আমার এই আলোচনাটি, বাংলাদেশের একজন চির উজ্জ্বল খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদ এর কবি পরিচিতি বিষয়শ্রেণীভুক্ত নয়, যথার্থ কারণেই। শুধুমাত্র তাঁর একটি অনন্য কবিতা নিয়ে আলোচনা অর্থাৎ "কবিতা পরিচিতি" ।


আসুন প্রথমে পাঠ করি ।


তারিকের অভিলাষ
    - আল মাহমুদ


একবার পাখিদের ভাষাটা যদি
শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর ।
জানতাম পাতাদের আড়ালে তারা
খড় দিয়ে কেন গড়ে ঘর সুন্দর;
কোন্ সুখে আকাশের নীল অঙ্গন
ভেঙে দেয় পাখিদের প্রাণ-সঙ্গীত
পাই যদি পাখালির প্রান্তিক মন
ছুঁই তবে আকাশের নীল অন্তর-


একবার পাখিদের ভাষাটা যদি
শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর ।


দেখবো তুফান আর ঝড় বৃষ্টি
কেবলি মেলবো পাখা দূর শূন্যে
আমার শহর ছেড়ে উড়বাে একা
পাখির মেজাজ যদি পাই পূণ্যে ।
মাঠে ঘাটে পড়ে থাকে যেই খাদ্য
ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলবো আমি
পাখিদের বাধা দেয় কার সাধ্য
এ-ভাবে কাটাতে চাই আমার প্রহর--


একবার পাখিদের ভাষাটা যদি
শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর ।


২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়, "বাংলাদেশে কাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে?" উত্তরে কবি নীরেন্দ্রনাথ বলেন, "আল মাহমুদ। অসম্ভব ভালো কবি তিনি। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার মত মেলে না। তাতে কী, ‘একবার পাখিদের ভাষাটা যদি শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর’ এ রকম চরণ যিনি লিখতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই অত্যন্ত মূল্যবান কবি।" কবি আল মাহমুদ, কী কারণে কবি নীরেন্দ্রনাথ এর পছন্দের কবি বাংলাদেশের কবিদের মাঝে, তা বোঝাতে গিয়ে উল্লেখ করলেন এই কবিতার প্রধান পঙক্তিদ্বয়।


কবিতাটির রচনাকাল ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সালের কোনো সময়ে, প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালের জুন মাসে "পাখির কাছে ফুলের কাছে" নামের কাব্যগ্রন্থে। মহা ছান্দসিক কবি আল মাহমুদ, যিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলে গিয়েছেন, ‘যে কবি ছন্দ জানে না, সে কিছুই জানে না’ (‘ইনকিলাব সাহিত্য’, ৩ অক্টোবর ১৯৯৭), তাঁর কবিতায় যে থাকবে সুচারু ছন্দ-তাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারিকের অভিলাষ কবিতাটিতেও অপূর্ব ছন্দ উপস্থিত। যতদূর বোঝা যায়, কবি কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লিখেছেন, তবে বাক্যগুলোর কোনটিতে অপূর্ণ পর্ব ১ এবং কোনটিতে অপূর্ণ পর্ব ২ বলে প্রতীয়মান হয়। মূল পর্ব ৪ এবং আছে সুদক্ষ পর্ব খন্ডনের সৌন্দর্য, যা মোটেই পাঠ বিড়ম্বনা ঘটায় না। আমার ছন্দ বিশ্লেষনটি সঠিক হলো কিনা, তা আমাদের শ্রদ্ধেয় ছান্দসিক কবি কবীর হুমায়ূন অথবা প্রিয় ছান্দসিক কবি মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান আরো নির্ভরযোগ্য এবং নিঁখুত ভাবে বলতে পারবেন।


কবিতার শিরোনাম "তারিকের অভিলাষ" । অভিলাষ অর্থ সকলেই জানি,  ইচ্ছা, বাসনা, স্পৃহা । তবে "তারিক" শব্দের অর্থ, রাতের দর্শনাথী, তারা, নক্ষত্র, বা বাংলা একাডেমী অভিধান অনুসারে "নৌকার মাশুল আদায়কারী ব্যক্তি"। সুতরাং কবি আল মাহমুদ কী অর্থে তারিক শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা অজানা। হয়তো কবির পরিবারের কোনো সদস্যের নাম, যে পাখি ভালোবাসে, পাখির মতো হতে চায়, তার আকাঙ্খা থেকেই কবি কবিতাটি লেখার প্রেরণা পেয়েছেন, তাই এই শিরোনাম, সেটাও ভেবে নিতে পারি আমরা পাঠকেরা।


শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবি কবীর হুমায়ূন একবার আমার একটি কবিতায় মন্তব্যের মাঝে লিখেছিলেন, "মানুষেরা পাখির মতো বাঁচতে চায়" । সেই পাখির মতো বাঁচার, পাখির মতো ইচ্ছে সুখে উড়াল স্বাধীনতার সে হাহাকার, সে অভিলাষ ফুটে ওঠে আমাদের বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের কলমে । কবিতাটির মোলায়েম সুমধুর শব্দ বাক্য, রূপকল্প, শিল্পিত সুন্দর আর্তি মন হৃদয় আলোড়িত করে দেয় । "পাতাদের আড়ালে" "ঘর সুন্দর" "নীল অঙ্গন" "প্রাণ-সঙ্গীত" "আকাশের নীল অন্তর" ইত্যাদির দ্যোতনা অনবদ্য।


তবে পাখির মতো হবার জন্য আর্তি, অভিলাষ শুধু কবি মনের মাঝেই জাগ্রত হয় না, বাউল বা রোমান্টিক মানুষের মনেই উদিত হয় না, বৈজ্ঞানিকদের মাঝেও জন্মলাভ করেছিল সেই প্রবল তাড়না। স্রষ্টা দেননি মানবকে দুটি পাখা, ওড়ার ক্ষমতা, কিন্তু তাতে কী, মানুষের মাঝে বিজ্ঞানীরাই বাস্তব করে তুলেছেন যুগে যুগে অসম্ভব সব কল্পনা বিলাস। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ মুগ্ধতা আর ঈর্ষায় তাকিয়ে থেকেছে পাখিদের দিকে, লালন করেছে মনে মনে উড়বার ইচ্ছা। বিজ্ঞান চর্চার মধ্যযুগে লিওনার্দ দা ভিঞ্চি বানিয়েছিলেন "flapping wings" "ornithopter flying machine" যা অকার্যকর হয়েছিল। সেই সময়ে চীন দেশে তৈরী হয়েছিল "toy flying machines zhuqingting"। পাখিদের নিরীক্ষণে, বিশ্লেষণে মানুষ থেমে থাকেনি, তাই কিছু দূর-পরবর্তী আধুনিক যুগে এসে আমরা পেয়ে গেলাম নানা ধরণের উড়বার যন্ত্র বা যান, জেটপ্যাক, হট এয়ার বেলুন, প্যারাশুট, গ্লাইডার এবং যার প্রধানতম হচ্ছে এরোপ্লেন। আর তাতেই, অন্যরূপে, বিকল্প মাধ্যমে হলেও মানুষের হয়েছে পাখির মতো উড়বার ইচ্ছে পূরণ।  


কবিতায় আসি । অবশ্যই উল্লেখ্য সর্বাগ্রে, কবিতার প্রথম দুটি পঙক্তিই মূখ্য।


একবার পাখিদের ভাষাটা যদি
শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর ।


সহজেই কেড়ে নেয় পাঠক মন। নবী সোলেমান পশু-পাখিদের ভাষা বুঝতেন। সুতরাং সেই ভাষাটি জানবার আকাঙ্খা যেন তাঁর কাছেই পেশ করা যায়, যৌক্তিকতায়। এবং এখানেই সৃষ্টি হয় ব্যঞ্জনা, কাব্যিকতা। ধরুন, কোনো পাখিদের অরণ্যে হাঁটছেন, চারিদিকে পাখিদের কলতান, পাখিদের ওড়াওড়ি, গাছে গাছে পাখিদের নীড়, বিভোর মুগ্ধ তন্ময় হয়ে শুনছেন, দেখছেন আপনি, কবিতাটি জানা থাকলে, অজান্তেই পঙক্তি দুটো আপনি উচ্চারণ করবেন যথার্থ আবেগেই। সেরকমই ঐশ্বর্যময় দুটো পঙক্তি, যা অন্যদিকে যেন  দুই পঙক্তিরই এক সম্পূর্ণ কবিতা অনুভূত হতে পারে, এর অসাধারণ কাব্যিক দ্যোতনার কারণে।


