বলছিলাম সত্যজিৎ এর কথা, ভক্ত হলে
পড়ে নিও; নাহয় পড়ে থাকুক রচনাটি একা;


ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা সত্যজিৎ, এক পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্ব!
সত্যি সত্যিই সাধারন উচ্চতার যে কেউ, খুব সত্য,
ঘাড় মাথা সটান উচ্চমুখী করে তাঁর মুখের দিকে তাকাতে হতো;
তাঁর ধীর গম্ভীর কন্ঠস্বরের ধ্বনিতে,
কারো কারো বুক চমকে যেতো, শ্রদ্ধা জাগাতো;


যোগ্য বাবার যোগ্য সম্ভ্রান্ত্র পুত্র;
কি শেখেনি সে, অঙ্কন, চলচ্চিত্র নির্মাণ, সংগীত, সাহিত্য,
আর সম্ভ্রম জাগানো বহুদা বিষয়ে জ্ঞান ও তত্ত্ব!
তবে তাঁর নিজের একমাত্র ছেলেটি চেষ্টা করেছে,
                কিন্তু বাবার সমতা থেকে থেকেছে দূর-অস্ত;


একটা সময়.........


ফেলুদা ! ফেলুদা! ছাড়া জীবন চলতো না;
শার্লকের ছায়া ছিলো অনেক, তবুও সত্যজিৎ এর
প্রাঞ্জল বর্ণনার ছিলো না কোনো তুলনা;
"দেশ" এ কবে আসবে নতুন ফেলুদা-রহস্য, তর আর সইতো না!
"আনন্দ" এর ছাপা ছাড়া হাতে তুলে নিতাম না;
নতুন বইটা হাতে তুলে প্রথম মুহূর্তেই,
ঠিক মধ্যখানে দু’ভাগ করে, নাক চুবিয়ে দিতাম সপাটে টান!
আহ! সে গন্ধ মদিরতা কিছুতেই ভোলা যায় না;

সত্যজিৎ এর সিধান্তটি লক্ষ্য করো, ছোটদের জন্য সাহিত্য,
বড়দের জন্য চলচ্চিত্র প্রায় ৯৫ শতাংশ; ইচ্ছে করলেই পারতেন
লিখতে বড়দের গল্প, লেখেননি! পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন দুটো
মাধ্যমে সমভাবে, এ পন্থা কখনো ছাড়েননি!


সত্যজিৎ এর একটি প্রিয় চলচ্চিত্রের নাম বলে নেই এই ফাঁকে;
সেই ইটালিয়ান চলচ্চিত্রটি
ছায়াছবি নির্মাণের অঙ্গনে টেনে নিয়ে আসে সত্যজিৎ-কে;
"ভিত্তোরিও ডি সিকার, দি বাইসেকেল থিফ"
দেখে নিও না দেখে থাকলে, অভাবের কষ্ট দেখে থমকে যাবে!


বলেছিলেন একবার, ক্ষুদেগুলোকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেয়া ছিল
ঝামেলাহীন চমৎকার; বড়গুলোই আমাকে জ্বালিয়েছে বেশ কয়েকবার;


হ্যাঁ মানি, আমরা সবাই ভালোবাসি পথের পাঁচালী, অপুর সংসার;


কিন্তু আমার প্রাণ জুড়াতো "কাঞ্চনজঙ্ঘা",
নিজের লেখা প্রথম গল্প সেলুলয়েডে আঁকা; সম্পূর্ণ সত্যজিৎ!
দার্জিলিং এর সেই আঁকা বাঁকা, উঁচুতে উঠে যাওয়া, পাহাড়ি পথ,
এখনও চোখে ভাসে তার দুর্দান্ত দৃশ্যায়ন,
এখনও মা’কে বলি, বন্ধুদের বলি, চল সত্যজিৎ এর দার্জিলিং ঘুরে আসি!


