কবি শরীফ নবাব হোসেন। আমাদের বাংলা কবিতা.কম এর একজন শ্রদ্ধেয় কবি। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আমাদের কবি, একজন সর্বঅর্থে পরিপূর্ণ ধার্মিক মানুষ। বিবেকবান এবং অত্যন্ত মানবতাবাদী এক চমৎকার চরিত্রের মানুষ। আমাদের এই কাব্য সুললিত প্রান্তরে, তার কবিতাগুলোর দিকে যদি তাকাই, আমরা দেখবো, সর্বাগ্রে মহান আল্লাহ তা'আলার গুনগান এবং তারপরই প্রকৃতি, মানবতা, জীবন মুখী ভাবনা ও সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা বিষয়ক সম্বলিত কবিতাসমুহ। মহান আল্লাহ কে নিয়ে কবির সব কবিতায়, আমরা দেখি আল্লাহ'র প্রতি তার প্রগাঢ় অন্তহীন নতশির আনুগত্য, আল্লাহ'র প্রতি তার গভীর কৃতজ্ঞতা, মানবকুলের সৃষ্টির জন্য, মানবের জীবন দানের জন্য। তার এসব কবিতায় কোথাও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিন্দুমাত্র দাগ লেগে নেই। পুরোপুরি বিনম্র, নিমগ্ন তিনি তার নিজের স্রষ্টার বন্দনায়। অন্য ধর্মের যে কোনাে মানুষ, কবির কবিতা পড়লে, বিন্দুমাত্র বিমুখ হবে না ধর্মীয় কবিতার আস্বাদ গ্রহন করা থেকে, কারণ তাতে লেগে নেই নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কোন অহংকার, আর এভাবেই তার কবিতা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। আমি বাংলা কবিতা.কম এ আসার কিছুদিন পরই, এই অসম্ভব সুন্দর মনের কবির কবিতা পড়ে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি, ধর্মীয় কবিতা হয়েও, তার কবিতার সর্বজনীনতা দেখে। এতোটাই শ্রদ্ধা তিনি আমার কাছে থেকে আদায় করে নেন, তার নিভৃত মনের ধর্মীয় কাব্য চর্চা দেখে, আমি তাকে আমার একটি কবিতায়, যেন আমার অজান্তেই, একজন সমাজের পবিত্রতা রক্ষাকারী হিসাব আখ্যায়িত করে ফেলি অতি মুগ্ধতায়।


আমাদের এই ধর্ম অন্তপ্রাণ কবি, সেদিন আমাদের চমকে দিলেন, এক অপূর্ব মানবতাবাদী কবিতা লিখে। বিষয় ভাবনা এবং তার বক্তব্যটি এতো মনোমুগ্ধকর, এতো প্রাসঙ্গিক, যখন আমাদের এই আধুনিক পৃথিবী, একীভূত প্রগতিশীল মানবতার ছায়াতল পরিহার করে, ধর্মীয় বিদ্বেষপূর্ণ এক নষ্ট অহংকারের হুংকারে ছেয়ে আছে - আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ, তোমারটা নয়, এই ঘৃণ্য মতবাদে। কিন্তু আমাদের কবি জানেন, তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ, তিনি তার হৃদয়ের অন্তস্থলে একটি রাঙা সুগন্ধি গোলাপের মতো রেখে দেন, তার নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব, তবুও অন্য ধর্মকে আঘাত করে বলেন না, তুমি ঠিক নও। আমাদের কবি অনুভব করেছেন, পুরো নিবিষ্ট চিত্ত দিয়ে মহান আল্লাহ তা'লার সৃষ্টি রহস্য, তাঁর ইচ্ছাতেই এই পৃথিবীতে আজ বাস করে বিচিত্র ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা এবং প্রতিটি ধর্মের পারষ্পরিক সহানুভুতি ও সম্মানে বিশ্বাস কবির অতি দৃঢ়।


আমি তার এই অপূর্ব কবিতাটির পুরোটাই নিচে দিচ্ছিঃ কবিতার নামঃ মানবতার ডাক - শরীফ নবাব হোসেন, প্রকাশের সময়: ১২/০৬/২০২০, ০৯:৩০ মিঃ


আকাশে উড়ো, সাগরে ভাসো
মর্ত্যে বাস করো, গ্রহে চাষ করো
আধুুনিকতার চরম উৎকর্ষ তার গন্ধ গায়ে মাখো
অতি উন্নত প্রযুক্তিতে বিশ্ব ছাঁকাে
গ্রহ, নক্ষত্র, চাঁদে করো বিচরণ
উন্মুক্ত নীল আকাশে সদা ভ্রমন
ধরিত্রীর সীমানায় তোমার যতই নিয়ন্ত্রণ
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সীমাহীন উন্নয়ন
সবই বিফল, সবই গভীর শূন্যতায় নিষ্ফল
যদি তাতে মানবতার ধ্যান ও চর্চা, কক্ষনো না হয় আসল।


