আমার কবিতার কলম থেমে যায়...
যখনই মনে পড়ে ওদের
চোখের আঙ্গিনা থেকে বাতাস, কেড়ে নেয়
কবিতা, মাটিতে লুটায়; আমি একটুও নড়ি না
ইহলৌকিক ক্লিন্ন কবিতার শব্দরা, লজ্জায় মাথা নতজানু করে,
শুভ্রসুগন্ধি জ্যোতির্আলোকে মূর্ত, রণদেবদূতগণ সম্মূখে
আমাদের কবিতা যে অতি তুচ্ছ, অপাংক্তেয় সে গরিমা থেকে,
যখন ওরা তুচ্ছ করেছিলো সবকিছু
একটি মুক্ত নীলিমার জন্য
একটি মুক্ত কবিতার জন্য
একবারই এসেছিলো সেইসব শব্দেরা, তারপর ফিরে গেছে স্বর্গে
আমার মনের বিমূর্ত রঙিন, অত্যুজ্জ্বল সুবর্ণ সৌধ সময়, অমর সেই ৭১ এ


জন্মের মাটিতে, মায়ের মতো নাড়ির টান, থাকে এতোটা,
ওদের না দেখলে, না বুঝলে, জানা হতো না, কোনোদিন আমার


লবণ সমুদ্র জেগে ওঠে সমস্ত অস্তিত্বে
যখনই ভাবি, ৭১ এর বেহেশতি সন্তানদের কথা
অন্তহীন এত কান্না, তবু হৃদয়ের ভার সরে যায় না
বেদনা অক্ষম, দুঃখ অতি ক্ষীণ
লক্ষ রাতের ইবাদতেও শোধ হবে না সে ঋণ,
আমাদের মাতৃভূমির মাটিতে মিশে থাকা
সেইসব অমরাত্মা দেবোপম মানবদের কাছে


আমার খুব ইচ্ছে করে, প্রান্ত থেকে প্রান্তে,
যেসব পুণ্য সবুজ মাটিতে, তাঁরা থেমে গিয়েছিলো চিরতরে
আমাদের মুক্ত করতে করতে, নদী-নালা, টীলা ভূমি উপত্যকা,
পাহাড় বন-জঙ্গল, দুরন্ত প্রান্তর, শহর থেকে শহর,
কি যে নৈসর্গিক সে ছুটে যাওয়া, চিত্তের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নৈবদ্যে,
দুর্দমনীয় ঐশ্বরিক পঙ্খিরাজের মতো, নিদ্রাহীন সে দৌড়-ঝাঁপ,
ক্রল-ক্লাইম্ব আর আহা! সে সাঁতার,
যে সাঁতার আর বৃষ্টি নদীজলে, দুধর্ষ আমার বিদ্রোহীগন,
প্রাণবায়ুওষ্ঠাগত করেছিলো পাকি চামারদের


মাতৃভূমির প্রান্ত থেকে প্রান্তে, বেহেশতি পাঁপড়িতে
তারা মুছে দিয়েছিলো, শয়তানদের ঘৃণ্যপদছাপ আর কালিমা
প্রতিটি স্তব্ধতার পুণ্য মাটিতে গিয়ে, ইচ্ছে করে হাত বুলিয়ে
দেই, তাদের মাথায়, চুমু খাই কৃতজ্ঞ অশ্রুজলে,
আমার বাবাদের, ভাইদের কপালে,


ওরা কারা ছিলো? কি দিয়ে তৈরী তাদের হৃদয়?
কে তৈরী করে রেখে দিয়েছিলেন, ঘন সবুজের এই প্রান্তরে
যেন ঈশানে যখন আসবে অশনি, প্রতিরোধ করবে নির্ভয়ে
একটি রক্তিম কবিতার মতো ছুটে গিয়েছিলো
ভালোবেসে লাল সূর্য আর সবুজ জমিন
হাসিমাখা মুখে রক্তকে করেছিলো স্পর্শমণি, সাহসের সুধা,
মৃত্যুকে দিয়েছিলো প্রেমিকের ভেজা চুম্বন
আমি এখনো দেখি তারা হাসছে,
আমাদের মুক্ত নীলিমায়, সে মুখে স্বর্গের বিভা


আমি আজও অট্টহাস্যে, চমকিত করে চারদিক, কাঁপাই আকাশ
যখনই মনে পড়ে, আমার বেহেশতি গেরিলাদের আতঙ্কে
সামান্যতম তেতুল পাতার সরসরানিতে
হানাদার মচুয়ারা ভিজিয়ে ফেলতো পরিধান, শিশুতুল্য ভয়ে
এক সুসজ্জিত সমর বাহিনীর, কি যে করুণতম অসম্মান
আমাদের মাতৃভূমির, বৃষ্টি জল মাটি কাদায়, লুঙ্গি প্যান্ট গেঞ্জি পরিহিত
বেহেশতি গেরিলাদের অসম সাহসিকতায়, আহ! হৃদয় বড় হয়ে যায়


