তাঁকে জীবনে আমি কভু ভুলবোনা । আসরের সবার  পরিচিত একটি মানুষ বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল  নক্ষত্র - যথেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী মহামান্য কবিবন্ধুবরেষু বোদরুল আলম-  সাহেব আমার প্রিয় মানুষ বেশ কয়েক মাস হলো তাঁকে আসরে দেখা যাচ্ছে না - তাঁকে আজ বেশ মনে পড়ছে । তিনি আসরের এক বলিষ্ঠ প্রতিভাশীল  কবি আমার  কবিতা গুলোর মাঝে তাঁর একটা  বিশাল বিশাল মন্তব্যে আমাকে  মুগ্ধ করতেন  আজ তাঁর এক মন্তব্য দিয়ে তাঁকে বেশ ভাবে মনে করছি - ফিরে আসুন হে  কবি আমাদের মাঝে আবার আগের মত করে-


শালিনী ভুল প্রেমের পথিক
- শিমুল শুভ্র


শালিনী'র দুরন্ত যৌবনে শৃঙ্খলিত মন,
একাকীত্বে  ফাঁকি দেয় বারে বারে,
বিধিবিধানের দাস,স্বামীর অগোচরে
মর্মরের তলে ছুটে যায় অভিসারে।


টগবগ করে সতেজ প্রেমকৃষ্ণ লাভে,
সীমাহারা আকাশের নীল শাড়ির রূপ,
দুর্গম সঙ্কট যৌবনের গঠন প্রনালী,
মেটায় মায়াবী রাঙা রঙ তুলি মাখামুখ।


তুহিন তরঙ্গে,তুঙ্গ গিরি গর্জন তোলে,
প্রেমিক সুখের নিবাসে সুক্ষ অগ্নিশ্বাস,
নাড়ি ছেড়া ধন পুত্র  কাঁদে অনাদরে,
মণিময় তোরণের দ্বারে, বিচিত্র সুবাস।


চূর্ণ করলো বিশ্বাসের মন্দির,সরলতার
সুযোগে সমুদ্রের যৌবন-গর্জনে,
স্বামীর জ্ঞানকে হীন-আখের ছোখরা
ভেবে ছুটে গেলো সন্ধ্যারাতে নির্জনে।


অসীম ঐশ্বর্যরাশি সঙ্গে নিয়ে, প্রেমিক
সনে নীল কুটিরে,বাঁধবে নতুন ঘর,
স্বপ্নে আঁকা রঙ্গিন বাসর সাজাবে
শালিনী,অচিন আকাশে,স্বামীপুত্র করেপর।


প্রেমিক দীপ্তিমাখা মনে,অগ্নিঢালা সুধা
চুষে,সুহৃদ্‌রূপে নির্ভর ছলনার বন্ধন,
ঐশ্বর্যের অংশঅপহারী শালিনী'র শিয়র
থেকে তুলে,নিজেকে নির্বাসনেমন্থন।


গূঢ় অন্ধকারে শালিনী,প্রেমিকের অনুপুস্থিতে
হৃদয়দুর্গে বদ্ধ ঘরে,অস্থির ক্ষণ,
ভাঁজ করা চিরকুটে জবাব মিললো,
নিন্দার সুর তার সর্বনাশ অট্টহাসে তখন।


প্রবঞ্চনায় সুহৃদের নিন্দাবাক্যে,শালিনী
ধিক্কারে তর্কে জড়ায় বিবেকের সনে,
মুহূর্তে চৈতন্য এলো প্রলয়তিমিরে,
মহারণ্যতলে,দুর্দিনের ঘনঘটা তার মনে।


নিজে কে ধিক্কারিলো লোকনিন্দা লোক
লজ্জা খাতিরে,নিরস্ত্র দর্পের হুহুংকার,
সজল নয়নে কাঁদে,নির্বিষ সর্পের ফনায়,
কষ্টভারজর্জরিতা আত্মহত্যায় নিথর।
----------------------------------------------------------------------------
বোদরুল আলম-                                                                       ০৭/০৫/২০১
আসরে আপনার পঞ্চাশতম নিবেদনের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আরো সফলতা আর আনন্দময়তার আলো দেখুক আপনার এই সৃজনশীল পথচলা।


