বোশেখ মাসের বাইশ তারিখ দিনটি ছিল সোম,
ফসল মাঠে জমা ছিল কাজ ছিল না কম।
আকাশটাতে মেঘের হঠাৎ আনাগোণা চলে,
বৃষ্টি হলে ফসলাদি ডুববে হাঁটু  জলে।


এটাই ভেবে স্বামী আমার ছুটল  মাঠের দিক,
আমার মাথায় হুশ হলোনা করল কি না ঠিক।
খানিক পরে কালো মেঘে আকাশ গেলো ছেয়ে,
বাবার লাগি কাঁদতে থাকে ছোট্ট ছেলে-মেয়ে।


ছুটে গেলাম পাশের বাড়ি নরেশ কাকার বাড়ি,
যাওগো কাকা তারে ডেকে আনো তাড়াতাড়ি।
বলল কাকা এমনতর মেঘ করেছে আজ,
এমন সময় পাঠালে ক্যান করতে মাঠে কাজ।


কতজনার পা ধরেছি কেউ গেল না মাঠে,
স্বামীর লাগি ছটফটায়ে হৃদয়খানি ফাঁটে।
কি যে করি ছেলে মেয়ে রেখে যদি যাই,
ছোট্ট ওরা বাড়িতে যে দেখার কেউ-ই নাই।


কালো মেঘের পাশাপাশি দিচ্ছে মেঘের ডাক,
হে বিধাতা স্বামীর জীবন রক্ষা শুধু পাক।
স্বামী ছাড়া এ জগতে নেই যে আপন জন,
বাঁচাও তারে আজকে তুমি বিপদের এ ক্ষণ।


বুকের মাঝে হাজার কথার উথাল পাথাল ঢেউ,
এই অভাগীর ব্যাথা বোঝার নেই যে পাশে কেউ।
ঘরে ছোট ছেলেমেয়ে বিপদমুখে স্বামী,
কি যে করি দাও গো বলে ও হে অন্তর্যামী।


আমার জীবন বিনিময়ে স্বামীর জীবন দাও,
স্বামী ছাড়া নারীর জীবন বৈঠা ছাড়া নাও।
বুকের মাঝে হাজার রকম চিন্তা করে ভর,
বোশেখ মাসে পুড়ল বুঝি আমার সাধের ঘর।


কতজনার পা ধরেছি খোঁজ এনে দাও ভাই,
সে ছাড়া কেউ এই জগতে আমার আপন নাই।
মনের ব্যাথা বুঝবে এখন সাধ্য আছে কার,
যে-ই কেবল ভুক্তভোগী বেদন শুধু তার।


সন্ধ্যা নেমে আসল যখন বুকটা আরো কাঁপে,
নানান কথা মনের মাঝে পাহাড় সম চাপে।
ছোট্ট দুটো ছেলে-মেয়ে হাত দুটি না ছাড়ে।
দু'দিকেরই চিন্তা নামে পাহাড়সম ঘাড়ে।


এমনতর সময় যেন আর কাটে না মোটে,
নানা রকম চিন্তা শুধু এই মাথাতে জোটে।
কারো আশায় আর না থেকে রওনা দিলাম একা,
সুস্থদেহে পাইগো যেন প্রাণ ভোমরার দেখা।


অনেকটা পথ দৌড়ে গেলাম অনেকটা পথ হেঁটে,
রক্ত পায়ে পড়ছিল বেশ কখন জানি কেটে।
পথটা মনে হচ্ছিল তাই হাজার মাইল দূর,
প্রাণের মানুষ বিপদমুখে কোন সে অচীন পুর।


রাত বাড়ার-ই সাথে সাথে আঁধার ছিল ঘোর,
তেমনি ছিল খুবটা জোরে দমকা হাওয়ার জোর।
ক্ষুদার জ্বালায় ক্ষীপ্ত হয়ে বাঘ যেমনি ছোটে,
তেমনি করে যাচ্ছি আমি ভয় করি না মোটে।