কোথায় ছিলো তারা? আমাদের উদাসীন দৃষ্টির সীমানায়,
ফসলের সবুজে, ধানক্ষেতে ধ্যানমগ্ন কৃষক, তাঁতি, জেলে, কামার,
মজুর, শ্রমিক, গ্রামের ঘোমটা না তোলা মা, বধূ, কন্যা আর ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারা বাংলা মায়ের ছাত্ররা, একসাথে দাড়িয়ে
দেখেছিলো ডাক, ২৬ এ মার্চের প্রথম প্রহরে, সমগ্র নীলিমা জুড়ে,
এক অরুণ কোমল আলোর আবীর, ঝলমল করছে, সেটাই ছিলো বেহেশতি সন্তানদের জন্য ইশারা,
মাতৃভূমির মুক্তির জন্য, আত্মবলিদানে আকাঙ্খায় সদাদীপ্ত, সেই মুহূর্তটি যেনো, এমনই ছিলো স্বর্গীয়


কে বলেছিলো তাদের? এই সত্য জানি আমরা দেশপ্রেমী সকলে,
বেহেশতি এক তর্জনী, বপন করেছিলো তাদের অরুণ হৃদয়ে,
সুপ্ত সে বিশ্বাস, দেখিয়েছিলো মুক্ত সবুজ আর মুক্ত নীলিমা, আর
সত্যবদ্ধ সে চেতনা, মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছাড়া, মাথা উচু করে বাঁচা যায় না


আমি দেখতে পাই তারা যাচ্ছে
মায়ের বুক ভেঙ্গে, বাবার অশ্রু মুছে
বোনের বিনুনিতে আদর রেখে, ছোটো ভাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে
যাচ্ছে তাঁরা, যাচ্ছে যাচ্ছে যাচ্ছে তাঁরা
ফিরে আসবে তাঁরা বাংলার মুক্ত জমিন নিয়ে
আহা! অনেকেই ফিরলো না তো, তবু তাঁরা কথা রেখেছিলো
মুক্ত মাতৃভূমি তাঁরা এনেছিলো, ঐ দেখো তাঁরা এখনো হাসছে
তাঁরা তাঁদের কথা রেখেছিলো যে, তোমার আমার বাংলা মায়ের কাছে


নখ উপড়ে ফেলেছিলো, দাঁত মুখ থেতলে দিয়েছিলো
আস্ত রাখেনি শরীরের দশ আঙ্গুল
পাজরের হাড় একটিও রাখেনি অবশিষ্ট
তারপর বলেনি সাথীদের পরিচয়, অবস্থান
জ্ঞান হারাতে হারাতে, অথবা মৃত্যুর কোলে যেতে যেতে
রক্ত মাখা থুথু ছুঁড়েছিলো
ইসলাম লেবাসধারী, জানোয়ার কাফেরের মচুয়া মুখে


কি করে পেরেছিলো তাঁরা?
আমি কি পারতাম? তুমি?
সবাই তো পারেনি সে সময়!
বেহেশতি উপাদান ছাড়া এ হয় না, হতে পারে না
তাদের সৃষ্টি করা হয়েছিলো
নিশ্চয়ই অলৌকিক ঐশ্বরিক কোনো আলোতে
স্রষ্টার সোনার ছেলেরা, ছিলো সেদিন আমাদের
এই সবুজে মিশে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে


আমি জানি, এক বেহেশতি মায়ের কথা,
বাকী জীবন মাটিতে ঘুমিয়েছিলেন,
ভাত স্পর্শ করেননি এক কণা, ফুলটি যে তাঁর সেভাবেই,
ভেসে উঠে গেলো উপর আসমানের, বেহেশতি বাগানে
আরেক এমনি মা, তাঁর মুক্তির রথীপুষ্পটিকে বলেছিলেন,
সহ্য করিস বাবা!, তবুও সাথীদের কথা কখনোই বলবি না,
ওরা মেরে ফেললেও না; আমরা কি দেখেছি কখনো এমন মা!?
শিহরণ, কান্না, কৃতজ্ঞতায়, আবেগে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার


আমি লক্ষ কবিতা লিখে যাবো, কোটি নক্ষত্র শব্দ সমাহারে
কিন্তু কখনো লিখতে পারবো না, সে কবিতা!
এবং তুমিও পারবে না হে কবি, শত কাব্যকাঠামোতেও


যে কবিতায় আমরা জানাতে পারি, পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতা
আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধের সোনার ছেলেদের।


বেঈমান ছাড়া, সকল দেশপ্রেমীর বুকে, অবিরত ঝরাবে পুষ্পাশ্রু,
অমর আত্মাদের দেয়া মুক্ত মাতৃভূমির বেহেশতি দক্ষিণা।


(১০.০৫.২০২০)