি —নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে


আরেক আকাশ যেন —সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর
কঠিন মেঘের থেকে —যেন দূর আলো ছেড়ে ধুম্র ক্লান্ত দিক্‌হস্তিগণ
পড়ে গেছে —পড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের ‘পর


এই সব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহুর্তে শুধু —আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম্‌ গাছে —পাহাড়র শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে;
একবার পৃথিবীর শোভা দেখে —বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন


বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে,দেখে তাই —একবার স্নিগ্ধ মালাবারে
উড়ে যায় —কোন্‌ এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন
পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চলে যায় যেন কোন্‌ মৃত্যুর ওপারে;


যেন কোন্‌ বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষন্ন লেগুন
কেঁদে ওঠে…চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে গেছে সেই সব হূন।


রাউন্ডেল বিন্যাসঃ এই বিন্যাসটি ইংরেজ কবি সুইনবার্ন প্রয়োগ করেছিলেন। তিনটি স্তবকে বিন্যস্ত এ-কবিতায় মিলবিন্যাস এরকম – ক খ ক এবং প্রথম দুই শব্দের পুনরাবৃত্তি।


দাও হাতছানি! ধাবমান নদী,ঝিকমিক তারা;
পরাগ-কেশরে বাসন্তী জামা; গাঢ় নীল টিপ
অপরাজিতায়;প্রজাপতি সব সংবিৎহারা :
দাও হাতছানি!

ভিলানেলঃ


ইটালীয় ভাষায় ভিলানেল অর্থ গ্রামীণ বা সাদাসিদে। ফরাশি কবি জাঁ পাসেরাত (১৫৩৪-১৬০২) সম্ভবত একে নির্দিষ্ট বিন্যাসে নির্ধারিত করেন। এতে থাকে পাঁচটি তিন পংক্তির স্তবক (আমরা একে ত্রিপদী বলতে পারি) ও শেষে একটি চার পংক্তির স্তবক (চতুষ্পদী বলা যায়)। কয়েকজন ইংরেজ কবি, যথা অস্কার ওয়াইল্ড, ডব্লিউ এইচ অডেন প্রমুখ এই প্রকরণে কবিতা লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় বিষ্ণু দের আগে আর কেউ এটা ব্যবহার করেছেন কি না বলতে পারছি না। বিষ্ণু দের প্রয়োগ বড় চমৎকার।


ট্রিয়োলেটঃ


এটি একটি ফরাসী কাব্যবন্ধ। আট পংক্তি, মিল দুইটি। প্রথম পংক্তিটি চতুর্থ ও সপ্তম পংক্তিতে পুনরাবৃত্ত হয়। আর, দ্বিতীয় পংক্তিটি শেষ পংক্তিতে পুনরাবৃত্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে ফ্রান্সে এর উদ্ভব ঘটে। ইংরেজ কবিদের মধ্যে রবার্ট ব্রিজেস সফল ভাবে এটি ব্যবহার করেন। বাংলা ভাষায় বিষ্ণু দে এর চমৎকার প্রয়োগ ঘটান; তবে তিনি শেষের পুনরাবৃত্ত দুই পংক্তি ব্যবহার করতেন না। প্রমথ চৌধুরী প্রকরণটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এই বিন্যাসে কবিতা লিখেছেন।


বালাদ বা ব্যালেঃ


নামটির উৎস প্রাচীন ফরাশি নাচের গান। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে জনপ্রিয় ছিলো এই কাব্য প্রকরণ। বাংলা ভাষায় অরুণ মিত্র এই প্রকরণ ব্যবহার করেছেন।


হাইকুঃ


জাপানের ঐতিহ্যবাহী কবিতা-প্রকরণ হাইকু। হাইকু শব্দটি বহুবচন। এর একবচন 'হাইকি'। কবি মাতসুও বাশো (১৬৪৪-৯৪) বুসন (১৭১৫-৮৩) ও ইসা (১৭৬২-১৮২৬) এঁরা হচ্ছেন জাপানের সুপ্রসিদ্ধ হাইকু কবিতার রচয়িতা। মাত্র তিনটে পঙক্তিতে সম্পূর্ণ একটি কবিতা। দলবৃত্তিক (সিলেবিক) ছন্দে রচিত পঙক্তিত্রয়ে মাত্রাবিন্যাস যথাক্রমে ৫+৭+৫ এবং অমিল।
ষোড়শ শতকে প্রকরণ হিশেবে হাইকু এলেও হাইকু নামটি মূলত উনবিংশ শতাব্দী থেকে প্রচলিত হয় _ বিশিষ্টতা অর্জন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণে জাপানি হাইকু কবিতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে জাপান ভ্রমণে যান এবং হাইকু কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি সরাসরি হাইকু কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। তবে কোথাও তিনি হাইকু নামটি ব্যবহার করেননি; বলেছেন, তিন লাইনের কাব্য। বাংলাদেশের  তৈযাব রহমান,কলকাতার বরুণ চক্রবর্তী, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ বসু চেষ্টা করেছেন বটে তবে এই রীতি এখানে জনপ্রিয় হয় নি।


এর বাইরেও বেশ কিছু প্রকরণ বা রীতি বাংলা কবিতায় অনুসরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেগুলি আদৌ ফলপ্রসূ হয় নি।


★ কারো ভালো লাগলে আশাকরে সাড়া দেবেন। কারো প্রশ্ন বা জানার থাকলেও বলতে পারেন। আমিও শিখছি প্রতিনিয়ত ★