আমাদের ইস্টিশন এর কুখ্যাত বলগার অঘূর্ণায়মান ইলেক্ট্রন একটা অভ্যাস আছে। তিনি কমেন্টে কবিতা বলার (পড়তে হবে লেখার) আগে বলে নেন, আমার নাম অঘূর্ণায়মান ইলেক্ট্রন। আমি একটি কবিতা বলব। কবিতার নাম - গরুখেকো ঘাস।


শুনলেই বোঝা যায়, তিনি পিচ্চিকালে বহুত কবিতা আবৃতি করেছেন। তাই অভ্যাস ছাড়তে পারেন নি। আমরা বাকিরাও অনেকেই হয়তো করেছি কবিতা আবৃতি। স্কুলের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাত পা নেড়ে নেড়ে আবৃতি করেছি -


ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠো রে
ওই ডাকে জুঁই শাঁখে ফুলখুকি ছোট রে।


কিন্তু, কখনও কি খেয়াল করেছি, 'ভোর হল' কিংবা 'জুঁইশাঁখে' বলার পর নিজের অজান্তেই কিছুক্ষণের জন্য থেমে যাচ্ছি? কেউ কেউ হয়তো করেছি। কিন্তু, বেশিরভাগ এরই অবচেতন মনে ঘটেছে ঘটনাটি।


এই থেমে যাওয়া থেকেই ছন্দের শুরু।
ছন্দ বুঝতে হলে সবার আগে বুঝতে হবে মাত্রা। এটা ক এর ওপর মাত্রা, গ এর ওপর অর্ধমাত্রা বা এ মাত্রাহীন এর মাত্রা নয়। ছন্দের মাত্রা ভিন্ন জিনিস। সহজ কথায়, একটা শব্দের যতটুকু অংশকে একবারে উচ্চারণ করা যায়, তাই মাত্রা। যেমন, মা শব্দটি একমাত্রা। আবার নীরবতা শব্দটি চার মাত্রা। কিন্তু, এই সহজ কথাটা আবার এত সহজ না। বন শব্দটি কোন ছন্দে একমাত্রা আবার কোন ছন্দে দ্বিমাত্রা। নির্ভেজাল শব্দে আরও ভেজাল। এই শব্দ কোন ছন্দে তিন মাত্রা, কোনটায় চার মাত্রা আবার কোন ছন্দে পাঁচ মাত্রা।


মাত্রা আর ছন্দের ভেজালে যাবার আগে আরও দুটো বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নেয়া ভাল। একটা হচ্ছে অর্ধমাত্রা আরেকটা হচ্ছে পর্ব।


এই অর্ধমাত্রা মোটেও গ এর ওপর অর্ধমাত্রা না। অর্ধমাত্রার বিষয়টা একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। আসন শব্দটার কথা ধরা যাক। আ একবারে উচ্চারণ করা যায় বলে এটা একমাত্রা। কিন্তু, সন একবারে উচ্চারণ করা গেলেও এটা উচ্চারণ করতে আ কিংবা মা এর থেকে বেশি সময় লাগে। তাই, স কে একমাত্রা ধরা হয়। আর ন উচ্চারিত হয় স এর ঘাড়ে চেপে। তাই ন কে ধরা হয় অর্ধমাত্রা। একইভাবে বন এ ব একমাত্রা আর ন অর্ধমাত্রা।


পর্ব জিনিসটা ও হিন্দি সিরিয়াল এর পর্ব না। ভোর হল দোর খোলো খুকুমণি ওঠোরে লাইনে আমরা ভোর হল কিংবা দোর খোলো একবারে উচ্চারণ করি। এই একবারে উচ্চারিত অংশই পর্ব। খুলি হাল তুলি পাল এই তরী চলল এই লাইনে খুলি হাল, তুলি পাল, এই তরী, চলল এগুলো চারটে ভিন্ন ভিন্ন পর্ব।


এই পর্ব আর মাত্রার হিসেবের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ছন্দের প্রকারভেদ। বাংলা ভাষায় ছন্দ মূলত তিন প্রকার - মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্ত। পিচ্চিকালে আমরা ধান রচনায় অনেকেই লিখেছি, ধান মূলত তিন প্রকার - আউশ আমন ও বোরো। এছাড়া ইরি নামে নতুন এক প্রকার ধান দেখা যায়। তেমনি, ছন্দের এই তিন প্রকার ছাড়াও গদ্যছন্দ নামে নতুন এক প্রকার ছন্দ দেখা যায়। তবে তা আমাদের আলোচনা বহির্ভূত।


প্রথমেই আসি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। বাংলা ভাষায় সব থেকে বেশি কবিতা লেখা হয়েছে মাত্রাবৃত্ত ছন্দেই। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অর্ধমাত্রা কে পূর্ণমাত্রা ধরা হয়। আর সাধারণত এর এক পর্বে ছয় বা আট মাত্রা থাকে।


    মসজিদ কাল শিরনি আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি
    বাঁচিয়া গিয়াছে মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি


এখানে, মসজিদ এর মস দুই মাত্রা এবং জিদ দুই মাত্রা। আছিল এর আ একমাত্রা, ছি একমাত্রা ও ল একমাত্রা। আবার, এখানে মসজিদ কাল (২+২+২) ছয় মাত্রা, শিরনি আছিল (২+১+১+১+১) ছয় মাত্রা, অঢেল গোস্ত (১+২+২+১) ছয় মাত্রার পর্ব এবং রুটি দুই মাত্রার অপূর্ণ পর্ব। সেই হিসাবে বন দুই মাত্রা ও নির্ভেজাল পাঁচ মাত্রা|


এবার আসি স্বরবৃত্ত ছন্দে। বেশিরভাগ ছড়াই এই ছন্দে লেখা। এই ছন্দে অর্ধমাত্রা কে শূণ্যমাত্রা ধরা হয়। অধিকাংশ পর্ব চার মাত্রার হয়।


    বলব আমি আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো
    হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো?