"ঘরে বাইরে"র নায়িকাটি ভালো হয়নি;
"চারুলতা" চমৎকার, কাদম্বরীর অভিমান ফুটেছিলো সঠিক অনুভবে;
সুনীলের "অরণ্যের দিনরাত্রি"!,_ সাঁওতাল বন্যতা আর লোভ,
অপরিসীম দক্ষতায়, গল্পটির অনন্যতা নিয়ে গেলেন আরেক শ্রেষ্ঠ চূড়ায়!
রঙিন "অশনি সংকেত"! দুর্ভিক্ষ, চোখ বুঝলেই দেখতে পাই;
এখনো তো আরো, এই করোনা কালে, একদম তাই;
এ ছবিতে আমাদের বাংলাদেশের মিষ্টি নায়িকা?
নিশ্চয়ই মনে আছে?, তখন তরুণী সুন্দরী ববিতা!


"জন অরণ্যে" মধ্যবিত্তের বাঁচার অক্ষম দৌড়;
বন্ধুর বোনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার কি নির্মম চিত্র;
"শতরঞ্জ কি খিলাড়ি", অমিতাভের গলায় শুরু যে কাহিনী,
বেনিয়া ইংরেজদের গিলে ফেলা ভারতবর্ষের পাইকেকের শেষ টুকরো, মর্মান্তিক!
"গণশত্রু“ হয়ে গেলেন ডাক্তার, কেননা দেখালেন যে মন্দিরের পানি দূষিত;
রূঢ় সন্দেহ ধূলিসাৎ করে, "আগন্তুক" কাঁদালেন সবাইকে বিদায় দৃশ্যে;


"মহাপুরুষে" ধর্ম-ঠকদের চতুরতা, "দেবীতে" মানুষের ধর্মান্ধতা,
"জলসাঘরে" ভ্রান্ত বনেদিয়ানা, "নায়কের" সত্তা বিক্রি করে
প্রাপ্তি সস্তা বাণিজ্যিক জনপ্রিয়তা; আর কতো বলবো,
প্রত্যেকটি কাজ অনন্য, চমৎকার! চলচ্চিত্রের এক একটি হীরক খন্ড,
                                             কোনো তুলনা নেই তার!!


পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের মহাভক্ত সত্যজিৎ,
সেই ভক্তি অমর করে রাখলেন "শাখা প্রশাখায়";
বড়দা চরিত্রটি বাখ্ বাজাতো ভিনাইল রেকর্ডে;
সেই বাখ্ এর কম্পোজিশন শুনে দেখো, মন মশগুল হবে;
আর জানোই তো, তিনি নিজেই ছিলেন আবহ সঙ্গীত স্রষ্টা;


অস্কার দেয়াটা নিয়ে আমার দুঃখ আছে!
না! না! দেয়াটা ঠিক আছে, দেয়ার সময়টা!
পক্ষপাতদুষ্ট অস্কার কমিটি,
তড়িঘড়ি করে তাদের এতদিনের অলক্ষ্যে থাকা মহা ভুলটি ঠেকাতে,
মৃত্যু শয্যায় যেন তুলে দিলো অস্কার সত্যজিৎ এর হাতে!
এ অস্কার অনেক আগেই দেয়া উচিৎ ছিলো;
অসুস্থ শয্যায়,_  অস্কার হাতে কৃতজ্ঞ সত্যজিৎ!
আমার মন কষ্টে খুব মলিন করে দিলো; আজো দুঃখ জাগে;


সত্যজিৎ, জিতেছেন শুধু নিজ নাম-গুণের সত্যতেই নয়!
করেছেন শিল্প-সাহিত্য চলচ্চিত্রের অনন্য চূড়ামণিটি জয়!
সত্যজিৎ, পৃথিবীর চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি চূড়ান্ত মাপকাঠি;


সত্যজিৎ রায়! তোমাকে সতত ভালোবাসা শ্রদ্ধায়,
জন্মশতবর্ষে অসীম শ্রদ্ধাঞ্জলি।


(০৩.০৫.২০২০)


সত্যজিৎ রায় (২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২)