দৃষ্টিকোণ। কবির কবিতার দৃষ্টিকোণ, দৃষ্টিভঙ্গি কখনো কখনো ভীষণ চমকে দেয়, মুগ্ধ করে। সাধারণ যে কোনো একটি বিষয়, যেভাবে সকলে আমরা দেখি, সব কবি নয়, কোনো কোনো কবি পৃথকতর এক চোখে তার ওপর অপূর্ব দৃষ্টিপাত ঘটান। আমাদের মনোজগত তখন খুব আলোড়িত হয়, আলোকিত হয়। আধুনিককালের বাংলা ভাষার জনপ্রিয় একজন কবি, সুবোধ সরকার, তার লেখা কবিতা "সুকান্ত, আপনাকে" পড়ে আমি যারপরনাই মুগ্ধ এবং একইসাথে খুব ব্যথিত হয়ে পড়লাম। ইচ্ছে হলো অতীতের পথ ধরে ছুটে গিয়ে কবি সুকান্ত'র রোগশয্যার পাশে দাঁড়াই। আজকের আধুনিক চিকিৎসায় তাকে সারিয়ে তুলি, তাকে উদ্ধার করে আনি সে দু:খদায়ক অকাল প্রয়াণ থেকে।


সুকান্ত, আপনাকে
             - সুবোধ সরকার


প্রবাদ আছে, ঈশ্বর যাদের ভালোবাসেন
তাঁরা খুব কম বয়সে মারা যান
আমি ঈশ্বর মানি না
আপনিও মানতেন না ।


ওইটুকু তো ছেলে আপনি, একটা থাপ্পর খেলে
উঠে দাঁড়াবার জোর ছিল না গায়ে
শীর্ণ কাঁধ, সরু কব্জি
সন্ধেবেলায় কাঁপতে কাঁপতে বেঁচে থাকা
যাদবপুরের বেডে যখন আপনি শুয়ে
তখন সারা ইউরোপ কমিউনিজমের ভূত দেখছে
আমেরিকা ভুরু কুঁচকে
কাটি দিয়ে ঘেঁটে দেখছে
কার্ল মার্কসের লেখা
তখন আপনি একটা রোগা ছেলে
কী সব ভয়ঙ্কর লেখা লিখছিলেন
ভয় করতো না ?
বেয়নেট দূরের কথা
পুলিশ আপনার কলার ধরে মড়া বেড়ালের মতো
ডাস্টবিনে ফেলে দিলে, আপনি কী করতেন ?
ঔ তো আপনার ফুসফুস, ওই তো আপনার শরীর
গোটা শরীরের মধ্যে জ্বলজ্বল করত চোখ
কী অপূর্ব দুটো চোখ
একটা চােখে শ্রাবণ
একটা চোখে কিউবার মতো রাগ ।


আমি দেখতে পাই
দুটো শীর্ণ হাত আপনি এগিয়ে দিচ্ছেন
একটা হাত 'প্রিয়তমাসু'র দিকে
একটা হাত চে গুয়েভারার পিঠে
যেন আপনি আর চে একটা সাইকেলে চেপে
বেড়িয়ে পড়েছেন, যেন সারারাত ল্যাটিন আমেরিকায়
সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলায় পৌঁছবেন
পাবলো নেরুদার বাড়ী ।


না, আপনি তখনও যাদবপুরের বেডে
আপনি কাশছেন, রক্ত পড়ছে কাশির সঙ্গে
কত আগে আপনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন
জোতদার, জমিদার, শোনরে মজুতদার
আপনি বেঁচে থাকলে কী হতো জানি না
সমস্ত মালিক আবার ফিরে আসছে
মেদিনীপুরে, বীরভূমে, বাঁকুড়ায়
মেদিনীপুরে যতটুকু জমি আছে তার চেয়ে
বেশি জমির মালিক হতে চায় কারা ?
পৃথিবীতে যতটুকু জমি আছে তার চেয়ে
বেশি জমি তো আর মানুষ পেতে পারে না ?


