বাংলা কবিতা ওয়েবসাইট একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সৌখিন কবিদের কবিতা প্রকাশে যে দুর্গমতা, যে কষ্ট, যে প্রতিরোধ, যে অবজ্ঞা প্রতিনিয়ত কবিদের কুরে কুরে খায়, বাংলা কবিতার অসম্ভব হৃদয়বান উদ্যোক্তা, সে প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়েছেন। উদ্যোক্তা তাঁর কবি মনটি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, কি নির্মম সব দিনযাপন অপ্রকাশিত কবিদের। সৌখিন কবিদের  কবিতা চর্চা ও কবিতা প্রকাশের আত্মতৃপ্তির একটি সুরভিত সহজসাধ্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন বাংলা কবিতার উদ্যোক্তাগণ। অশেষ অশেষ কৃতজ্ঞতা তাঁদের প্রতি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলা কবিতা ওয়েবপৃষ্ঠায় কবিতা চর্চার মাধ্যমে, সৌখিন কবিদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলা কবিতা জগতে জনপ্রিয় কবি হিসাবে পরিচিতি অর্জন করে নেবেন বা ইতিমধ্যেই অনেকেই হয়তো সে সার্থকতা অর্জন করে নিয়েছেন, অন্তত নিজস্ব পরিমন্ডলে তো অবশ্যই। কবিরা বাংলা কবিতা ওয়েবসাইটকে চিরকাল তাদের মনের গহীনতায় পরম মমতায় ধরে রাখবেন ।


“বাংলা কবিতা” প্রান্তর এক অতুলনীয় মিলনমেলা। কবিতে কবিতে পরিচয়, একে অপরের কবিতা পাঠ, মুগ্ধতা প্রকাশ, পারস্পরিক কাব্য সহমর্মিতা, ভাবের আদান প্রদান।


এবার আলোচনায় আসি।


কবি খলিলুর রহমান এক আলোচনায় জানিয়েছিলেন, প্রখ্যাত স্প্যানিশ কবি ও সাহিত্যিক Miguel de Cervantes এর উক্তি 'Modesty is a virtue not often found among poets, for almost every one of them thinks himself the greatest in the world.' – এই হলো কবিদের অহংকার। দেখুনতো বলে, কোনো কবিকে, তোমার এই শব্দটি বদলে অন্যটি দাওতো। যতই যুক্তিসঙ্গত হোক, আপনার কি মনে হয় সে শুনবে? কখনো নয়, প্রতিটি কবি তার কবিতার প্রতিটি শব্দ অমূল্য রত্নের মতো লালন করে। কবিতার শরীরে পরিবর্তন, পরিমার্জন একমাত্র তার প্রবেশাধিকার।


কিছুদিন আগে এক আলোচনার মন্তব্য বাক্সটিতে কবি মৃন্ময় কি সুন্দর করে লিখেছেন, ‍‌‌‌‌‌‌'আপনি একটু লক্ষ্য করে দেখবেন ১০ থেকে ৫০টি কবিতা পড়লে আপনার ভেতরে একটি কবিতার জন্ম হয়।' স্তব্ধবাক হয়ে পড়লাম। আরে এরকমটিতো ভাবিনি । সত্যিই তো হয়। বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি বলছি মাঝে মাঝে কোনো কবির একটি মাত্র কবিতা পাঠে অপর একটি কবির মস্তিষ্কে জন্ম নিতে পারে আরেকটি কবিতা। একজন কবির কবিতার ভাবটি তাকে এতো আলোড়িত করে, সে ভাবটি ধার করে নিয়ে সৃষ্টি করে আরেকটি কবিতা। দ্বিতীয় কবিতাটি হয়তো শব্দ, গন্ধ, বর্ণে ভিন্ন, কিন্তু তার অন্তরাত্মাটি প্রথম কবির কবিতার মতো, অন্তর্নিহিত ভাবনাটি প্রথম কবির কবিতাটির মতো। এখন যদি প্রথম কবিটি, (ধরে নিন যার পাঠ্য জনপ্রিয়তা বাংলা কবিতা ওয়েবসাইটে কম) অন্য কবিদের থেকে বিরল, পৃথক একটি বিষয়, একটি বোধ, একটি ভাবনা নিয়ে কবিতা ছাপালেন এবং কিছুকাল পরে, হয়তো পরদিনই দেখলেন অন্য এক কবি, পাঠসংখ্যায় জনপ্রিয় এক কবি, প্রথম কবির কবিতাটির মূল ভাবনাটি নিয়ে একটি কবিতা প্রকাশ করে মূহুর্মুহ প্রশংসায় প্লাবিত হচ্ছেন। তাহলে কি প্রথম কবিটি নির্জনে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন না, মনোকষ্টে ভুগবেন না? তিনি যে আড়ালেই থেকে গেলেন।


কবি বন্ধুরা, আপনারা কি অস্বীকার করতে পারবেন, যখন কবিতার একটি ভাবনা, একটি বোধ, একটি আকার বা ফর্ম তৈরী হয় কবির হৃদয়ে, সেখান থেকে কত কষ্ট, কত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করতে হয় সম্পূর্ণ প্রষ্ফুটিত একটি কবিতার শরীর?


