ইরাবতী হাঁটে না আর — নিঃশব্দে ভেসে যায় বাতাসে,
তার চোখে ছিল একবার নীল নদীর মতো ভাষা,
আজ সে চোখ দুটি শুধু দেয় নিস্পলক পাথরের আশ্বাস,
আর ঠোঁটে?
সেখানে আগুন নেই, নেই বরফ — আছে শুধু
এক গোপন পাহাড় — যেখানে কান্নাও ঢোকে না।

ইরাবতীর একটি নদী ছিল একদিন —
জন্মসূত্রে না, প্রেমসূত্রে।
সেই নদীর নাম সে কারো কাছে বলেনি কখনো,
শুধু এক সন্ধ্যায় কাঁধে হাত রেখে বলেছিল—
"তুই জানিস তো, কিছু নদী নিজে থেকেই শুষে যায়,
জল বাঁচায় না, স্বপ্ন শুষে নেয়।"
তারপর এক দীর্ঘ মৌনতা,
যার ভাষান্তর হয়নি, হবে না।

স্মৃতির খামে রাখা কিছু পত্রে
ইরাবতীর হাতের লেখা কাঁপত,
"তুমি যে আসবে না, জানতাম,
তবু চিঠি লেখা থামাইনি,
কারণ চিঠির কালি শুকিয়ে গেলে
আমার দুঃখগুলো হালকা লাগত।"

আরও লিখেছিল একবার—
"ভালোবাসা মানে অপেক্ষা না,
ভালোবাসা মানে — যখন কেউ ফেরে না,
তবুও জানলার পাশে বসে থাকা।”

ইরাবতীর নীরবতা একদিন
শব্দে পরিণত হতে চেয়েছিল,
কিন্তু চারপাশে শব্দেরা ছিল ব্যস্ত —
রাজনীতি, উৎসব, প্রাচীন গল্পে।
ইরাবতীর চুপ কথা তখন
আলগোছে একদিন ধরা পড়ল
এক অন্ধ সেতারির সুরে —
সে বলেছিল,
“এই সুর কার জন্য, ঠাকুর?”
সেতারি হেসে বলেছিল,
“এটা তো এক নারীর অভিমানের পেছনে লুকানো গান,
যার নাম ছিল ইরাবতী।”

কেউ জানত না,
ইরাবতীর চুলের গন্ধে লেগে ছিল শালের বন,
আর ঠোঁটে লেগে ছিল
এক পুরনো কবির অসমাপ্ত কবিতা।
সে নিজেই ছিল একটা উপন্যাস —
শুধু প্রথম পাতায় নাম ছিল না।

তার শেষ প্রেমিক, যে ফিরে গিয়েছিল
নিজের ব্যস্ত জীবনে,
সেই একবার স্বপ্নে বলেছিল —
“তুই তো রাগ করলি না ইরাবতী,
তুই তো শুধু নিঃশব্দে আমায় মাফ করে দিলি।”
ইরাবতী জবাব দেয়নি,
সে তখন এক গুচ্ছ বকুলফুল হাতে
এক মৃত প্রজাপতির জন্য
শ্রদ্ধাঞ্জলি সাজাচ্ছিল।

ইরাবতীর চুপ কথা আজ
দেয়ালে দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে,
স্টেশনের শেষ বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ে
এক অবুঝ বৃদ্ধার পাশে।
আকাশে নক্ষত্র উঠে যখন,
কারা যেন ফিসফিস করে —
"এই যে শব্দহীন মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছে,
ও কি ইরাবতী?"

না, ওর নাম আজ আর কেউ জানে না।
শুধু কানে বাজে একটা অস্ফুট চরণ —

“তোমার মৌনতার ভাষা আমি শিখেছিলাম একা,
তাই আজও আমার ভালোবাসা — এক চুপ নদী বেয়ে বয়ে চলে নির্ভীক অনিশ্চয়তায়।”