ধর্ম মানো আর না মানো
গণতন্ত্র জানো আর না জানো
ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র যা-ই মগজে ধারণ করো
আস্তিক হও বা নাস্তিক হও
জ্ঞান চর্চায় পন্ডিত, বুদ্ধিমান বা কম জ্ঞানী যেটা হও
অসীম ক্ষমতাধর, সীমিত ক্ষমতা, ক্ষমতাহীন
রাজা-বাদশাহ, নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী
যদি মানবের কাজে না আসে তারা সব আগাছা, পরজীবী
গণ-পুঁজি-সমাজ-সাম্য-সেকুলার-ধর্মবাদ সব অসার, ডাস্টবিনের ময়লা
অপাঙ্ক্তেয়, যদি না থাকে তাতে মানুষের জন্য মানবতাবাদ।


ধরাতলের সবকিছুর মূলে থাকবে মানবধর্ম
যা করা হবে সব মানুষের তাগিদে কর্ম
মহীর যত সব সৃষ্টি, হবে তা মানব কল্যাণে
হবে সে সব অবাঞ্ছিত, বর্জিত, যা ঘটে মানব অকল্যাণে
মানবের অন্তর্নিহিত সেবায় ধরাধামের প্রথম কাজ
তা লঙ্ঘিত ও পদদলিত হচ্ছে বারে বারে আজ
তাই বসুমতির শান্তি, কালের চাকায় পিষ্ট, ব্যহত
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের হৃদয় দেশে দেশে ক্ষত-বিক্ষত আহত।
মনুষ্যত্ব, মানবতা সভ্যতার প্রধান উপাদান ও অংশ
যদি মানবতা সেখানে অনুপস্থিত সে সভ্যতা হবে ধ্বংস।


বসুমাতার সন্তানদের চেতনায় জাগ্রত থাকবে
অনন্ত শান্তি, ন্যায় ও কল্যাণের বারতা
দিকে দিকে জ্বলে উঠবে আলোর মশাল
আদমের বসবাস উপযোগী শাশ্বত মানবতা।


---------


কবির এই কবিতায় আমার মুখ্য আলোচ্য বিষয়টি, প্রগিতশীল আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে, কবিতার সুপ্রিম মানবতাবাদী বক্তব্য। লক্ষ্য করুন, ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী এই কবি, দ্বিতীয় স্তবকে, তার নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার না জানিয়ে, নিজ ধর্মের অহংকারের অন্ধত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে, অন্য ধর্মের সকল মানুষতো বটেই, এমনকি নাস্তিকদেরও গ্রহন করে নিচ্ছেন, বিশ্ব মানবতার খাতিরে। এ এক অপূর্ব ঔদার্য, যা পড়ে থমকে যেতে হয় মুগ্ধ বিস্ময়ে, যেনো আমাদের প্রিয় নবীজির আদর্শ তার বুকে গোলাপের মতো ফুটে রয়েছে। আমাদের পৃথিবীর সকল মানুষ যদি কবির কবিতার মতো সুন্দর মানবতাবাদী পবিত্র অনুভবটি ধারণ করতে পারতো, তাহলে প্রকৃত রুপেই তা স্রষ্টার নিমিত্ত শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে রুপান্তরিত হতো।  


আমার নিজের মতে, এই কাব্য অনন্য হয়েছে তার সরাসরি বক্তব্যে। রূপক, অলংকার, শক্ত শব্দের ব্যবহার করলে যেন, এ কবিতার মানবতাবাদী বক্তব্যটি সব স্তরের মানুষের কাছে সহজভাবে পৌছাতো না। কবিতার এই আঙ্গিক এবং সহজ ভাষায় প্রকাশ, একজন অল্প শিক্ষিত মানুষও পাঠ করে বুঝে নিতে পারবে এবং তার হৃদয় অন্দরে সরাসরি একটি আলোকিত ভাবনার জাগরন ঘটাবে। তাই কবিতাটি এরূপেই অনন্য।


কবির কবিতার সবগুলো পঙক্তি মানবতার জয়গানে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলছে। তাই উপরে দেয়া পুরো কবিতাটি পড়ার জন্য আবেদন রাখছি।


এখানে তার আরেকটি কবিতার কিছু চরণ উল্লেখ না করেই পারছি না। আমাদের কবি, ইসলাম ধর্মের একজন প্রকৃত মুমিনের মতোই, বিশ্ব মানবতার সৌন্দর্যমন্ডিত আসল রূপটিকেই সর্বাগ্রে ভালোবাসেন।


মানুষ হত্যা ? - শরীফ নবাব হোসেন। প্রকাশের সময়: ২২/০৪/২০২০, ০৯:৫১ মি:


"ধর্ম ও মানবতা এক ও অভিন্ন!
গোটা বিশ্বের মানুষ একি রক্তে গড়া
সব ধর্মের মানুষও একি উপাদানে গড়া"


প্রিয় শ্রদ্ধেয় কবি, আপনার প্রতি রইলো আমার সালাম, অসীম কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছা। আপনার মানবতাবাদী এই অনন্য সুন্দর কবিতা এবং আপনার অন্যান্য অপূর্ব কবিতা, বাংলা কবিতা.কম এর উদার প্রান্তর করেছে সমৃদ্ধ এবং ধর্মীয় অহংকার পরিহার করে, বিশ্ব মানবতার পথটি ধরে আমাদের যাত্রাকে করবে আরো উৎসাহিত, বেগবান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। স্রষ্টার কাছে এই প্রার্থনা রেখে, সবাইকে ধন্যবাদ।