'ভুল প্রেমের পথিক' এই শালিনী আমাদের খুব চেনা মুখ। একটু চোখকান খোলা রাখলেই এদের চোখে পড়ে। আমাদের বাড়ির আশে পাশেই হোক, বা ঘর থেকে বহুদূরে চেনা স্বজনের পাড়াতেই হোক কিংবা খবরের কাগজের পাতায়, এরা চোখে পড়ে। সমাজবদ্ধ ও রুচিশীল সুন্দর জীবনের মাঝেও যে সব অসুন্দর আচরণ ও পরিণতি নিয়ে আমাদের থাকতে হয়, তারই অন্যতম এই পরকীয়া প্রেম। সমাজের শালিনীরা শুধু নয়, 'শালী'(শালিনীর বিপরীত লিঙ্গ)-রাও সমানভাবে এই ভীড়ে বিরাজমান। এরকম একটি বিষয়কে শালিনীর দৃষ্টিকোন থেকে ভারি চমৎকার আর আকর্ষক শৈলীতে তুলে ধরেছেন আজকের কবিতায়। অপূর্ব।


এধরণের বাস্তব চিত্রনাট্যের উপরকরণ গুলিও মোটামুটি একই রকম হয় যেন :১) 'দুরন্ত যৌবনে' বিবাহিত এক 'শৃঙ্খলিত মন', ২) অনেকটা একাকীত্ব,৩) 'স্বামীর অগোচরে' থাকার সুযোগ, ৪)'টগবগ করে' আসা এক 'সতেজ প্রেমকৃষ্ণ', ৫) এক অবৈধ প্রেমের সূচনা, ৬) প্রেমের উত্তাল ঢেউয়ে 'তুহিন তরঙ্গে,তুঙ্গ গিরি গর্জন' করে ধীরে ধীরে 'প্রেমিক সুখের নিবাসে সুক্ষ অগ্নিশ্বাস' ৬ক) ঠিক সেই সময়েই অনাদরে ও সাময়িক একাকীত্বে 'নাড়ি ছেড়া ধন পুত্র'-র কান্না (এটা ঐচ্ছিক, যদি শালিনী কোন সন্তানের জননী হয়ে থাকে), ৭) 'সরলতার সুযোগে' প্রেমিকের উৎসাহেই বাঁধা ভাঙা 'সমুদ্রের যৌবন-গর্জনে' তারই হাত ধরে নিজ গৃহেরই 'অসীম ঐশ্বর্যরাশি' সাথে নিয়ে অবশেষে স্বামীর 'বিশ্বাসের মন্দির' চূর্ণ ক'রে 'সন্ধ্যারাতে নির্জনে' শালিনীর পলায়ন , ৮) 'প্রেমিক সনে নীল কুটিরে' ঠাঁই হয় শালিনীর, 'নতুন ঘর' সাজে যা অনেকটা 'অচিন আকাশে' সেই 'স্বপ্নে আঁকা রঙ্গিন বাসর'-এর মতই, কিন্তু তা নিতান্তই অল্প সময়ের জন্য, ৯) সুচতুর ও সুযোগসন্ধানী 'প্রেমিক দীপ্তিমাখা মনে,অগ্নিঢালা সুধা' চুষলেও তার 'সুহৃদ্‌রূপে নির্ভর ছলনার বন্ধন'-এর হদিস শালিনী পায় রাত কেটে ভোর হ'তেই যখন সেই 'ভুল' প্রেমিক ঘর থেকে অপহরণ ক'রে আনা 'ঐশ্বর্যের অংশ' তারই 'শিয়র থেকে তুলে,নিজেকে নির্বাসনে' নিয়ে চলে যায়, ১০) 'প্রেমিকের অনুপুস্থিতে (অনুপস্থিতিতে), হৃদয়দুর্গে বদ্ধ ঘরে' শালিনীর অস্থির হয়ে ওঠা, ১১)'ভাঁজ করা চিরকুটে জবাব' প্রেমিকের, ১২) শালিনীর 'বিবেকের সনে' দুশ্চিন্তার উথালপাথাল, কিংকর্তব্য বিমূঢ়তা, এবং ১৩) অবশেষে বিবেকের সজোর থাপ্পড় খেয়ে, 'লোকনিন্দা, লোকলজ্জা খাতিরে', 'সজল নয়নে', 'কষ্টভারজর্জরিতা' মনে শালিনীর 'আত্মহত্যায় নিথর' হয়ে যাওয়া।


এই অপরিহার্য উপকরণগুলো দিয়েই সাজানো আপনার কবিতার শালিনীরও পরকীয়া প্রেমের সমগ্র পর্বটি।