এরপর পড়ি আরো দুটো সুন্দর চরণ ।


জানতাম পাতাদের আড়ালে তারা
খড় দিয়ে কেন গড়ে ঘর সুন্দর;


"কেন গড়ে", সে রহস্য না হয় মহান স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের মাঝেই লুকায়িত থাক। তবে ঘর যে গড়ে সুন্দর, তা অনস্বীকার্য । সৃষ্ট জীবের মাঝে মহান মানুষের মতো দুটো হাত নেই, বুদ্ধি নেই অথচ শুধু চঞ্চু আর নখরওলা দুটো পা দিয়ে যে স্থাপত্যকলা পাখিরা প্রদর্শন করে তাদের নীড় নির্মাণে তা আশ্চর্যকর। বাংলাদেশে যে পাখিটি স্থাপত্যকলায় সুবিদিত সেই পাখির নাম আমরা সকলেই জানি। বাবুই পাখি। তাতিদের মতো নিঁখুত বুনন শিল্পী । পৃথিবী জুড়ে বহু পাখির নীড় নির্মাণ শৈলী বিস্ময়কর। তাই কবি আল মাহমুদ উচ্চারণ করেন এই দুটো পঙক্তি।  


এরপর দৃষ্টি দেবো নিচের পঙক্তিটির মাঝে একটি বিশেষণ শব্দে।


"পাই যদি পাখালির প্রান্তিক মন"


কবি পাখিদের মনকে "প্রান্তিক" বলছেন। অর্থাৎ তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরম, চূড়ান্ত, মৌলিক, দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন। তারা কারো একান্ত নয়। পাখিরা সবার। প্রান্তিক মানুষের মতো সহজ সরল, নিরহঙ্কার। খাঁচার মধ্যে বন্দীত্বের কৌলিন্য পাখির জন্য না। পাখিদের বর্ণিল সৌন্দর্য মুক্ত অরণ্য আর আকাশে, মানুষের উপভোগের জন্য। পাখিরা পৃথিবীর মানুষের উপকারের জন্য। তাই বাক্যটিতে প্রান্তিক শব্দ প্রয়োগ পাঠক মনকে ভাবায়, আলোড়িত করে।


অবশেষে এই অনন্য কবিতার শেষ প্রণিধানযোগ্য পঙক্তিটি পড়ি,  


"পাখিদের বাধা দেয় কার সাধ্য"


পাখিরা বাধাহীন। পাখিরা স্বাধীন । উন্মুুক্ত আকাশ তার বিচরণ ক্ষেত্র। পাহাড়ে, শহরে, গ্রামে, অরণ্য থেকে অরণ্যে মুক্ত বসবাসের নিবিড় সুখ। যেখানে সেখানে খাদ্য খুঁজে নেবার আনন্দ, কাউকে পরোয়া না করে। এবং তাদের আছে উড়ে পালিয়ে যাবার ক্ষমতা শিকারীর লোলুপতা, হিংস্রতা থেকে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই শিকারীদের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর। আর অন্যদিকে, মানুষের যদি পাখির মতো উড়ে পালাবার ক্ষমতা থাকতো, তবে মানুষও যুদ্ধ, দুর্যোগ বা তার হত্যাকারীদের ফাঁকি দিয়ে উর্ধ্ব আকাশে উঠে গিয়ে জীবন বাঁচাতে পারতো সহজে, উড়ে গিয়ে লুকোতে পারতো অরণ্য পাহাড়ের গভীরে গহীনে, নিরাপদ স্থানে। তাই কবির যথার্থ উপলব্ধি "পাখিদের বাধা দেয় কার সাধ্য"।


কবি আল মাহমুদ এর এই অসাধারণ কবিতাটি নিয়ে আর কিছু বলার নেই। আশা করি, যারা কবিতাটির সাথে পরিচিত নন, তারা পড়তে পেরে প্রীত হবেন। অতএব আসুন আরো একবার কবিতার অনন্য এবং মূখ্য পঙক্তিদ্বয় পাঠ করি, কাব্যিকতার অনুরণনে মুগ্ধ হই ।


একবার পাখিদের ভাষাটা যদি
শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর ।


ধন্যবাদ ।


(০৮.০১.২০২৩)