আপনি বেঁচে থাকলে কী লিখতেন আজ জানি না
কিন্তু যা লিখে গেছেন, যে ভাবে লিখেছেন
বেপরোয়া সেই লেখার পায়ের কাছে বসার
যোগ্যতাও আমার নেই ।
একটা বিপজ্জনক লাইন লিখেই ভয়ে মরি
বারবার কেটে, শিল্প দিয়ে ধুয়ে, জামা জুতো পরিয়ে
তবে ছাপতে দেই।


কবিদের আমরা শারীরিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখি না। কবি শব্দটি উচ্চারিত হলেই মানসপটে ভেসে ওঠে একটি নরম কোমল মিষ্টি স্বভাবের অবয়ব। বাস্তব ক্ষেত্রে তা সত্য নাও হতে পারে। তবে কবির শারীরিক গঠন যাই হোক না কেন, কবির কলমের সাহস, অন্তরের সাহস হয়ে ওঠে পৌরাণিক শক্তিশালী বীরের মতো, দুর্ধর্ষ সম্রাট যোদ্ধাদের মতো। কবি নজরুল এর তরুণ বয়সের ছবিটি দেখলে, মনে হতে পারে, কেউ যদি কবিকে অপমান করতো, তবে সৈনিক দেহের নজরুল তাকে দু'এক ঘা বসিয়ে দিতে পারতো। জেল খাটার মতো মনোবল নজরুল এর ছিল, তা প্রমাণিত। রবীন্দ্রনাথ এর তরুণ বয়সের ছবিটিও অনেকটা তাই বলে মনে হয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (যদিও কবি নন, কথা সাহিত্যিক) নিজে যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন, গার্সিয়া লোরকা ছিলেন স্পষ্টভাষী বিপ্লবী কবি, যাকে মেরে ফেলে স্পেনের স্বৈরাচার, অর্থাৎ রণাঙ্গনে, ময়দানে লড়াই করার শারীরিক গঠন তাদের ছিল। এরকম আরো উদাহরণ আছে। কিন্তু কৈশোর বা সদ্য কৈশোর উর্ত্তীর্ণ দুর্বল শরীরের সুকান্ত'র কবিতা পড়লে, যে কোনো পাঠক, যে সুকান্ত'র জীবন বৃত্তান্তের সাথে পরিচিত নয়, বলে উঠবে, কি সাংঘাতিক তেজ! তারা যদি কল্পনা করে সুকান্ত'র দেহ সৌষ্ঠব তবে একজন তেজোদীপ্ত মানুষ ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করার কথা নয়। আমরা যখন পাঠ করি, "সাবাস বাংলাদেশ! / এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় / জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।" এই তীব্র তেজের জোয়ারে আজো বাঙালিরা মহাসুখে ভাসে। অথবা, "অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।" অথবা "বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।" অথবা "হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয় এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,/পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক / গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো! / প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা- / কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, / ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ / পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি।।" - এই দুর্দান্ত ক্ষোভ, জিদ, তিরষ্কার, সাহস, প্রেরণা এর সাথে কি মেলানো যায় সুকান্ত'র রুগ্ন দেহটিকে। সেটিই বলেছেন কবি সুবোধ সরকার খুব মর্মস্পর্শী করে, সুকান্ত'র প্রতি শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে প্রকাশ করেছেন তার দুঃখ, তার ভালোবাসা সুকান্ত'র প্রতি।


সুবোধ সরকার এর কবিতার মূল ভাব সৌন্দর্যটি হলো, রুগ্ন শীর্ণ দেহের কবি সুকান্ত'র মাঝে ভয়-ভীতির ছিটে ফোঁটাও নেই। তিনি লিখছেন মহা শক্তিধর বৃটিশ রাজকে সামান্যতম পরোয়া না করে। সেই শীর্ণ শরীরের অনবদ্য সাহসের মুগ্ধকর এক দৃষ্টিকোণ থেকেই কবিতাটি রচিত।  