এ কথা ঠিক যে, পরকীয়া প্রেম সৃষ্টিকুলে নতুন কোন ব্যাধি বা অভ্যাস নয়। এর শুরু দেখতে গেলে হয়ত পৌরাণিক যুগ ছাড়িয়েও আরো পেছনে যেতে হবে। কিন্তু এর শুরু বা অতীত দেখে আমাদের আজকের দিনে বিশেষ কোন লাভও যেমন নেই, তেমনি সেই সব ঘটনাকে ইঙ্গিত করে পরকীয়া প্রেমের স্বপক্ষে আমাদের কোন যুক্তিই যথেষ্ট হবেনা। আগে কে ঠিক বা ভুল বলেছে তা নয়, আজ এই মুহূর্তে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মাত্রই একে ভুল ও অবৈধ প্রেম বলবে, আর সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর ভুল টা ভুলই। পাঁচ কে নয় দিয়ে গুণ করলে পঁয়তাল্লিশ না পেয়ে আর যে সংখ্যাই আসুক না কেন, আর তার পক্ষে যত যুক্তিই সাজাই না কেন, সেটা ভুল উত্তরই হবে। তর্কের অবকাশ না তৈরী করে, এই ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে একটু ভাবলে, সেইমত একটু চেষ্টা করলে, সমাধানের পথে নিজেকে ও অন্যকে উদ্বুদ্ধ করলে, আমার মনে হয় তাতেই বেশি মঙ্গল।


পৃথিবীতে যতদিন প্রাণের স্পন্দন থাকবে, যতদিন শ্বাস প্রশ্বাস নেবে এখানের সমস্ত প্রাণীকুল, ততদিনই হয়ত প্রেম-বিরহ-বিবাদ-ঐক্যও থাকবে। প্রেম থাকবে ঠিক ভাবেও, ভুল ভাবেও। এই ভুল প্রেম নিয়ে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এরকম : কোন প্রেমানুভূতিই ভুল নয় (ঠিক যেমন 'শালিনী'র দুরন্ত যৌবনে শৃঙ্খলিত মন'-এ বাসা বাঁধা প্রেমানুভূতিও ভুল নয়), ভুল হয় প্রেমানুভূতি প্রকাশের পথটিতে। ভুল পথ চলাতে হয়না, ভুল হয় পথের। আমাদের ঠিক পথেও তো সেই অভিন্ন পথচলাই। নিদারুণ একাকীত্বেও শালিনীর মনে যখন 'টগবগ করে' আসা কোন 'সতেজ প্রেমকৃষ্ণ' দেখে প্রেমবোধ উথলে উঠল, তখন হয়ত অধৈর্য্য বাঁধা ভাঙা ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার আগে একটু সময় নিয়ে ভাবতেই পারত।সমাজের চিন্তাকে যদি সব শেষেও রাখি, তবু সে ভাবতে পারত তার সন্তানের মুখখানির কথা (যে তারই কাছে সুন্দর ও সুসজ্জিত জীবনের পাঠ নেওয়ার প্রতীক্ষায়), ভাবতে পারত তার স্বামীর কথা (যে তাকে একাকীত্বে রেখে যাওয়ার মধ্যেই এক অটুট ভরসা, নির্ভরতা আর বিশ্বাসের চিহ্ন রেখে গেছে), ভাবতে পারত তার নিজের কথা (যে প্রেম প্রকাশের পথের ঠিক-ভুল নিয়ে মুহূর্তের জন্য হ'লেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে)। শালিনীর জীবনে তো দুটি মাত্র সমস্যা চোখে পড়ল। এক, তার 'শৃঙ্খলিত মন' আর, দুই, তার একাকীত্ব। মনের উপর শৃঙ্খলার হেতু ভিন্ন ভিন্ন হ'তে পারে। তার প্রকৃত সূত্রেই খুঁজে পাওয়া যাবে সমাধান সূত্র। এই একাকীত্ব যদি শুধুই সাময়িক হয়, আর তা যদি হয় সংসারেরর রুজি রোজগারের কারনের স্বার্থে, তাহলে তা তো কোন সমস্যাই নয়। আর যদি হয় স্বামীর নিতান্ত উদাসীনতার কারনে, তাহলে কিন্তু ঐ স্বামীর মধ্যেই তথাকথিত 'সতেজ প্রেমকৃষ্ণ'-র প্রতিমূর্তি স্থাপন ক'রে (কিভাবে সেটা অন্ততঃ যার মনে প্রেমানুভূতির জেগেছে তাকে শেখাতে হবেনা), তার সাথেই স্বকীয়া প্রেম গড়ে তুলতে পারলে আমার মনে হয় সব দিক বজায় থাকে। সেই প্রেমানুভূতি (যা ভুল নয়) অটুট থাকল, স্বামীর উদাসীনতা দূর হ'ল, পরকীয়া প্রেমের অনাগত বিষবাষ্প আসার পথ (আর সেই সাথে সম্ভাব্য বহু অনাগত আপদ) চিরতরে বন্ধ হ'ল।