তান্ডবেরই নৃত্য চলে ঐ আকাশেরই গায়,
প্রবল বেগে ঝড়ো বাতাস এগোয় না যে পায়।
পিছন দিকে টানছে যেন কয়েকশত জন,
প্রবলবেগে বাতাসেতে পিছোই খানিকক্ষণ।


মড়মড়িয়ে ভাংছিল খুব গাছপালারই ডাল,
তবু আমি যাচ্ছি চলে ছাড়ছি না তো হাল।
ডাল কখনও গায়ের উপর ধপাস করে পড়ে,
তবু মনে বাঁধ মানেনি এমনতর ঝড়ে।


মনে কি আর বাঁধ মানে গো এমন বিপদ হলে,
হাজার রকম শঙ্কা তখন মনের মাঝে চলে।
কেমন আছে প্রাণের মানুষ কোথায় আছে আজ,
ভয়টা মনে প্রাণ নিল কি কালবোশেখের বাজ।


কষ্টে যাওয়া পথটা যেন হয় না মোটে শেষ,
এ বেদনা কার বা কাছে আজকে করি পেশ।
একাই মাঠে ছুটে গেলাম ছেলে মেয়ে ছেড়ে,
ভয়টা শুধু স্বামীর জীবন নেয় কি ঝড়ে কেড়ে।


আধেক আলো আধেক কালো মেঘের এমন ডাক,
ভয় করি না আমার জীবন যায় চলে যায় যাক।
মাঠের মাঝে গিয়ে খুঁজে পেলাম না তার খোঁজ,
যে জমিতে একা একা আসত কাজে রোজ।


ঘুর পাকেতে চলছে বাতাস ভয়ংকরী রুপ,
স্বামীর এমন বিপদমুখে থাকবো কত চুপ।
হে বিধাতা তোমার কাছে এটা যেন পাই,
আমার জীবন বিনিময়ে স্বামীর জীবন চাই।


কত ডাকা ডাকছি তবু তাও আসো না কাছে,
তুমি ছাড়া এই জীবনের মূল্য কি বা আছে।
ফিরে এসো প্রাণের স্বামী ব্যাকুল হয়ে ডাকি,
দাও গো সাড়া এই যে আমি তোমার পরাণ পাখি।


হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম খোঁজ না পেয়ে তার,
আকাশ সমান কষ্ট এসে চাপলো মাথায় ভার।
কি যে করি কোথায় খুঁজি এমন ঝড়ো রাতে,
ফিরে এসো ছেলে মেয়ে আছে অপেক্ষাতে।


কাছে এসো যেথায় আছো ডাকছি বারে বার,
কষ্টে রেখে দূরে সরে থেকো না তো আর।
প্রানের মানুষ থাকলে দূরে প্রাণ টা কি আর রয়,
অনেক হলো দূরে থাকা আর যে দূরে নয়।


এত ডাকি তবু তুমি শুনছ না কি কানে,
তোমায় ছাড়া এ জীবনের নেই তো কোন মানে।
খানিকটা পথ এগিয়ে দেখি ছোট্ট গাছের গোড়,
কি যেন কি পড়ে আছে একটু দিলাম দোড়।


গিয়ে দেখি অসাড় দেহ কাদার মাঝে নুয়ে,
সারা গায়ে কাঁদামাখা উপুড় হয়ে শুয়ে।
আমার প্রাণে প্রাণ ছিল না এমন তারে দেখে,
কারে ডাকি কি যে করি প্রাণের স্বামী রেখে।


প্রাণের মানুষ ডাক শোনে না এত ডাকার পরে,
তোমার কারণ ছেলে-মেয়ে  ছটফটায়ে মরে।
কখন বাবা আসবে ঘরে সেই আশাতে আছে,
ফিরে এসো দুজন মিলে যাবো তাদের কাছে।


অনেক জোরে ধাক্কা দিলেও খুলছে না তার চোখ,
কি যে করি কারে ডাকি নেই তো কোন লোক।
প্রাণের মানুষ কেমন করে পড়ে আছে একা,
এমনতর বিপদে আজ কার গো পাবো দেখা।