এখানে একটু বলে রাখি, আমরা কবিরা এখানে সবাই বন্ধু, সমগোত্রীয়, কেউ যেন প্রহরীর মতো আচরণ না করি, সর্বতো যেন চেষ্টা না করি, তিনিই সর্বাগ্রে থাকবে, তিনিই আলোকিত থাকবেন কবিতায়,আলোচনায় আর মন্তব্যে। বাংলা কবিতার মাননীয় এডমিনের নিজস্ব চোখ আছে, পন্থা প্রক্রিয়া আছে, তিনিই দেখবেন সবকিছূ, দেখছেন সবকিছু, কোনো কবিরতো প্রয়োজন নেই, প্রহরী সাজবার, সে দায়িত্ব কি কোনো কবিকে দেয়া হয়েছে।


কবিদের মাঝে আরো একটি স্বভাব আছে, একটু দৃষ্টিকটু, মন্তব্য বক্সে নিজের কবিতা পেস্ট করে নিজেকে জাহির করা। তাহলে যার কবিতায় মন্তব্য করতে এসেছি তারটা ম্লান হয়ে যায় না। ’আমারটা দেখো আমিও লিখেছিলাম’ - কেনো?


কবিতে কবিতে পারস্পরিক বন্ধুতা তৈরী হয়ে গেলে, সবসময় নয়, মাঝে মাঝে একটু অন্যরকম আলাপন করা যায়, শিষ্টতা বজায় রাখলেই হলো। এটা তো কবিদের মাঝে কবিতা দিয়েই একটা যোগাযোগের মাধ্যম।


T.S. Eliot এর এ লেখাটি পড়ুন:
One of the surest tests [of the superiority or inferiority of a poet] is the way in which a poet borrows. Immature poets imitate; mature poets steal; bad poets deface what they take, and good poets make it into something better, or at least something different. The good poet welds his theft into a whole of feeling which is unique, utterly different than that from which it is torn; the bad poet throws it into something which has no cohesion. A good poet will usually borrow from authors remote in time, or alien in language, or diverse in interest.


আমার বক্তব্য শেষ করছি এভাবে: এই বাংলা কবিতা ওয়েবপ্রান্তরে কোনো একটি কবির বিরল, পৃথক একটি ভাবনা, বিষয় ধার করে যদি অপর এক কবি আরেকটি কবিতা রচনা করেন, যেখানে ঐ একি ভাব সরাসরি প্রতিফলিত (শব্দ, পংক্তি ভিন্ন হলেও), তাহলে দ্বিতীয় কবিটি তার কবিতার পাদটিকায় প্রথম কবিটির কাছে তার অনবদ্য ভাবনাটি ধার নেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবেন নিজ দায়িত্বে, নিজ বিবেকের কাছে মাথা নত করে।


কারণ অন্যরা তো আর খোঁজ পাবে না, পাওয়া সম্ভবও নয়, একমাত্র দুঃখ পাবেন সেই কবিটি যার ভাব চুরি করে লেখা হলো আরেকটি কবিতা, কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়াই। এই আমার ছোট অনুরোধ।


এ আলোচনা পড়ে একটি অবশ্যাম্ভাবী মন্তব্য আসবেই, তার উত্তর দিয়ে রাখছি। 'আপনি কিভাবে জানবেন, আরেক কবির মধ্যে একি ভাবনা জাগ্রত হয়নি?' আমার উত্তর, অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন আমার এই লেখা বাংলা কবিতা ওয়েবসাইট এর সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, এখানেই আমরা কবি বন্ধুরা চলাফেরা করছি, সময়কাল, প্রকাশকাল নির্ণয়ে প্রথম কবিটির চোখে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে তার বিরল ভাবনাটি চুরি করে নিয়ে কুড়াচ্ছেন আরেকজন করতালি।


কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কেউ দরিদ্র হয়ে যায় না, সৌখিন কবিরা তো নয়ই।

(রচনাঃ ২৩.০৪.২০২০)