যে কোন সম্পর্কেই টানাপোড়েন থাকতেই পারে। বনিবনার অভাব হ'তেই পারে। এক দিক দিয়ে দেখলে অন্যদিকে দোষের পাহাড় চোখে পড়তেই পারে। কিন্তু তার সমাধান সমস্যা থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন পরিস্থিতিতে হ'তে পারে না। সেই সমস্যার মধ্যে থেকেই, সমস্যার সাথে লড়েই আনা যেতে পারে সমাধানসূত্র। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যেও যদি সর্বাধিক অসুখ বিরাজ করে, যদি একে অন্যকে সুখী করতে না পারে, যদি হাজার চেষ্টাতেও কোন উপায় খুঁজে না পাওয়া যায়, তবু কিন্তু পরকীয়া প্রেমের মত ভুল পথ ধরা সমর্থনযোগ্য হবেনা। আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী বা এমনকি পেশাদার কাউন্সেলরদের সাহায্য নিয়েও সম্পর্কে গতিময়তা ফেরানো যায় বলেই আমার বিশ্বাস।


শালিনীর আত্মহনন প্রসঙ্গে আমি এটুকুই বলব যে, এটা হ'ল দ্বিতীয় ভুল। ভুল পথের প্রান্তরে এসে এ যেন আরেকটি ভুল। মানে ভুলের বহর বাড়ল। আমি যদি অনুধাবন করি যে ইতিমধ্যে আমি একটি ভুল করেছি, তাহলে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কখনোই আরেকটি ভুল করে হ'তে পারেনা। সুযোগসন্ধানী অসুন্দর মনের প্রেমিকটির পলায়নের পরে তার নিজ গৃহে, নিজ স্বামী-সন্তানের কাছেই ফিরে যাওয়া উচিৎ ছিল। তাদের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে আরো সুন্দর জীবনের শপথ নিতে পারত। আর আমি নিশ্চিত, একদিন যে 'লোকনিন্দা,লোকলজ্জা'-র ভয়ে নিজেকে শেষ করেছিল, সেদিন সেই লোকসমাজই ধীরে ধীরে তাকে আপন করে নিত। অপরাধ আছে। অপরাধের ক্ষমাও আছে। ঈশ্বরও তো পরম করুণাময়, ক্ষমাশীল। ঈশ্বর যদি ক্ষমা করতে পারেন, মানুষ কেন পারবেনা? আন্তরিক উপলব্ধি আর অপুনরাবৃত্তির প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার আলোয় (যখনই তা প্রকৃত ক্ষমাযোগ্য হয়ে ওঠে) যে কোন অপরাধই ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখা যায় বলে। আর অপরাধীর রূপান্তরও তো বাস্তবসম্মত এক সত্য। রামায়ণরচয়িতা আদিকবি ঋষি বাল্মীকিও তো আগে দস্যু রত্নাকরই ছিলেন।


আপনার কবিতা পড়ে কত কিছু বলে ফেলার সুযোগ পাই। আমার মন্তব্য পাঠকারী সবার কাছে অনুরোধ, এখানে প্রকাশিত আমার অনেক ব্যক্তিগত মতের সাথে আপনারা সহমত পোষণ না করলে অনুগ্রহ করে ক্ষমাসুন্দর চোখে নেবেন। কারন মানুষমাত্রই তো ভুল হ'তে পারে।


এভাবে নিরন্তর, সমাজের বিভিন্ন ছোটখাটি দিকে আলো ফেলে আমাদের চেতনাকে সুড়সুড়ি দেওয়া প্রয়াসের জন্য আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর অভিবাদন জানাই। খুব ভালো থাকবেন।