কষ্ট করে উঠাই তবু শরীরটা না তোলে,
ডাকছি তবু এত ডাকা চোখ দুটো না খোলে।
হতাশ হয়ে বুকের কাছে যেই পেতেছি কান,
নেই যে কোন শব্দ সাড়া নেই যে তাতে জান।


হৃদয় ভাঙা চিৎকারেতে আকাশ হল ভার,
এমন ক্ষতি পূরণ করার সাধ্য আছে কার।
আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, কাঁদে মাঠের ঘাস,
অসার দেহে কোলের মাঝে প্রানপতির লাশ।


একটু আগেও যেজনা যে আসল ছেড়ে ঘর,
এখন হল সে জনা যে যোজন যোজন পর।
ইচ্ছে হলেই আর পাবো না আপন করে কাছে,
সাত পাকেতে যে জনাতে স্বপ্ন বাঁধা আছে।


এমনতর করলে তুমি হে বিধাতা কেনো?
এ বেদনা কালনাগিনীর বিষের ছোবল যেনো।
এ জ্বালা যে কেমন জ্বালা বোঝাই আমি কারে,
ব্যাথা বোঝার মানুষ যেজন হারালাম আজ তারে।


সারাজীবন থাকবে পাশে এই করেছো পণ,
সে কথা আজ কোথায় গেলে ও গো আপনজন।
যে হাত দিয়ে আনলে আমায় ছোট্ট তোমার ঘর,
সে ঘর আজি ভাঙলো আমার কালবোশেখী ঝড়।


ক্ষেতের কাজে যাওয়ার সময় একটু খানি পরে,
মিথ্যে ছুতোয় বাসতে ভালো আসতো ফিরে ঘরে।
তোমায় হারা হয়ে জীবন ভাসলো জলে কূল,
অকালে আজ ঝরে গেল সদ্য ফোঁটা ফুল।


পাড়ার লোকে শোনাবে যে হাজার কথার বান,
কতক সময় থাকব বুজে আমার দুটি কান।
ঘরে আমার জা শাশুড়ী ধরবে টেনে চুল,
নানান কথার পাহাড় এসে ভাঙবে বাঁচার কূল।


দিব্যি দিয়ে বলছি তোমায় আমার মাথা খাও,
হে বিধাতা স্বামীর সাথে আমার জীবন নাও।
আমায় কেন নিচ্ছোনা যে দু'চোখ দিয়ে চিনে,
কেমন করে বাঁচব আমি স্বামীর জীবন বিনে।


কোথায় আছে মানিক আমার কোথা বুকের ধন,
এগিয়ে এসে কেউ বলে যাও ওগো আপন জন।
কখন যাবো বাড়ি আমি কখন যাবো ঘর,
সোনার মানিক একা কাঁদে ঘরের ই ভেতর।


ছোট্ট ওরা ঝড়ের মাঝে হয়ত পাবে ভয়,
এতক্ষণে হয়ত আমায় খুঁজছে বাড়িময়।
বাবার আশায় বসে যখন জানবে বাবা নাই,
কি কথাতে বোঝাবো যে ভাবছি আমি তাই।


একটু চোখের আড়াল হলে ভাসায় চোখের জল,
কি বোঝাব ভেবেই আমার কমছে মনের বল।
সামনে নিয়ে যাবো যখন বাবার মরা দেহ,
শান্তনাতে কি বোঝাব বোঝাও আমায় কেহ।


নানান কথা ভাবনা বুকে পাহাড় সমান ক্ষত,
স্বামীর দেহ নেবো কেমন ভাবছি অবিরত।
ঘরখানাতে বুকের মানিক কাঁদছে বসে একা,
এতক্ষণে ও আপনজনার হয় মেলেনি দেখা।