কবি সুবোধ সরকার এর অনেক কবিতাই গল্প বলার মতো আঙ্গিকে রচিত। নিখাদ গদ্য কবিতাই, হয়তো আরো বেশ খানিকটা গদ্য। তবে তার কবিতার অভিঘাত শক্তি দুর্দান্ত।  পাঠকের চিন্তা-জগতকে নাড়িয়ে দেবার মতো দারুণ সক্ষম। কবি সুবোধ সরকার এর কবিতায় কোনোরূপ রাখঢাক নেই, বাস্তবের অশোধিত শব্দাবলী তিনি অনায়াসে তার কবিতায় ব্যবহার করেন। কবি সুবোধ সরকার এর জন্ম ১৯৫৮ সালে। কবি হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার এবং সম্মান তিনি অর্জন করেছেন। তার প্রয়াত স্ত্রী মল্লিকা সেনগুপ্ত, তিনিও ছিলেন একজন কবি।


কবিতাটির শেষ তিনটি লাইন লক্ষ্য করুন। আজকালের বা ইতোপূর্বের অনেক কবিদের আমরা রাজনীতির দ্বিধাবিভক্তির মাঝে আনাগােনা করতে দেখেছি। দেখেছি স্বৈরশাসকের হয়ে কবিতা লিখছেন, একদা ছিলেন সমাজতান্ত্রিক, একদিন হয়ে গেলেন হঠাৎ মৌলবাদী। "সমঝোতা" দেখি কোনো প্রাপ্তির জন্য। কিন্তু কবি সুকান্ত বা তাঁর মতো কবিদের মাঝে সমঝোতার নামগন্ধ ছিল না। কবি সুবোধ সরকার উত্তম পুরুষেই দারুন তিরষ্কার করলেন আজকের যুগের সমঝোতাকারী কবিদের। একটা লাইন লিখে শিল্প দিয়ে ধুয়ে নির্বিরোধী বা ভারসাম্য রেখে কবিতা ছাপি, যাতে পুলিশ মড়া বেড়ালের মতো ছুঁড়ে না ফেলে ডাস্টবিনে, বরং হতে পারি যেন রাষ্ট্রীয় পানাহারের মান্যবর কবি অতিথি।


কবি সুবোধ সরকার কী আশ্চর্য করুণ দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন, কবি সুকান্ত'র অসুস্থ সময়টির। এরপর সমাজতন্ত্রের প্রতি কবি সুকান্ত'র ভালোবাসা খুব সুন্দর কাব্যিক রূপকল্পে পরিবেশন করেছেন। করেছেন অতি স্বাভাবিক এক প্রশ্ন, "তখন আপনি একটা রোগা ছেলে / কী সব ভয়ঙ্কর লেখা লিখছিলেন, ভয় করতো না ?" অথচ যে ভয় যেন উঠে আসে আমাদেরও অস্তিত্বে! আমরা কি পারি আজো সুকান্ত নজরুল এর মতো দুর্নিবার সাহসে কবিতা লিখতে ? কবি সুকান্ত'র প্রতি আমাদের নিবিড় মায়া নিবিড় স্নেহ যেন জাগাতে সার্থক হলেন কবি এ কয়েকটি লাইনে, "গোটা শরীরের মধ্যে জ্বলজ্বল করত চোখ / কী অপূর্ব দুটো চোখ / একটা চােখে শ্রাবণ / একটা চোখে কিউবার মতো রাগ ।" অবশেষে, কবি সুবোধ সরকার কবি সুকান্ত'র প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী স্বরূপ নিবেদন করলেন এক সত্য সুন্দর স্বীকারোক্তি, অতি সাধারণ কথায় কিন্তু অসাধারণ এক অনুভবে, "যা লিখে গেছেন, যে ভাবে লিখেছেন / বেপরোয়া সেই লেখার পায়ের কাছে বসার / যোগ্যতাও আমার নেই ।" সত্যিই, সামান্য কিশোর বয়সেই এমন জাগ্রত মানবতাবোধে, দেশাত্মবোধে, দুঃসাহসী কবিতা লেখার যোগ্যতা কবি সুকান্ত'র যেমনটি ছিল, তা কি আজকের পূর্ণ বয়সের কবিদের মাঝে আছে? সে কথা থাক। কবিতাটি আরেকবার পড়ুন। কবি সুবোধ সরকার এর কবি দক্ষতায় মুগ্ধ হবার সাথে সাথে কবি সুকান্ত'র প্রতি আপনার মনে জেগে উঠবে গভীর এক মমতা। ধন্যবাদ।


(১৭.০৭.২০২২)