পড়ো, কবিতার তরুণ প্রজন্ম, যারা ভুল লিখছো:


"আমি লিখি - তুমি লেখো - সে লেখে
আমি চাই - তুমি চাও - সে চায়
আমি যাই - তুমি যাও - সে যায়
আমি নই - তুমি নও - সে নয়"


উপরোক্ত সব হচ্ছে শুদ্ধরূপ।


অথচ কবিতা আসরে এসে, অনেকের লেখাতে, বিশেষ করে তরুণদের লেখাতে, ব্যাকরণের এই বিভ্রাট দেখে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম । নির্দিষ্ট এই ক্রিয়া পদের রূপ কি পাল্টে গেল? তারা লিখছে:


আমি যায় - তুমি যায় - সে যাই !! - ভুল।
আমি চায় - তুমি চায় - সে চাই !! - ভুল ।


শঙ্কিত হয়ে পড়লাম, ব্যাকরণের কিম্ভূত রূপটি কি স্থায়িত্ব পেয়ে যাবে, যা কখনই কাম্য হতে পারে না । কবিতা আসরের প্রথম দিন থেকে আজ অবধি, ভুলটি চোখে পড়ছে, আর আমি বুঝিয়েই যাচ্ছি। কোথা থেকে এই আজব চর্চার শুরু হলো? এ ভুলটি হবার কথাই না। পরে অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম, জুকারবার্গ সাহেবের "ফেসবুক" হলো বাঙালি এবং বাঙালি ফেসবুক কবিদের এই ভুলভাবে লেখার সূতিকাগার । ফেসবুক ব্যাপারটি এমনই হুল্লোড়, কেউ অথবা কোনো দল কিছু শুরু করলে, ভুল না সঠিক যাচাই না করেই, বিকট লম্ফ মেরে সে লাইনে সবাই সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, ক্রিয়া পদের এই অশুদ্ধতা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে গেছে, কেননা ফেসবুকের প্রজন্ম মনে করছে, এটা লেখার একটি মর্ডান স্টাইল।


"সে কী হই তোমার?" "মেয়েটি ভার্সিটি যাই" "আমি যায় না।" - এ ধারার ধ্বনিগত রূপ কিভাবে একজনের কানে সঠিক অনুভবে বেজে ওঠে? আমার মনে হয়, কথা বলার সময় এই ভুলটি হচ্ছে না, ভুল চর্চাটি হচ্ছে শুধু লেখার বেলায়। আমাদের বাংলা ভাষাকে নষ্ট করে ফেলার যে কোনো চর্চা, বিশ্রী দূষণ কখনোই প্রার্থিত নয়।


বাংলা শব্দের শেষে 'ই' 'ও' এবং 'য়'-এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে, তরুণ প্রজন্ম এবং অন্যরাও যারা ভুল করে চলেছেন কবিতায়, তাদের জানার জন্য অনুরোধ করছি:


এটা বুঝতে হলে প্রথমে বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী, বিশেষ্য, সর্বনাম এবং ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে, যে তিন প্রকার "পুরুষ" আছে, সে সম্পর্কে জানতে হবে।


(ক) উত্তম পুরুষ - (1st person) - আমি, আমরা, আমাদের - বক্তা নিজে উত্তম পুরুষ , অর্থাত্‍ যিনি কথাটা বলছেন । উত্তম পুরুষের সর্বনাম পদ হচ্ছে, আমি, আমরা, আমাদের ইত্যাদি ।


(খ) মধ্যম পুরুষ - (2nd person) - তুমি, তোমরা, তোমাদের - যিনি কথা শুনছেন, অর্থাত্‍ যাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হচ্ছে । মধ্যম পুরুষের ক্ষেত্রে সর্বনাম পদ হলো, তুমি, তোমরা, তোমাদের ইত্যাদি ।


(গ) নামপুরুষ - (3rd person) - সে, তারা বা কোনো ব্যক্তি রহিম, করিম - এক্ষেত্রে বক্তা অনুপস্থিত কারো উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন। সেক্ষেত্রে শ্রোতা বক্তার সামনে উপস্থিত নেই। এখানে সর্বনাম পদ হলো , সে, তিনি, তারা ইত্যাদি । এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বস্তুবাচক বা অনুভূতিবাচক সর্বনাম কবিতার ক্ষেত্রে হতে পারে।  ("এ সংগ্রাম চায় আমাদের রক্ত", "বাংলাদেশ চায় তার নাগরিকদের স্বাধীনতা" "কবিতার বইটি চায় তাকে পড়ুক সবাই" "শ্রমে সব অর্জন করা যায়"। "বসে বসে ডাক পিয়ন মাগনা হাওয়া খায়" - অথচ এক তরুণ কবি লিখেছে, ডাক পিয়ন মাগনা হাওয়া খাই!)


বাংলা শব্দের শেষে “ই” "ও" এবং “য়” র ব্যবহার উপরোক্ত পুরুষ অনুযায়ী হয় । বাংলা ভাষায় ক্রিয়া পদ ব্যবহার নিচের নিয়ম অনুসারে করতে হবে :


উত্তম পুরুষ : ক্রিয়া পদ = ধাতু + ই, যেমন : আমি ভাত খাই। আমরা ভাত খাই। আমি যাই। আমরা যাই। আমি চাই। আমরা চাই। অর্থাৎ উত্তম পুরুষের ক্ষেত্রে “ই” ব্যবহৃত হয় ।


মধ্যম পুরুষ : ক্রিয়া পদ = ধাতু +ও, যেমন : তুমি ভাত খাও। তোমরা ভাত খাও। তুমি যাও। তোমরা যাও। তুমি চাও। তোমরা চাও। অর্থাৎ মধ্যম পুরুষের ক্ষেত্রে "ও" ব্যবহৃত হয়।


নাম পুরুষ : ক্রিয়া পদ = ধাতু +য়, যেমন : সে ভাত খায়। তারা ভাত খায়। রহিম ভাত খায়। সে যায়। তারা যায়। করিম যায়। সে চায়। তারা চায়। আলম চায়। অর্থাৎ নাম পুরুষের ক্ষেত্রে “য়” ব্যবহৃত হয় ।


এটুকু পড়ার পরে, ধারণা কিছু পরিষ্কার হয়েছে বলে ধরে নিতে পারি।


এছাড়াও, পালিয়ে যাই কে লিখছে "পালাই যাই", কোথায় কে কোথাই, উপায় কে উপাই ইত্যাদি  - সব ফেসবুক সংক্রমণের কারণে। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, মোবাইল টাইপিং অ্যাপে, "চায়" "যায়" "খায়" লিখতে চাইলে অটো সাজেশন চলে আসে "চাই, যাই, খাই"। এটাও তরুণদের বিভ্রান্ত করে বলে বোঝা যাচ্ছে ।


"আমি কবিতা লিখি - আমি ছড়া বানাই
তুমি কবিতা লেখো - তুমি ছড়া বানাও
সে কবিতা লেখে - সে ছড়া বানায় ।"


আশা করি, কবিতা আসর ও ফেসবুকের তরুণ কবিতা প্রজন্ম বুঝতে পেরেছো। ফেসবুকের এই অসাধু সংক্রমণ থেকে মুক্তির জন্য থাকলো শুভ কামনা । শুদ্ধ ব্যাকরণ কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । না হলে নষ্ট হবে কবিতার সৌন্দর্য ।


(18.11.2021)