স্বামীর অসার দেহ নিয়ে ফিরবো কেমন ঘর,
ভালোবাসার মানুষ এখন আকাশসম ভর।
সারাপথে টানছি একা পিটখানা তার পোড়া,
পারছি না তো ভাঙা হৃদয় আজকে দিতে জোড়া।


বাড়ি যাওয়ার পথ যেন আজ লম্বা ভারী বেশ,
পথ যেন আজ বহু দূরের হয় না যেন শেষ।
সন্তানেরে রেখে এলাম লাম্পো দিয়ে হাতে,
রেখে এলাম মানিক দুটোর এমনতর রাতে।


পাখি যদি হতাম তবে উড়ে যেতাম বাড়ি,
দূরত্বকে খুব সহজে দিতাম আমি পাড়ি।
ছোট্ট আমার মানিক সোনা কাঁদছিল বার-বার,
স্বামীর জীবন বাঁচার লাগি ছেড়ে গেলাম তার।


যাওয়ার সময় মা মা বলে হাতটা শুধু ধরে,
বুকের মানিক ছেড়ে গেলাম একা রেখে ঘরে।
ছোট্ট ওরা আমায় ছাড়া বুঝত না যে কিছু,
ছেড়ে এলাম আসছিল যে আমার পিছু পিছু।


শেষ হয়েছে এতক্ষণে অপেক্ষারই ক্ষণ,
বাড়ি গিয়ে দেখি সেখায় অনেক মানুষজন।
কি যেন কি ঘিরে সেথায় দাঁড়িয়ে আছে তারা,
খানিক আগে ডেকেও যাদের পাইনি কোন সাড়া।


লোক সরিয়ে এগিয়ে দেখি আমার মানিক জোড়া,
উঠানে তার অসার দেহ খানিকটাতে পোড়া।
হে বিধাতা কেমনতর শাস্তি দিলে আজ,
কপালটাতে এঁকে দিলে কেমন দুখের ভাঁজ।


তোমার কাছে রেখে গেলাম আমার অবুঝ পাখি,
আজকে তাদের পোড়া দেহ বন্ধ দুটি আঁখি।
কি অপরাধ তোমার কাছে এই দুনিয়ার পর,
নিভিয়ে দিলে আশার প্রদ্বীপ শূন্য করে ঘর।


এই ব্যাথা যে কেমন ব্যাথা কার কাছে তা কই,
এমন আঘাত আজকে আমি কেমন করে সই,
এমনতর বোশেখ কেন আসল আমার ঘর,
প্রাণের পাখি কেড়ে নিয়ে করলে আমায় পর।


মাঝ দরিয়ায় ডুবিয়ে দিলে আমার আশার নাও,
সবই নিলে জীবন থেকে আর কি তুমি চাও?
স্বামী নিলে সন্তানেরে তাও নিলে কেড়ে,
কেমন করে থাকব বেঁচে প্রাণের মানুষ ছেড়ে।


কি নিয়ে আর থাকব বেঁচে স্বপ্ন সুখের ঘর,
ভালোবাসার মানুষ গুলো করলে যখন পর।
শূন্যঘরে জীবন ভরে থাকব পড়ে রোজ,
আপনজনার কেউই এসে করবে না তো খোঁজ।


এই অভাগীর এই জগতে রইল না আর দাম,
কপাল জুড়ে লেপ্টে দিলে অপয়া বদনাম।
বুক ফেঁটে যায় সব হারায়ে সইব কত আর,
আপন মানুষ রইল না যে ব্যাথা শোনাবার।


এই বোশেখে লাগল আগুন আমার সুখের ঘরে,
ভাঙলো আমার সোনার তরী কালবোশেখী ঝড়ে।
এমনতর বোশেখ যেন আর আসে না কারো,
বিপদমুখে প্রানের মানুষ কেউ না যেন ছাড়ো।


ঝড় বৃষ্টি দেখলে কভু পা করো না বের,
নয় কপালে নামতে পারে দুঃখ নামের ফের।
কত বিপদ আসে নেমে একটু হলে ভুল,
যে বিপদে ভাঙতে পারে জীবন নামের কূল।।