এখানে আগের বা পরের লাইনের সাথে তুলনা করলেই দেখা যায়, বলব, আলসে, হয়নি, সকাল এই শব্দ গুলোকে দুই মাত্রা ধরা হয়েছে। অর্ধমাত্রা হিসাবে আনা হয়নি। আবার এভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, হয়নি সকাল বা আলসে মেয়ে প্রভৃতি পর্ব চার মাত্রায় গঠিত। স্বরবৃত্ত ছন্দে বন একমাত্রা এবং নির্ভেজাল তিন মাত্রা।


সবশেষে অক্ষরবৃত্ত। বাংলা ভাষায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দ খুব বেশি ব্যাবহৃত না হলেও এই ছন্দের পরিধি অতি বিশাল। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অর্ধমাত্রা শব্দের মাঝে থাকলে শূন্য মাত্রা এবং শেষে থাকলে পূর্ণমাত্রা। যেমন বন দুই মাত্রা ও নির্ভেজাল চারমাত্রা। মাঝে থাকায় নির এক মাত্রা ও শেষে থাকায় জাল দুই মাত্রা।


    হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।
    সিংহল সমুদ্র থেকে নিশিথের অন্ধকারে মালয় সাগরে,
    অনেক ঘুরেছি আমি।


এখানে লাইনে পর্বে মাত্রা বিন্যাস ৮+৮+৬ বুঝে নেয়ার দায়িত্ব পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম।


এই অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ই প্রকারভেদ বহুল আলোচিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এই ছন্দের বৈশিষ্ট্য অন্তমিল না থাকা এবং লাইনের শেষে বক্তব্য শেষ না হয়ে পরের লাইন এ টেনে নেয়ার (প্রবাহমানতা) প্রবনতা।


    সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি
    বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
    অকালে...


এখানে লাইনের শেষে মিল নেই এবং বক্তব্য লাইনে শেষ না হয়ে পরের লাইনে গমন করে।


রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আরেক প্রকারভেদ মুক্তক ছন্দ। এখানে অন্তমিল থাকে কিন্তু, পর্ব বা মাত্রার বিন্যাস থাকে না।


    প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ,
    রুধিল না সমুদ্র পর্বত।


গদ্যছন্দের নামেই বোঝা যায়, এখানে অন্তমিল, পর্ব, মাত্রা কিছুই থাকে না। অনলাইনে পড়া ৯০% কবিতাই এই শ্রেণির বলে, নতুন করে আর কোন উদাহরণ দিলাম না।


অনেক ব্যাকরণবিদের মতে, মুক্তক বা গদ্যছন্দ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের শ্রেণীবিভাগ নয়, বরং একটি সতন্ত্র শ্রেণী। আমি নিজেও এই মত সমর্থন করি।


এখন চলে যাই একেবারে প্রথম বলা কবিতাটায় - 'ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠোরে।'


আমার এতক্ষণ এর আলোচনা বিন্দুমাত্র বোঝা গেলে বুঝতে পারবেন, এখানে পর্ব বিন্যাস ৪+৪+৪+৩ আর এখানে অর্ধমাত্রা কে পূর্ণ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে। তাই এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।


শেষ করি একটা চমকপ্রদ ছন্দের উদাহরণ দিয়ে। শামসুর রাহমান এর স্বাধীনতা তুমি কবিতাটা আমাদের সবার পড়া। আপনি কি জানেন এই কবিতাটায় ও ছন্দ আছে? এবং গদ্যছন্দে নয় এই কবিতা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। একটু মনে মনে আবৃতি করুন তো...


    স্বাধীনতা তুমি
    রবি ঠাকুরের | অজর কবিতা | অবিনাশী গান
    স্বাধীনতা তুমি|
    কবি নজরুল | ঝাঁকড়া চুলের | বাবরি দোলানো | মহান পুরুষ |
    সৃষ্টি সুখের | উল্লাসে কাঁপা|


দুটো | চিহ্নের মাঝের অংশ গুলোকে কি ছয় মাত্রায় ভাগ করা যায়? হ্যাঁ, যাকে এতদিন গদ্য কবিতা ভেবেছেন, সেখানেও আছে ছন্দ।


আমাদের পরিচিত আরও অজস্র কবিতায় এমন মাত্রা পাওয়া যাবে। আমার এখন নেশা হয়ে গেছে কবিতার প্রতিটি লাইন কে ছন্দ আর মাত্রায় বিশ্লেষণ। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে দেখুন। আপনিও উৎসাহী হয়ে উঠবেন। হারাবেন নাকি? কবিতার গোলকধাঁধাঁয়?
সূত্র- ইস্টিশন ব্লগ ।
http://www.istishon.com/node/5226