ব্লাড গ্রুপ
    - তাসনুভা অরিন


আমার কোন অক্ষর নেই
একটা ঝরনা আছে
যারা দূরে গেছে তাদের বলতে পারিনি
এখানে নিষ্ঠুরতার পূজা হয়
আমি উপাসনা করি রক্তের
তোমার ব্লাড গ্রুপ কী
এবি নেগেটিভ?


আমার একটা মুমূর্ষু পৃথিবী আছে।


***************


সহজ সরল শব্দ বাক্যে কী অপূর্ব মননশীল রূপক কবিতার শৈল্পিক ঐশ্বর্য !


এই কবিকে পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। কবিটি তার রূপক অনুভব নির্মাণের অনন্য দক্ষতায় মুগ্ধ পাঠক করে নিয়েছিল আমাকে অনায়াসে। এই কবিতাটির থেকে আরো মুগ্ধকর কবিতা আছে এই তরুণ কবিটির। তবুও এই কবিতাকেই বেছে নিলাম পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। এর অভিঘাত অপূর্ব। মনের মাঝে তোলে দারুণ বিষাদ, দুঃখবোধ সহজেই। অনুভবের মাত্রা সীমানা ভাঙে। অনুভূত হয় বিভিন্ন রূপ অর্থে। আমি যেভাবে অনুভব করেছি, আলোড়িত হয়েছি তাই বলবো সহজ করে।


তাসনুভা অরিনের জন্ম ২ অক্টোবর, রাজশাহী। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই `ত্রিকালদর্শী বেলপাতা’র পাণ্ডুলিপির জন্য তিনি প্রথমা প্রকাশন প্রবর্তিত “ জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৮” পেয়েছেন।


যখন কবিতার বইটি হাতে নিলাম বইয়ের দোকানে, কয়েকটি পাতা উল্টে কয়েকটি বাক্য পড়েই বুঝে গেলাম এই কবি যোগ্য এবং যোগ্য তার কবিতার বই এবং যোগ্য কবিটির পুরষ্কার প্রাপ্তি। সম্প্রতি তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটিও সংগ্রহ করেছি, "জলপাই বিষাদ পায়রা"।


এবার কবিতাটির কথা বলি। "আমার কোনো অক্ষর নেই"। অর্থাৎ বলার মতো ভাষা নেই। বলে যেন লাভ নেই। পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা থামে না । প্রতিবাদে, ক্রন্দনে, যন্ত্রণায়, কষ্টে কথা বলতে বলতে লিখতে লিখতে অক্ষর শব্দ বাক্য আজ স্তব্ধ, পরাভূত, বিলীন, অকার্যকর। তাই অভিমানে প্রকৃত মানুষ, মানব দরদী মানুষের কাছে যেন আর অক্ষর নেই।


তবে "একটি ঝরনা আছে"। মানুষের জন্য ভালোবাসায় ঝরে পড়ে সারাক্ষণ। ঝরে অশ্রুর মতন মানুষের জন্য দুঃখ কষ্টে। অক্ষর নেই তবু ঝরনা আছে, স্নেহ মায়া মমতার মতো ঝরে পড়তে থাকে।


"যারা দূরে গেছে তাদের বলতে পারিনি, এখানে নিষ্ঠুরতার পূজা হয়"। দূরে গেছে মানে কী ---- মৃত্যু হলো যাদের, নির্বাসিত, উৎখাত হলো যারা, পালাতে হলো যাদের, জীবনের নিষ্ঠুরতা থেকে, মানুষেরই নিষ্ঠুর লোভ আর আক্রোশ থেকে বাঁচতে যে মানুষদের দূরে যেতে হলো, যেতে হয়। তাদের সাবধান করতে পারিনি, সতর্ক করতে পারিনি, বাঁচাতে পারিনি। যেটি মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার ফলে আমাদের ওপর অর্পিত পরম এক দায়িত্ব, কর্তব্য।


"আমি উপাসনা করি রক্তের"। নিষ্ঠুরতার পূজা করা মানুষের মতো রক্ত পান করবার জন্য না, মানুষকে বাঁচাতে, রক্তদানের জন্য উপাসনা করি রক্তের। আরোগ্য লাভের জন্য রোগীর যেমন প্রয়োজন রক্তের, ঠিক তেমনই এক সুনিপুণ চিত্রকল্প। ঠিক এর পরের বাক্যটি অপূর্ব কাব্যিকতা, বাস্তবতার সাথে মিশিয়ে দেয়া অনবদ্য কাব্যিক সংলাপ "তোমার ব্লাড গ্রুপ কী এবি নেগেটিভ?" যেমন আমাদের জীবনে প্রিয়জনদের বাঁচাতে জনে জনে খুঁজি সঠিক ব্লাড গ্রুপ। এবং "এবি নেগেটিভ" কবির এই চিন্তাশীল প্রয়োগটিও যেন যৌগিক পৃথিবীর ঋণাত্মক অনুভবকে নির্দিষ্ট করে তোলে ।


এবং এরপরেই অসাধারণ সমাপ্তি, কবির কলমে লিখিত হয় দুর্দান্ত অভিঘাতে শেষ বাক্য "আমার একটা মুমূর্ষু পৃথিবী আছে"। কী বেদনার্ত হয়ে পড়ি বাক্যটি পড়ে, এই বাক্যটির আর্তি অনন্য কাব্যিক দ্যোতনা সৃষ্টি করে পাঠ করার মুহূর্তেই । মুমূর্ষ পৃথিবী।  কত গভীর সত্যি একটি কথা। বৈশ্বিক সত্য, জাতিগত সত্য, ধর্মীয় সত্য, স্বাদেশিক সত্য, রাষ্ট্রিক সত্য, ব্যক্তিক সত্য। সেই মুমূর্ষ পৃথিবীকে বাঁচাতে কবি উপসনা করেন রক্তের, খুঁজে চলেছেন নির্দিষ্ট ব্লাড গ্রুপ, নিষ্ঠুর মানুষেরা কথা শোনে না আর, তাই অক্ষরও নেই আর কিন্তু আছে ঝরনা.......নিয়ত নিষ্ঠুরতার পূজায় আক্রান্ত মানুষ ও পৃথিবীর জন্য ভালোবাসায়।


যখন এরকম রূপক কবিতা পড়ি। অনুভবে মহা মুগ্ধ হই। তখন রূপক কবিদের বিরুদ্ধে সমালোচনার স্রোত থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে এই সব অনবদ্য দক্ষ রূপক কবিদের খুব ভালোবাসি। ঈর্ষায় জ্বলি কেন এমন লিখতে পারি না। আশ্চর্য হই, একদম তরুণ একজন কবি কীভাবে এমন লেখে! কীভাবে এমন ঐশ্বর্যময় রূপক অনুভব শব্দ বাক্যে নির্মিত হয় এত তরুণ কবি মস্তিষ্কে ! আসলে যারা সত্যিই কবি, রূপক গদ্যের হোক বা ছন্দেরই, কাঁচা বয়স থেকেই তাদের কলমে কবিত্ব শক্তি প্রকাশিত হতে থাকে। কবি তাসনুভা অরিন লিখে রেখে যাও আরো অনেক এমন কবিতার শিল্প। আমরা মুগ্ধ হই, ভবিষ্যতও মুগ্ধ হোক। কবিতার ভুবন তোমাদের রূপক কবিতার আলোতে আরো সমৃদ্ধ হোক। ধন্যবাদ।